বাংলাদেশের সহকারী কোচ নিক পোথাসের মতে, রশিদ খান, মুজিব উর রহমানের বোলিং বুঝতে শুধু বাংলাদেশের নয়, সমস্যা হয় গোটা বিশ্বের ব্যাটসম্যানদের।
Published : 10 Jul 2023, 03:49 PM
দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারের ঘটনা। বোলার মুজিব উর রহমান। অফ-মিডল স্টাম্পে জোরের ওপর করা লেংথ ডেলিভারি সোজা আসবে ভেবে ব্যাট পেতে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। কিন্তু হালকা টার্ন করে ব্যাটের পাশ দিয়ে গিয়ে বল উপড়ে দিল অফ স্টাম্প। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন শান্ত। সবচেয়ে ছন্দে থাকা ব্যাটসম্যানের অভিব্যক্তিতেই যেন পরিষ্কার আফগানিস্তানের বোলারদের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের বাকিদের অবস্থা।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে দুই ওয়ানডেতেই স্বাগতিক ব্যাটসম্যানদের কঠিন পরীক্ষা নিয়েছেন আফগান স্পিনাররা। তাদের সামনে টিকে থাকতে ও রান তুলতে ধুঁকতে হয়েছে শান্ত, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের। বাংলাদেশের সহকারী কোচ নিক পোথাস অবশ্য এতে তেমন চিন্তিত নন। তার মতে, বিশ্বের সব দেশের ব্যাটসম্যানদেরই এমন ভুগতে হয় মুজিব, রশিদ খানদের বিপক্ষে।
বৃষ্টিময় প্রথম ম্যাচে আলগা শটের পসরা সাজিয়ে তিন স্পিনারের ২৪ ওভারে ৫ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। বিপরীতে স্কোরবোর্ডে জমা পড়ে স্রেফ ৬৯ রান। দ্বিতীয়টিতে দুর্দান্ত বোলিংয়ের প্রদর্শনীতে ২৫ ওভারে ৯৭ রানে রশিদ-মুজিব-নবির শিকার ৬ উইকেট।
তিন স্পিনারের পাশে ফজলহক ফারুকির স্কিলফুল বাঁহাতি পেস আফগান বোলিংয়ে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। দুই ম্যাচেই এই বাঁহাতি পেসারের শিকার ৩টি করে।
মঙ্গলবার শেষ ম্যাচে নামার আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের সহকারী কোচ যেন ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন ব্যাটসম্যানদের সামনে। এমন বোলিং আক্রমণের সামনে যে ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ নয়, সেটিই বোঝাতে চাইলেন পোথাস।
“সত্যি বলতে, আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণ বিশ্বের সেরা। এটা স্রেফ বাস্তবতা। তাদের দলে এমন তিনজন স্পিনার আছে, যারা বিশ্বজুড়ে সাদা বলের ক্রিকেটে অনেক ম্যাচ খেলেছে। যে কোনো অধিনায়কের জন্য এটি স্বপ্ন। যার হাতেই বল তুলে দেওয়া হয়, সে কাজটা করে দেয়। তারা অসাধারণ।”
শান্তর মতোই দ্বিতীয় ম্যাচে রশিদ-মুজিবদের স্পিন পড়তে পারেননি সাকিব, তাওহিদ হৃদয়, আফিফ হোসেনরা। রশিদের গুগলিতে পুরোপুরি পরাস্ত হন হৃদয়। নবির অ্যাঙ্গেলে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারি ফ্লিক করার চেষ্টায় বলের কাছেও যেতে পারেননি সাকিব। দুই ম্যাচেই রশিদের সামনে স্রেফ অসহায় ছিলেন আফিফ।
শুধু এবার নয়, চট্টগ্রামে গত বছরের সিরিজেও ফারুকির পাশাপাশি আফগানিস্তানের স্পিনাররা পরীক্ষায় ফেলেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। আফিফ ও মেহেদী হাসান মিরাজের অবিশ্বাস্য জুটিতে সেবার প্রথম ম্যাচ জিতে পরে সিরিজ জেতে স্বাগতিকরা। এবার আর হয়নি রক্ষা। এক ম্যাচ বাকি থাকতেই শেষ সিরিজ জয়ের আশা।
সিরিজ হারের পর বারবার ঘুরে ফিরে আসতে থাকে আফগান স্পিনারদের প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের সহকারী কোচের মতে, সমস্যাটা শুধু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরই নয়।
“আমার মতে, প্রশ্নটা এমন নয় যে, এই স্পিনারদের পড়তে আমরা ভুগছি। প্রশ্নটা হলো, পুরো বিশ্ব কতটা ভুগছে। র্যাঙ্কিংয়ে তাদের অবস্থানেই বোঝা যায়, বিশ্বের সবাই তাদের বল পড়তে ভুগছে।”
