আগের চেয়ে অনেক দাম বেড়ে যাওয়ায় কমে গেছে খুচরা পর্যায়ের বেচাকেনা।
Published : 13 Jan 2024, 11:51 PM
রোজার আলোচনা শুরুর আগেই খেজুরের দাম বেড়ে গেছে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ। রোজায় দাম আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা।
এ পণ্যের আমদানিকারকরা দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী করছেন শুল্কায়নের নতুন পদ্ধতি ও ডলারের দর বেড়ে যাওয়াকে।
তারা বলছেন, টাকার মান পড়ে যাওয়ায় এমনিতেই দাম বেশি পড়ছে, তার ওপর নতুন পদ্ধতিতে সরকার বেশি শুল্ক আদায় করছে, এর প্রভাবও পড়ছে দামে।
আগামী মার্চে যে রোজা শুরু হতে যাচ্ছে, সে মাসের পণ্যমূল্য নিয়ে এখনই কথা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোজায় দাম নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়েছেন।
এর মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রোববার খেজুর, জায়নামাজ ও আতর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুই দশক আগেও মূলত রোজাকে সামনে রেখে ফলটি আমদানি করা হলেও এখন সারা বছরই এর চাহিদা থাকে। আর চাহিদার পুরোটাই আমদানি করে মেটাতে হয়।
তবে দাম বেড়ে যাওয়ায় কমে গেছে খুচরা পর্যায়ের বেচাকেনা। এ কারণে বিক্রেতাদের আয়ও কমে গেছে।
২০২২ সালে সাধারণ মানের যে ‘দাবিস’ খেজুর ২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, এক বছরের ব্যবধানে এখন তা ৪০০ টাকায় ঠেকেছে।
ঢাকায় কাজ শেষে চাঁদপুরে বাড়ির পথ ধরার আগে মিজানুর রহমান ৩৮০ টাকায় এক কেজি কিনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘দুই কেজির দামে আইজ এক কেজি পাইলাম। যা দাম বাড়তাছে সারা বছর তো আর কেনা যাইব না।’’
গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ীতে গত ১৬ বছর ধরে খেজুর বিক্রি করে আসা মীর হোসেন নিজেও দাম নিয়ে হতাশ। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি কার্টুনে (৫কেজি) ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।’’
গত রোজার সময়ে মরিয়ম খেজুর ৩০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এবার দর সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৬০০ টাকা পর্যন্ত।
তিনি জানান, দুবাই থেকে আসা যে খেজুর গতবার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল তা এখন ৮০০ টাকা।
ওমান প্রবাসী মোহাম্মদ হাসান গত তিন মাস আগে দেশে এসেছেন। ঢাকায় বোনের বাসায় বেড়াতে যাওয়ার পথে গুলিস্তান থেকে খেজুর কিনে বললেন, ‘‘ওমানে যে খেজুর পাওয়া যায় তা এখন ঢাকাতেও আসে। মান ও চেহারায় একই। তাই এখান থেকেই নিলাম।’’
হাসানের কাছে খেজুর বিক্রি করা মোহাম্মদ হেলাল বলেন, ‘‘প্রতি কেজি ভালো মানের আজোয়া খেজুর এবার এক হাজার ১০০ টাকা। গতবার বিক্রি করেছিলাম ৮০০ টাকায়।”
কোন এই বৃদ্ধি- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আড়তদাররা কয় ট্যাক্স আর ডলারের দাম বাড়ছে। তাই খেজুরের দামও বাড়তি।’’
ক্রেতারা তাদেরকেই ধরে জানিয়ে হেলাল বলেন, ‘‘যত অভিযোগ আমাগো কাছে। আমরা তো কিইন্না আনি। আমাগো কইয়া কী লাভ। কাস্টমার তা বোঝে না।’’
দাম বেড়ে যাওয়ায় নিজেও নাখোশ মতিঝিলের ফুটপাতের বিক্রেতা সাকিব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‘দাম বাড়লে ভাত খাবে না খাজুর খাবে? আগে যে এক কেজি নিত এখন আধা কেজি নিচ্ছে। বিক্রি তো কমতাছে।’’
কী বলছেন বড় ব্যবসায়ীরা
