রোজায় ছোলা-খেজুর নিয়ে সতর্ক করলেন ব্যবসায়ীরা

এফবিসিসিআই সভাপতিও ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছেন; বলেছেন, যারা বাজারে কারসাজি করবে তাদের সঙ্গে এফবিসিসিআই নেই।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 Dec 2023, 02:12 PM
Updated : 18 Dec 2023, 02:12 PM

ছোলা ও খেজুরের সরবরাহ ব্যবস্থায় জরুরিভিত্তিতে এখনই নজর দেওয়া না হলে আসন্ন রোজায় পণ্য দুটির বাজার অস্থিতিশীল হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ব্যবসায়ীরা।

সোমবার ঢাকার মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে রোজা উপলক্ষে বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে এফবিসিসিআই আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট পণ্যের ব্যবসায়ীরা।

ছোলা ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই দাম বেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। খেজুর আমদানিকারকরা চান উচ্চ শুল্কের বিষয়টির ফয়সালা।

আগামী মার্চে দেশে রোজা শুরু হবে। এর আগেই নিত্যপণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি নিয়ে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে এফবিসিসিআই।

এতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুল আলম রোজায় ব্যবসায়ীদের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখার অনুরোধ করে তাদের ‘নৈতিকতা’ মেনে ব্যবসা করার কথা বলেন। ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে তিনি বলেছেন, যারা বাজারে কারসাজি করবে তাদের সঙ্গে এফবিসিসিআই নেই।

সভায় ডাল ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে কথা বলেন বিকাশ চন্দ্র সাহা ও নিজাম উদ্দিন নান্নু।

বিকাশ চন্দ্র বলেন, এবার রোজা শুরুর তিন মাস আগেই ছোলা বুটের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এখনই এই দিকে নজর না দিলে রোজায় ভোগান্তিতে পড়তে হবে। কারণ এ খাতও পুরোপুরি গুটি কয়েক বড় ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

“গত সপ্তাহে পাইকারিতে প্রতি কেজি ৭৫ টাকার বুট ৮৩ টাকায় উঠে গেছে। এখন থেকে এই দিকে নজর না দিলে রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।”

ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, এনবিআর শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে এখন আমরা খেজুর আমদানি করতে ভয় পাচ্ছি। অথচ এখনই খেজুর আমদানির সঠিক সময়। সাপ্লাইয়াররা আমাদের বার বার চাপ দিচ্ছে। অথচ শুল্ক নিয়ে এনবিআর থেকে কোনো আশ্বাস পাচ্ছি না।

উচ্চ হারে শুল্ক আরোপের তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, আগে খোলা খেজুরে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা এবং বাক্সভর্তি খেজুরে কেজিতে ৩০ টাকা করে শুল্ক দিতে হত। নতুন নিয়মে খোলা খেজুরে কেজিপ্রতি ৭০ টাকা করে এবং প্যাকেটজাত খেজুরে কেজিতে ১৪৫ টাকা করে শুল্ক দিতে হবে। এত বেশি শুল্ক দিতে গিয়ে খেজুরের যে দাম হবে সেই দামে তা বিক্রি হবে কি না চিন্তায় আছি।

বাজারে মাংসের দাম কমলেও রেঁস্তোরা মালিকদের এখনও আগের দামেই কিনতে হচ্ছে দাবি করে বাংলাদেশ রেঁস্তোরা মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হোসেন বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। মাঝে কিছু দিন কমলেও এখন তা আবার কেজিপ্রতি ১৮০ টাকার উপরে উঠে গেছে। এলপিজি নিয়েও একটা সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে।

কোনো পণ্যের দামেই স্থিতিশীলতা থাকে না। সেজন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সেটির মাধ্যমে কোনো পণ্যের সংকট হলে সঙ্গে সঙ্গেই আমদানি শুরুর পরামর্শ দেন তিনি।