২০১৭ সালে মুজিবের অভিষেকের পর থেকে স্পিনে স্রেফ ৬৩ ম্যাচে ২৭৬ উইকেট নিয়েছে আফগানিস্তান। এই সময়ে তাদের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছে শুধু ভারতের স্পিনাররা। তবে আফগান স্পিনারদের প্রায় অর্ধেক উইকেট আয়ারল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ম্যাচও তাদের বিপক্ষেই বেশি খেলেছেন তারা। বাংলাদেশের সঙ্গে ৮ ম্যাচে তাদের স্পিনাররা নিয়েছে ৩১ উইকেট।
এছাড়া তাদের ২০টির বেশি শিকার আছে শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ ম্যাচে ১০টি করে উইকেট পেয়েছে আফগানিস্তানের স্পিনাররা। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে তারা খেলেছে স্রেফ ১টি করে ম্যাচ।
মুজিবদের বল বুঝতে পারার চ্যালেঞ্জে বোঝাতে গিয়ে কাউন্টি দল মিডলসেক্সে নিজের অভিজ্ঞার কথা শোনালেন পোথাস। এই প্রসঙ্গে দুই কিংবদন্তি স্পিনার শেন ওয়ার্ন ও মুত্তিয়া মুরালিধরনের উদাহরণও টেনে আনলেন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই কিপার।
“মিডলসেক্সে মুজিবকে পেয়েছিলাম আমি। একজন উইকেটরক্ষক হয়েও আমি যখন স্টাম্পের পেছনে উইকেটরক্ষকের চোখে দাঁড়িয়েছি, তার সঙ্গে কথা বলার পরেও ডেলিভারি বুঝতে সমস্যা হয়েছে আমার। এ কারণেই তারা এত ভালো।”
“সবাই কি (শেন) ওয়ার্নকে পড়তে পারত? সবাই কি (মুত্তিয়া) মুরালিধরনকে পড়তে পারত? না! এ কারণেই তারা বিশ্বের সেরা। এ কারণেই বিশ্বের সব টুর্নামেন্টে রহস্য স্পিনারদের পেছনে এত বেশি টাকা খরচ করে। তো বিষয়টা এমন নয় যে, আমরা পারছি না। পুরো বিশ্বই পারছে না। প্রশ্নটা হলো, আমরা এর বিপক্ষে কীভাবে খেলব এবং নিজেদের আরও ভালো করব।”
এই চ্যালেঞ্জের ইতিবাচক দিকও দেখছেন পোথাস। সামনের এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলতে হবে বাংলাদেশকে। বড় টুর্নামেন্টে নামার আগে এই সিরিজকে তাই নিজেদেরকে আরও ভালোভাবে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ মনে করছেন বাংলাদেশের সহকারী কোচ।
“টেকনিক্যালি তারা যে চ্যালেঞ্জটাদিচ্ছে আমাদের, তাদারুণভাবে কাজে লাগবে। কারণ, এটি আমাদের আরও ভালো হতে সাহায্য করছে। এই মানের স্পিন মোকাবিলা করতে পারলে, আপনি যে কাউকে মোকাবিলা করতে পারবেন। তাদের স্পিন আক্রমণেরআরেকটা বিষয়, তারা একের পর এক আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে থাকে। আর কোনো দলে এই মানের তিনজন স্পিনার নেই, যারা প্রতিটি মুহূর্তে এভাবে চাপে রাখে।”
“তো, আমাদের প্রস্তুতির জন্য এটি খুবই লাভজনক। হ্যাঁ! তারা দল হিসেবে র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের চেয়ে নিচে। তবে তারা (স্পিনার) যেমন দক্ষতাপূর্ণ, আমার মনে হয়, তারা বোলিং র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সেরা দশের মধ্যে আছে। আমরা (এই চ্যালেঞ্জ) খুবই ইতিবাচকভাবে দেখছি।”
আফগানিস্তানের এই বোলিং আক্রমণের সামনে গত দেড় বছরে দুই দফায় সিরিজ খেলল বাংলাদেশ। চোখে পড়ার মতো উন্নতি নেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের।
তবে এত দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেট ও ইংলিশ কাউন্টিতে দুইশর বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার রান করা কিপার-ব্যাটসম্যান পোথাস।
“উন্নতির সুযোগ সবসময়ই থাকবে। তবে চাপের মধ্যে সবসময়ই ভুলের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এসবের জন্য সময় লাগে। আমি বুঝতে পারছি, আপনাদের চাওয়া যেন দ্রুত হয় (উন্নতি)। কিন্তু এসবে দ্রুত উন্নতি হয় না, গোটা বিশ্বেই এভাবে হয় না। যারা ২০০ ওয়ানডে খেলেছে, তারাও শেখার মধ্যে আছে। এটা তাই দ্রুত হওয়ার নয়।”
“রোমাঞ্চকর বিষয় হলো, আমাদের দলের বেশ কজন তরুণ ব্যাটসম্যান আছে, যারা বাংলাদেশের হয়ে শীর্ষ পর্যায়ে আরও ১০-১৫ বছর খেলবে। এটাই আশা জাগানিয়া।”