দেশে ৮০% খেজুরই আসে ইরাক থেকে

বাংলাদেশে সাধারণ্যে খেজুর সৌদি আরবের ফল হিসেবে পরিচিত হলেও দেশে চাহিদার ৮০ শতাংশ খেজুরের জোগান ইরাক থেকে আসে বলে আমদানিকারকরা জানিয়েছেন।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2022, 03:51 PM
Updated : 16 April 2022, 03:51 PM

তারা বলছেন, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, তিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, জর্ডান ও মিশর থেকেও বাংলাদেশে খেজুর এলেও দাম কম বলে ইরাক থেকেই বেশি আসে।

ইফতারিতে সবাই খেজুর রাখতে চাওয়ায় রোজায় এই ফলের চাহিদা যায় বেড়ে। আর বাংলাদেশে তা উৎপাদন হয় না বলে পুরোটাই আমদানি করতে হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেবল রমজানেই বছরের ৫০ শতাংশের বেশি খেজুর বিক্রি হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা খেজুর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর হয়ে ঢোকে দেশের বাজারে। মিশরের মেডজুলের মতো অল্প কিছু খেজুর আসে বিমানে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে তাজা ও শুকনো খেজুর (খেজুর ও খুরমা) আমদানি হয়েছিল ৮২ হাজার ২৮ টন।

ইফতারের অন্যতম অনুষঙ্গ খেজুর। রোজায় তাই খেজুরের চাহিদা বহু গুণ বেড়ে যায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সহকারী কমিশনার আব্দুল হান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত বছরের জুলাই থেকে গত মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে দেশে ৭৬ হাজার ২৫১ টন খেজুর আমদানি হয়েছে।

“এখনও খেজুর আমদানি হচ্ছে। আরও তিন মাস হবে। তবে রোজায় আমদানিটা বেশি হয়।”

খেজুর আমদানিকারকরা বলছেন, সারা বছরে যে খেজুরের চাহিদা, তার চেয়ে তিন থেকে চারগুণ চাহিদা বেড়ে যায় রোজায়। সেই চাহিদা মেটাতে ছয় মাস আগে থেকেই খেজুর মজুদ করতে থাকেন তারা। সেসব খেজুর সংরক্ষণ করা হয় হিমাগারে।

ফল আমদানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রোজায় খেজুরের চাহিদা ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন। বছরের বাকি ১১ মাসে এই চাহিদা থাকে ১০ হাজার টনের মতো।

এ বছর রোজা উপলক্ষে ৪০ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে বলে জানান তিনি।

সিরাজুল বলেন, আমদানির ৮০ শতাংশই ইরাক থেকে আসা সবচেয়ে কম দামের ‘জাহেদী’ খেজুর।

“এটি পিপিই ব্যাগেও আসে, ১০ কেজির কার্টনেও আসে। যেটা পিপিই ব্যাগে আসে, সেটার পাইকারি দাম ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। আর যেটা ১০ কেজির কার্টনে আসে, সেটা ১০০ টাকা কেজি। কার্টনেরটা কিছুটা প্রসেসিং করা থাকে।”

ইরাকের জাহিদীর পর বেশি আসে আমিরাত গোল্ড। আমিরাত থেকে আসা এই খেজুর পাইকারি বাজারে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।

বাদামতলীর পাইকারি বাজারের পাঁচ কেজির একটি মরিয়ম খেজুরের বক্স রাখা হচ্ছে ১৭০০ টাকা থেকে ২২০০ টাকায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সিরাজুল জানান, নাগাল, রেজিস, দাব্বাস ও লুলু খেজুরও আসে আমিরাত থেকে।

“নাগাল ১২০ থেকে ১৩০ টাকায় পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়। প্রতি কেজি রেজিস খেজুর ১৪০ টাকায়, দাব্বাস ও লুলু খেজুর (বরই খেজুর) ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়।”

তবে খুচরা বাজারে জাত ও ধরন ভেদে কেজিতে ৫০ থেকে ২০০ টাকা বাড়তিতে খেজুর কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

সৌদি আরব থেকে আজওয়া, আম্বার, মাবরুম, মাশরুক, সাফাওয়ি বা কালমি এবং ইরান ও জর্ডান থেকে মরিয়ম খেজুর আসে। মিশর থেকে আসে বড় আকারের খেজুর মেডজুল।

সাথী ফ্রেশ ফ্রুটের কর্ণধার সিরাজুল বলেন, “অগাস্ট থেকে সিজন শুরু হলেই আমরা আমদানি শুরু করি। অক্টোবর পর্যন্ত দামটা ঠিক ছিল। নভেম্বর থেকে জাহাজের ভাড়া বেড়ে যাওয়ায়, বেশি দামে খেজুর কিনতে হয়েছে আমাদের।

“নরমাল কনটেইনার ১০০০ থেকে ১৫০০ ডলারে যেগুলো আনতাম, সেটা হয়ে গেছে ৪০০০-৪৫০০ ডলার। এ কারণেই দামটা শেষের দিকে বেশি ছিল। এবার ইরাকে কম খেজুর হয়েছে, ইরাকেরটার দাম একটু বেশি ছিল এবার। নইলে আমরা আরও কমে বিক্রি করতে পারতাম। অন্যান্যগুলোর দাম কম ছিল।”

যে পরিমাণ খেজুর আমদানি হয়েছে, তা রোজায়ই বিক্রি হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

দেশে ফলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাদামতলিতে ২০ বছর ধরে খেজুরের ব্যবসা করছেন শাকিল ফ্রেশ ফ্রুটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল হক।

তিনি জানান, খেজুর যখন নতুন গাছে ধরে, তখনই তাদের সেটা কিনে রাখতে হয়। রমজানের ছয় মাস আগে থেকেই তারা খেজুর সংরক্ষণ করতে শুরু করেন।

