উপাচার্য বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
Published : 27 Jan 2025, 03:40 PM
অবশেষে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে মুক্ত হচ্ছে ঢাকার সাত সরকারি কলেজ।
এর অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ সেশন, অর্থাৎ চলতি বছর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে।
সোমবার দুপুরে সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
“এ সিদ্ধান্তের আলোকে আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক বছর এগিয়ে এনে ২০২৪-২০২৫ থেকে ঢাবির অধীনে আর ভর্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গে ঢাকার এই সাত সরকারি কলেজের পথচলা মোটেও ‘নির্বিঘ্ন’ ছিল না। ‘সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ’–এমন শিরোনাম গত আট বছরে বহুবার দেখেছে মানুষ।
গতবছর অগাস্টে ক্ষমতায় পালাবদলের পর এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন।
আনন্দোলকারী শিক্ষার্থীরা বলে আসছিলেন, অধিভুক্তির কারণে স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়হীনতায় ভুগতে হয় তাদের। নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে তারা নানা সমস্যায় পড়েন।
সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোতে আনার দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা।
এর মধ্যে গত রোববার সন্ধ্যার যে কর্মসূচির সূত্র ধরে সোমবারের ‘আলাদা হওয়ার’ সিদ্ধান্ত এল, সেই খবরের শিরোনামও ছিল ‘সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ’।
সেদিন সন্ধ্যায় নানা দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাব ও টেকিনিক্যাল মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
তাদের অভিযোগ, দাবি-দাওয়া জানাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন; কিন্তু উপউপাচার্য তাদের ‘অপমান’ করেন।
ওই অভিযোগে রাত সোয়া ১১টার দিকে সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে রওনা হন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ঢাকা কলেজের বিভিন্ন হল থেকে আসা শিক্ষার্থীরা। তারা নীলক্ষেত মোড় হয়ে ক্যাম্পাসের মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণের সামনে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে তারা উপউপাচার্যের বাসভবনে অভিমুখে রওনা হওয়ার ঘোষণা দেন।
এদিকে তাদের এই অবস্থানের খবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হল থেকে লাঠি সোঁটা নিয়ে স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে জড়ো হতে থাকেন।
দুই পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে মধ্যরাতে শুরু হয় সংঘর্ষ; ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। মোতায়েন করা হয় চার প্লাটুন বিজিবি। তারপরও রাতভর উত্তেজনা চলে দুই পক্ষের মধ্যে।
সোমবার সকালে ‘হামলাকারীদের’ বিচার দাবিতে নিজ নিজ ক্যাম্পাসের সামনে সড়ক অবরোধের ঘোষণা দেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এরপর তাদের সোমবারের সব চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সোমবারের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়। রাজধানীতে বাড়তি প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ।
এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টায় জরুরি সভায় বসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সাত কলেজের অধ্যক্ষরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদের কার্যালয় সংলগ্ন সভাকক্ষে এই সভা হয়। সভার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আব্দুল মতিন ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে ‘আলাদা’ হওয়ার সিদ্ধান্ত জানান উপাচার্য।
অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান লিখিত বক্তব্যে বলেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ বিষয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ইতোমধ্যে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে।
“সেই সঙ্গে ধৈর্যধারণ, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।”
যে পাঁচ সিদ্ধান্ত জরুরি সভায়
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের সম্মানজনক পৃথকীকরণ;
২. আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এক বছর এগিয়ে এনে অর্থাৎ ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে;
৩. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষের কার্যক্রম পরিচালনা করার সুপারিশ;
৪. ২০২৪-২০২৫ শিক্ষাবর্ষ আসন সংখ্যা ও ভর্তি ফি নির্ধারণসহ যাবতীয় বিষয়ে মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং
৫. যেসব শিক্ষার্থী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা কার্যক্রমের অধীনে রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়িত্বশীল থাকবে, যাতে তাদের শিক্ষাজীবন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
সংবাদ সম্মেলন শেষে সাত কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "সাত কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থীদের আমরা টেক কেয়ার করব। বাকিটা আপনাদেরকে লিখিত আকারে জানানো হবে।"
কেন এই অধিভুক্তি?
এক সময় দেশের সব ডিগ্রি কলেজ পরিচালিত হত ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করে তখনকার বিএনপি সরকার।
কিন্তু বিপুল সংখ্যক কলেজ সামলাতে গিয়ে হিমশিম দশা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। সময় মত পরীক্ষা নেওয়া বা ফল প্রকাশ করতে না পারায় দেখা দিদেয় দীর্ঘ সেশনজট। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে দেখা দেয় স্থবিরতা। সনদের মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা তখনও রাস্তায় নেমেছিলেন।
২০১৪ সালের শেষ দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার নির্দেশ দেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরের বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে এক বৈঠকে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার প্রক্রিয়া ত্বরাণ্বিত করার তাগিদ দেন।
এর ধারাবাহিতায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়।
কলেজগুলো হলো- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
সে সময় সিদ্ধান্ত হয়, এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা, পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সে সময় কলেজ ছিল দুই হাজার ১৫৪টি, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখের বেশি।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হওয়া সাত কলেজে তখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এক লাখ ৬৭ হাজার ২৩৬ জন শিক্ষার্থী এবং এক হাজার ১৪৯ জন শিক্ষক ছিলেন।
সে সময় দেশের অন্য সরকারি কলেজগুলোকেও ধারাবাহিকভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত ছিল, কিন্তু সাত কলেজের পর সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি।
এখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সাত কলেজের অধিভুক্তিরও ইতি ঘটল। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ভার এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটির হাতে।
সাত কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নে গত ডিসেম্বরে চার সদস্যের এই বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ উপাচার্য ও ইউজিসির একজন সদস্য এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন।
পুরনো খবর-
সাত কলেজকে আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে: শিক্ষা উপদেষ্টা
কমিটি গঠনের আশ্বাসে তিতুমীর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আপাতত স্থগিত
তিতুমীর শিক্ষার্থীদের অবরোধ প্রত্যাহার, ট্রেন চলাচল শুরু