ফল আমদানির পর বন্দরে ফেলে রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা হলে সেগুলো নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক।
Published : 10 Dec 2023, 10:41 PM
শুল্কায়নমূল্য বাড়িয়ে তিনগুণ করার পাশাপাশি নতুন করে কয়েক স্তরের শুল্কারোপের ফলে খেজুরসহ আমদানি করা ফলের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে বলে দাবি ফল আমদানিকারকদের।
আসন্ন রোজা উপলক্ষে রোববার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আয়োজিত আলোচনা সভায় এমন দাবি বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের।
এমন উচ্চ শুল্কায়নের প্রভাবে আগের রোজায় ১২০ টাকা কেজি দামে যে ‘ধাবাস’ খেজুর পাওয়া যেত, এবার সেটা আড়াইশ টাকারও বেশি দামে কিনতে হতে পারে বলে আভাস দেন তিনি। মাঝারি ও ভালো মানের খেজুরের দামও একই হারে বাড়বে বলে জানান তিনি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান উচ্চশুল্কের বাধা দূর করতে বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্যারিফ কমিশন, এনবিআরসহ অন্যান্য দপ্তরে আবেদন করার পরামর্শ দেন।
দেশে প্রতিবছর রোজার মাসে প্রায় ৬০ হাজার টন খেজুর বেচাকেনা হয়। বছরের বাকি সময়ে বিক্রি হয়ে আরও অন্তত ২০ হাজার কেজি। ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিশিয়া, সৌদি আরব, মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে এসব খেজুর আমদানি করা হয়।
এর আগে খেজুরসহ আমদানি করা ফলের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ে ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর ও চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি দুই দফায় আলোচনা করেছিল ভোক্তা অধিকার। আগের বৈঠকে দেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর পর্যালোচনা ও আসন্ন রোজায় ফল সরবরাহের প্রস্তুতি হিসেবে এদিনের বৈঠক বসে।
ফল ব্যবসায়ীদের নেতা সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার বড় সমস্যা হচ্ছে ফলমূল ও খেজুরের শুল্ক বৃদ্ধি। আগের অর্থবছরে যেসব ফলমূল আমদানি করা হয়েছিল সেখানে কোনো রকম শুল্ক ছিল না। শুধু এআইটি ও এটি ছিল। চলতি বাজেটে ফলমূলকে বিলাসপণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলের ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। আরডি, এআইটি এবং এটি মিলিয়ে এখন উচ্চ শুল্ক দিতে হচ্ছে।
ট্যারিফ মূল্য বা শুল্কায়নমূল্যে বড় একটা পরিবর্তন এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগে বস্তায় করে আনা খেজুরের ক্ষেত্রে অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু ছিল প্রতি টন ৫০০ ডলার; সেটা বাড়িয়ে এক হাজার ডলার করা হয়েছে। আরব আমিরাত, ইরাক, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া থেকে কার্টনে আসা খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু এক হাজার থেকে বাড়িয়ে প্রথমে দুই হাজার ডলার এবং পরে আবার আড়াই হাজার ডলার করা হয়েছে।
তার ভাষ্যে, সৌদি আরব ও মিশর থেকে আসা কার্টনের খেজুরের অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু এক হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার ডলার করা হয়েছে। ফলে প্রতি কেজি খেজুরে ডিউটি দিতে হয় ২৭০ টাকা। মাঝারি মানের খেজুরে যা কেজিতে ১৭০ টাকা। বস্তায় আসা খেজুরে ডিউটি দিতে হচ্ছে কেজিতে ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। বস্তায় আসা এসব খেজুর বিগত দিনে আমরা বিক্রিই করতাম কেজি ৭০ টাকা থেকে ৯০ টাকার মধ্যে।
বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে এ আমদানিকারক বলেন, গত রোজায় টিসিবিকে ভ্যাটসহ ১২৪ টাকা কেজিতে খেজুর দিয়েছিলাম। এখন ডিউটিই দিতে হবে কেজিতে ১৭০ টাকা। তাহলে এখন দাম পড়ে যাবে আড়াইশ টাকা থেকে ৩০০ টাকা প্রতিকেজি।
তার শঙ্কা উচ্চমানের খেজুরের দামও আরও বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে শুল্কায়নের হার উচ্চ হলেও প্রতিবেশী ভারতে শুল্ক পরিস্থিতি খুবই সহনশীল বলে উল্লেখ করেন সিরাজুল। সেখানে শুল্ক গড়ে কেজিতে ৩২ টাকা।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে খেজুরের মূল্য পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বস্তার খেজুরের দাম আছে প্রতিটন ৫০০ থেকে ৬০০ ডলার। কার্টুন খেজুরের দাম আছে ৯০০ ডলার। তিউনিশিয়া থেকে ১২০০ ডলারে খেজুর কিনে এনেছি। কিন্তু এখানে এসে অ্যাসেসমেন্ট ভেল্যু দেখাতে হচ্ছে ৪০০০ ডলার।
তার দাবি, “কাস্টমস কমিশনার স্যার ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করে রাখছে। তাহলে খেজুরটা আনব কীভাবে আর বিক্রি করবো কীভাবে। আমরা তো ভয়ে এলসি করতে পারছি না।
“চীন থেকে যে আপেল আসছে সেখানে কেজিতে ডিউটি পড়ছে ১০০ টাকা। কিন্তু আমি সেটা চীন থেকে কিনে আনছি ৬৫ টাকা কেজিতে। প্রায় ১৫০ শতাংশ ডিউটি দিতে হচ্ছে।”
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, গত বছর প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৯০ থেকে ৯৫ টাকা ছিল। এবছর সেটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ১১০ থেকে ১২৪ টাকার মধ্যে।
আলোচনার শুরুতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান ব্যবসায়ীদের রোজায় সীমিত লাভ করা, মূল্য তালিকা প্রদর্শন, পাকা ভাউচার সংরক্ষণ করা, আমদানি করা প্যাকেটজাত খেজুরের প্যাকেটের গায়ে মূল দেশের নাম, মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখার বাধ্যবাধকতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
তিনি বলেন, প্যাকেট আকারে যেসব খেজুর বাজারজাত করা হবে সেখানে আমদানিকারকের তথ্য থাকতে হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ থাকবে হবে, কোন দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে সেটা থাকতে হবে এবং সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য থাকতে হবে। পাকা ভাউচার বা বেচাকেনার রশিদ নিশ্চিত করতে হবে।
রোজায় খেজুর, মালটা, আপেল, আঙ্গুরের চাহিদা ঠিক রাখতে এখন থেকেই এলসি খোলা শুরুর পরামর্শ দেন তিনি।
প্রয়োজনে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে ফল আমদানির বিশেষ সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হবে বলে জানান তিনি।
“ফল আমদানির পর তা বন্দরে ফেলে রাখলে এবং এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হলে প্রয়োজনে বন্দরে সেগুলো নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হবে,” হুঁশিয়ারি দেন তিনি।