“বাজারে একটা ধারণা ছিল যে দাম বাড়বে, সবাই ভেবেছে, ‘দুইদিন রেখে দেই, তাহলে লাভ হবে’, যে কারণে সংকট বেড়েছে”, বলেন টি কে গ্রুপের পরিচালক।
Published : 10 Dec 2024, 01:43 AM
বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ তলানিতে নামার পর দাম বাড়ানোর ঘোষণা, এরপর দোকানে তেল ফিরতে শুরুর করার তথ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সংকটটা হল কেন?
টানা কয়েকদিন ধরে ছোট-বড় সব বাজার থেকে ভোজ্যতেল উধাও হওয়ার মধ্যে সোমবার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সরকারের তরফে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে।
সরবরাহ সংকটের কারণ হিসেবে বিক্রেতারা বলেছেন, পরিবেশকদের কাছ থেকে পণ্য না পাওয়ার কথা। পরিবেশকরা দায় দিয়েছেন বড় কোম্পানিগুলোকে। তবে কোম্পানির দাবি, তাদের দিক থেকে সংকট ছিল না। সব পক্ষ যখন বুঝেছে দাম বাড়বে, তখন তারা মজুদ করেছে।
তবে বেশ কয়েকদিন ধরেই ক্রেতারা ভুগেছেন। তেল কিনতে দোকান থেকে দোকানে ঘুরতে হয়েছে, বোতল পাওয়া গেলেও বেঁধে দেওয়া সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে কেনা যায়নি, কারণ, বোতলের গায়ে থাকা সর্বোচ্চ মূল্যের ঘোষণা তুলে ফেলে বাড়তি টাকা দাবি করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক শেষে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন তেল বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলোর সমিতি বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার।
লিটার প্রতি ৮ টাকা বেড়ে এখন প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা ঠিক হয়েছে ১৭৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল ও খোলা পাম তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে ১৫৭ টাকা; পাঁচ লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল পাওয়া যাবে ৮৫২ টাকায়।
কেন দাম বেড়েছে, তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, তবে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কেন এমন সংকট, সেই প্রশ্নের জবাব মিলল না।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, গত এপ্রিলে দাম যখন ১৬৭ টাকা দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, তারপর থেকে বিশ্ববাজারে দাম ‘অনেকটাই’ বেড়েছে।
“কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে এখন একটি ‘যৌক্তিক’ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। আর সমস্যা হবে না।”
আমদানি খরচ কত বাড়ল
ভোজ্যতেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার বলেন, “বিশ্ববাজারে প্রতি টন তেলের দাম ১২০০ ডলারে উঠেছে। গত এপ্রিলে সরকার যখন তেলের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল, তখন প্রতি টনের দাম ছিল ১০৩৫ ডলার। এখন আমরা ১১০০ ডলার ধরে লিটারে ৮ টাকা দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়তে থাকার পর গত ১৮ অক্টোবর ভোজ্য তেলের আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ৫ শতাংশ কমানোর পাশাপাশি উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের ভ্যাট পুরোপুরি প্রত্যাহার করে সরকার।
এরপর নভেম্বরে স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে আরও ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে শুধু আমদানিতে ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। এরপরেও কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে বলে, নইলে তাদের লোকসান হচ্ছে।
মোস্তফা হায়দার বলেন, “এক্স বন্ড, ইন বন্ড ভ্যালু এবং গত এক মাসে যে এলসি খোলা হয়েছে, তার ভ্যালু- এই তিনটা ভেল্যু যোগ ও গড় করে একটা দাম ঠিক করতে হয়। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণ খরচ, বোতলজাতকরণ খরচ যোগ করতে হয়। ২০১১ সাল থেকে এই পদ্ধতি চর্চা হয়ে আসছে।”
শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের (সিবিওটি) তথ্যানুযায়ী, গেল চার মাস ধরেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১১০০ ডলারের আশপাশে ছিল।
এখন থেকে মাসে মাসে সরকারের সঙ্গে বসে তেলের দাম ঠিক করা হবে বলেও জানান বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
আমদানি বেড়েছে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে দেশে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১০৬ টনের কিছু বেশি, যা আগের বছরের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৪ হাজার ১৭ মেট্রিক টন বেশি।
এই সময়ে পরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৭৭৬ টনের কিছু বেশি, অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি করা হয়েছে ৩ হাজার ৯৯৯ মেট্রিক টনের কিছু বেশি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “সব রকম তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছি দেশে যে মজুদ রয়েছে- সন্তোষজনক; মজুদে কোনো ঘাটতি নেই। অন্যদিকে ছোট ছোট জায়গা থেকে শুরু করে সব জায়গায় এক ধরনের মজুদদারি তৎপরতা আমরা দেখতে পেয়েছি।”
মজুদদারির তৎপরতার বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার কাজ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকারও স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়টি চিন্তা করেছে।"
বাজার পরিস্থিতি কী?