কোল্ড স্টোরেজ মালিক সমিতির প্রতিনিধি ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, সরকার গত মওসুমে এক কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদন হয়েছে বলে যে দাবি করেছে তা সঠিক ছিল না। কৃষি মন্ত্রণালয় ক্রেডিট নেওয়ার জন্য এমন দাবি করেছে।

“আমরা বার বার জানিয়েছিলাম ৭০ লাখ টনের মতো আলু উৎপাদন হয়েছে। পরের পরিস্থিতি সবারই জানা।”

কৃষি উৎপাদনের সঠিক তথ্য পেতে প্রয়োজনে যৌথ জরিপ চালানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগী হয়ে কিছু কিছু পণ্য আমদানি ও মওসুমে কিনে গুদামজাত করতে পারে। গতবার আলুর মওসুমে এক লাখ টন আলু কিনে গুদামজাত করলে সংকটের সময় তারা সেটা বিপণন করে বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থায় ভূমিকা রাখতে পারত।

বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়তদার সমিতির সভাপতি ইমরান বলেন, সব দেশেই চাহিদা বাড়লে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে দাম বৃদ্ধির প্রবণতাটা অনেক বেশি। তবে এবার রোজার সময় শীত মওসুম থাকার কারণে শাক সবজির দাম নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না।

লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল কবির বলেন, দেশে লবণের কোনো সমস্যা নেই। গত কয়েক বছর ধরেই লবণের দাম স্থিতিশীল। তবে সমস্যা হচ্ছে এত বড় জনসংখ্যার দেশে কিছু লবণ রিজার্ভে থাকা উচিত। সেজন্য সরকার চাইলে মিল মালিকদের মাধ্যমে এক মাসের প্রয়োজন মেটানোর মতো লবণ আমদানি করে রাখতে পারে। তাহলে দামটা অস্থিতিশীল হতে পারবে না।

পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয় সব তেলকে বোতলজাত করার উদ্যোগ নিলেও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় তা উচিত হবে না। ২০০ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম করেও অনেকে তেল কেনেন। সেক্ষেত্রে ভোজ্যতেলকে বোতলজাত করার পরিকল্পনা এখনই বাধ্যতামূলক করা ঠিক হবে না।

প্রয়োজনে ভোজ্যতেল মিল মালিকগুলোকে নিজস্ব কোম্পানির তথ্যযুক্ত ড্রামে তেল বিপণন করার পরামর্শ দেন তিনি।

ভোগ্যপণ্যের চাহিদা নিয়ে সরকারি পরিসংখ্যানগত তথ্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, অনেক সময় পরিসংখ্যানের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকে না। গত কয়েক বছর ধরে চিনি ও ভোজ্যতেলের মাসিক চাহিদা বলা হচ্ছে দেড় লাখ টন করে। তাহলে গত কয়েক বছর ধরে কী দেশে জনসংখ্যা বাড়েনি?

সিটি গ্রুপের উপদেষ্টা অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখতে প্রয়োজনে ডলার আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে কিছু কিছু পণ্য আমদানির দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। চিনিতে এখন কেজিতে ৪২ টাকার মতো শুল্ক দিতে হচ্ছে। এই জায়গাটা কমাতে হবে। পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সাপ্লাই নিশ্চিত করতে হবে।

এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের অনুরোধ সাপ্লাই চেইনটা ঠিক রাখেন। কাউকে লোকসান দিতে বলছি না। তবে ব্যবসাটা যেন নৈতিকতা মেনে হয়।

রোজায় জিনিসপত্রের দাম সহনশীল রাখতে সবাই আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিদেশে উৎসবের সময় দাম কমে আসে। আর আমাদের দেশে দাম বাড়তে থাকে। খেজুর, কাঁচামরিচ, বেগুন একেক বাজারে একেক দাম থাকে। পাইকারি খুচরার মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ টাকা পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু সেটা ২০ টাকা হবে কেন? যারা বাজার কারসাজি করবে তাদের সঙ্গে এফবিসিসিআই নেই।

অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।