খেজুরের সবচেয়ে বড় আড়ৎ পুরান ঢাকার বাদামতলীর ব্যবসায়ী সাথী ফ্রেশ ফ্রুটস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম দাম বৃদ্ধির জন্য আমদানি শুল্ক বৃদ্ধিকেই মূল দায়ী করেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘আগে যেখানে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা আমদানি শুল্ক ছিল, এখন ১৭৫ টাকা করেছে, দাম তো বাড়বেই। আমরাও খেজুর এনে বিপদে আছি।”
আরেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক এক্সিম লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন বলেন, “শুল্কায়ন পদ্ধতি বদলে যাওয়ায় খেজুরের দাম বন্দরেই বেড়েছে ৫০ থেকে শতভাগ। এর সঙ্গে রয়েছে ডলারের বাড়তি দাম ও পরিবহন খরচ।”
তিনি বলেন, “আগে ছোট বক্সে করে আসা খেজুরের শুল্ক ছিল দামের ১৩ শতাংশ, কার্টুনে আসলে ১৫ শতাংশ ও খোলা আকারে আসলে ২২ শতাংশ। এখন খেজুরের নাম ও দাম অনুযায়ী শুল্কায়ন করা হচ্ছে। অনেক সময় আমদানি মূল্য যা দেখানো হয় তা না মেনে দাম বেশি ধরে মূল্যায়ন করছে কাস্টমস বিভাগ।”
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেয়া দাম অনুযায়ী মূল্যায়ন (অ্যাসেসমেন্ট) করা হচ্ছে না। বেশি দাম ধরে অ্যাসেসমেন্ট করায় এমনিতেই খরচ বেড়ে যায়। এর সঙ্গে ডলারের দর বৃদ্ধি তো আছেই।’’
বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও প্রধানমন্ত্রী বরাবরও স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আগে ছিল সাধারণ পণ্য, এখন এনবিআর খেজুরকে বিলাসী পণ্য ধরে অ্যাসেসমেন্ট করছে।’’
ব্যবসায়ীদের এই বক্তব্যের বিষয়ে জানতে কাস্টমস হাউস চট্টগ্রামের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমানের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দেয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
শুল্কায়নের দায়িত্বে থাকা কাস্টম হাউস চট্টগ্রামের উপ-কমিশনার বদরুজ্জামান মুন্সীর মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ডলারের দর বৃদ্ধিও আরেক কারণ
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বরে যে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৯৫ টাকা। এক বছর পর তা ১১০ টাকায় দাঁড়ায় অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলেই ডলারের দর বেড়েছে ১৪ শতাংশ।
তবে খোলা বাজারে এই ডলার বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায় ও ব্যাংকেই আমদানি পর্যায়ে নির্ধারিত দরের বদলে বিক্রি হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৫ টাকা।
ফলে ব্যবসায়ীদের আমদানির সময়ই খরচ বেড়ে গেছে। যে দেশ থেকে ফলটি আমদানি করা হচ্ছে, সেখানে দাম না বাড়লেও দেশে আসতে আসতে এমনিতেই বেশি পড়ে যাচ্ছে ২০ শতাংশের বেশি।
চাহিদা কত
পণ্যটির বার্ষিক চাহিদা ৮০ হাজার টন বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। সাধারণভাবে ধারণা করা হয় খেজুর বেশি আসে সৌদি আরব থেকে। তবে ব্যবসায়ীরা জানান, বেশিরভাগ খেজুর আসে ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
স্বল্প আয় ও মধ্যবিত্তের পছন্দের ‘জাহেদি’ খেজুরের প্রায় পুরোটাই ইরাক থেকে আসে। তবে চাহিদার তুঙ্গে থাকে সৌদি আজওয়া, আম্বার, মাবরুম, ইরান, জর্ডান এবং মিশরের মরিয়ম খেজুরের।
কিছুটা বড় আকারের খেজুর ‘মেডজুল’ আসে মিশর থেকে।
আরও পড়ুন
সবচেয়ে ‘কমদামি’ খেজুরের শুল্কও কেজিতে ৭০ টাকা, দাবি ব্যবসায়ীর