“খেজুরের চাহিদা রমজানে অনেক বেশি বেড়ে যায়। আমরা যে খেজুর এনেছি, সেটা বিক্রি প্রায় শেষের দিকে। এখন খুচরা ব্যবসায়ীরা এটা বিক্রি করবে। আমরা খেজুরগুলো এনে কোল্ড স্টোরে সংরক্ষণ করে রাখি। সেখান থেকেই আমরা বিক্রি করি।”

প্যাকেজিং এবং মেয়াদের বিষয়ে তিনি বলেন, “এসব প্যাকেটের গায়ে খেজুরের নাম, প্যাকেজিং ডেট ও মেয়াদের তারিখ সুন্দরভাবে লেখা থাকে।”

বাদামতলীর পাইকারি বাজারে পাঁচ কেজির একটি আজওয়া খেজুরের বক্স কিনতে খরচ হবে ১২০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মহামারীর খড়গে সৌদি আরবে বিদেশিরা হজ করার সুযোগ না পাওয়ায় সেখানে আজওয়ার বিক্রি একদম কমে গেছে। এ কারণে এই খেজুর এবার অনেক কম দামে আমদানি হয়েছে বলে জানান তিনি।

“আজওয়ার সবচেয়ে ভালোটা এবার সাড়ে ৩০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি, যেটা গতবারও ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছিলাম।”

বাদামতলীতে ৩০ বছর ধরে খেজুরের ব্যবসা করা মৌসুমী ট্রেডার্সের মালিক তারেক আহমেদ মনে করেন, গত কয়েক বছরে খেজুরের বাজারে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে।

“এখন সারা বছরই খেজুর বিক্রি হয়। সারা বছর ৫০ শতাংশ চলে, শুধু রোজায় ৫০ শতাংশ। আগে ঢাকার বাইরে চাহিদা কম ছিল, এখন বাড়ছে।”

এই ব্যবসায়ী জানান, গত দুই বছর করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা ভালো না গেলেও এবার বেচাকেনা থাকায় দোকানদাররা আড়ত থেকে প্রচুর খেজুর কিনেছেন।

তারেক বলেন, “সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ খেজুর কিনে। যেহেতু দেশে মধ্যবিত্ত বেশি, তাই কম দামি খেজুরই বেশি চলে। ইরাকের ‘জাহেদী’ খেজুর রোজায় সবচেয়ে বেশি চলে আমাদের দেশে।

“আজওয়ার চাহিদা এবার সবচেয়ে বেশি। কারণ মান অনুযায়ী এটা ভালো। দুই বছর হজ না হওয়ায় এ খেজুরের দামটা এবার কম। আমরা ১০ বছর আগে ২ হাজার ২০০ টাকা কেজি বিক্রি করতাম। এখন ৫ কেজি আজওয়ার দাম ১ হাজার ৭০০ টাকা।”

গুলিস্তানের ফল ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন জানান, তার দোকোনে কম দামের খেজুরের চাহিদা কিছুটা বেশি। তবে মাঝে মাঝে দামি খেজুরেরও ক্রেতা পান তিনি।

“জাহেদী খেজুর ১৫০ টাকায় বিক্রি করতেছি। বরই খেজুরও ভালোই চলে। অনেকে কালমি খেজুর নিচ্ছে। আবার অনেক সময় আজওয়া, মরিয়ম- এগুলাও খুঁজে কাস্টমাররা। তবে জাহেদী আর বরই খেজুর কিনে ৭০ ভাগ মানুষ।”

তিউনিশিয়ার এই খেজুর এসেছে গাছের ছড়াসহ। পাঁচ কেজির একটি বক্স বিক্রি হচ্ছে ১৩৫০ টাকায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

পল্লবীর ফল বিক্রেতা মোবারক আলী রোজায় কেবল খেজুর বিক্রি করেন। এই বিক্রেতা জানান, রমজানে সব ফল যতটা বিক্রি হয়, খেজুর বিক্রি হয় তার চেয়ে বেশি।

“ইফতারিতে খেজুর সবার ঘরেই থাকে। অন্য ফল এতটা কমন হবে না। সেজন্য খেজুরের বিক্রি বেশি, লাভও ভালো হয়।”

তিনি বলেন, “এখন কিছু মানুষ সারাবছরই খেজুর খায়, তবে সংখ্যাটা খুবই কম। রমজানে সবাই খায়। ফলে ১১ মাসে যে খেজুর বিক্রি করি তারচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এক মাসে।”

কম দাম ও মাঝারী মানের খেজুরের চাহিদাই বেশি বলে জানান তিনি। তবে অভিজাত এলাকাগুলোতে খেজুরের চাহিদার এই চিত্র উল্টো।

গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের ঢালি সুপারশপে আজওয়া, মেডজুল ও মরিয়ম খেজুর বেশি বিক্রি হচ্ছে।

এই দোকানের বিক্রয়কর্মী জহিরুল ইসলাম জানান, এর বাইরে সৌদি আরব, জর্ডান, দুবাই থেকে আসা খেজুরের ভেতর বিচির বদলে বাদাম থাকা এক ধরনের খেজুরও বেশ বিক্রি হচ্ছে।

শুধু রমজানকেন্দ্রিক চিন্তা না করে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ফলটি সারা বছর খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ তামান্না চৌধুরী।

“সারা বছর খেলে দামটাও নাগালে থাকে, পুষ্টিও পাওয়া যায়। শুধু এ মাসটায় খেজুর খাওয়ায় এটিকে কেন্দ্র করে সংরক্ষণ করায় অনেক সময় ভেজাল থাকার আশঙ্কাও থাকে।”