সোমবার বিকেলে দাম বাড়ানোর ঘোষণা আসার আগে কারওয়ান বাজার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট দেখা গেছে। বেশিরভাগ দোকানেই এক লিটারের বোতল ছিল না, দুই লিটার বা পাঁচ লিটারের বোতলের দাম গায়ের মূল্য থেকে বেশি চেয়েছেন বিক্রেতারা।
তাদের ভাষ্য, গায়ের মূল্যে বিক্রি করলে তাদের লাভ হয় ‘সীমিত’। ডিলাররাও বেশি দাম রাখছেন।
‘শাহমিরান জেনারেল স্টোর’-এর বিক্রেতা মোহাম্মদ সিয়াম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাজারে যখন কোনো কিছুর একটু সাপ্লাই কম থাকে, তখন কাস্টমারের চাহিদা যায় বেড়ে। এই সুযোগে ডিলার আর সরবরাহকারীরা দাম বাড়ায়।
“আর ডিস্ট্রিবিউটররাও তখন ঠিকমতো মাল দিতে চায় না। যদি আমার চাহিদা থাকে ২০ কার্টন, দেয় ২ কার্টন। যার কারণে সংকট দেখা দেয়।”
‘মেসার্স চাটখিল স্টোর’-এর বিক্রেতা মোহাম্মদ রিয়াদ বললেন, “আমাদের যে চাহিদা, সে অনুযায়ী মাল পাচ্ছি না। আর যে দামে দিত, তার থেকে বাড়িয়েছে। আমরাও তাই গায়ের মূল্য থেকে বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।”
‘মেসার্স কুমিল্লা জেনারেল স্টোর’-এর মুজিবুর রহমান বলেন, “আগে ৫ লিটার তেলের বোতল গায়ের রেট থেকে অন্তত ৫০ টাকা কম রাখত ডিলাররা, এখন গায়ের রেট থেকে ৩ থেকে ৪ টাকা কম পাই। তাহলে বেশি না বিক্রি করে উপায় কী?
“তেল দরকার ৫০০ কার্টন, পাই ৫ কার্টন। তাহলে সংকট কাটবে কী করে! ডিলার এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াতে চায়। বাড়ানো গেলেই সংকট কেটে যাবে।”
কারওয়ানবাজারে বিকেলে তেল কিনতে আসা তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা রেহানা বেগম বলেন, “অনেক দোকান ঘুরে এক লিটার তেল পেলাম। দাম রেখেছে ১৭২ টাকা। কিন্তু গায়ের দাম ১৬৭ টাকা।”
দাম বাড়ানোর পর অবশ্য এই সমস্যা কিছুটা কেটেছে বলে সংবাদ মাধ্যমে তথ্য আসছে। তবে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরবরাহ কীভাবে বাড়ল, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন মানুষ।
নিকেতন কাঁচাবাজারের বিক্রেতা শাহ আলম রাতে বলেন, “এখন পর্যন্ত সরবরাহ আগের মতই। কম। তবে যেহেতু দাম সমন্বয় করা হয়েছে, আমার ধারণা দুই-একদিনের মধ্যে সরবরাহ বাড়তে পারে। সংকট কেটে যাবে।”
কী বলছে কোম্পানি?
ব্যবসায়ীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আমদানিকারক ও বিপণনকারী টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার তসলিম সরবরাহ কমানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দাম বাড়ার সঙ্গে সংকটের যোগ আছে আবার যোগ নেই। দাম বাড়ুক আর যাই বাড়ুক, আমাদের সরবরাহ কিন্তু বেশি ছিল।
“যেহেতু বাজারে একটা ধারণা ছিল যে দাম বাড়বে, মোটামুটি সবাই সিওর ছিল, ডিলার পয়েন্ট বলেন, দোকানদার বলেন, সবাই জানত। ফলে, সবাই ভেবেছে, ‘দুইদিন রেখে দেই, তাহলে লাভ হবে’, যে কারণে সংকট বেড়েছে। এর সঙ্গে সরবরাহের ঘাটতি ছিল না।”
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “কারওয়ান বাজারের ডিলারকে যখন আমি বললাম, ‘আপনি তো আগে মাসে তিন গাড়ি মাল নিতেন, আপনি এখন সপ্তাহে তিন গাড়ি চাচ্ছেন কেন?’ বলে, ‘আমার চাহিদা বেড়েছে’। এজন্য সে বলেছে, আমি চেয়েও মাল পাচ্ছি না।”
“কারণ, ‘প্রাইস বাড়বে, দুইদিন রেখে দিই, তাহলে লাভ হবে।”
মন্ত্রণালয়ে সরবরাহের নথিপত্র দেখিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “গত ১৫ দিনের ডেলিভারি কিন্তু আগের চেয়ে সবারই বেশি।”
তিনি বলেন, “এখন যেহেতু অনিশ্চয়তাটা কেটে গেছে, বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থাৎ যে-যে পর্যায়ে কিছু হোল্ড করে থাকুক, দেখবেন কালকেই এগুলো মার্কেটে চলে এসেছে। আমাদের কাছে সংকট ছিল না, থাকবেও না।”
দাম বেঁধে দেওয়া কি যুক্তিযুক্ত?
ভোক্তা অধিকার নিয়ে সোচ্চার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান মনে করেন, সরকারের দাম বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি যুক্তিযুক্ত নয়।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বাজার নিয়ন্ত্রিত হবে সাপ্লাই, ডিমান্ড এবং প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে। সাপ্লাই, ডিমান্ড যদি ঠিক থাকে, আর বাজারে যদি প্রতিযোগিতা থাকে, তাহলে কিন্তু ইচ্ছা করলেও কেউ দাম বাড়াতে পারে না এবং দাম বেঁধে দিলেও এর চেয়ে কম দামেও কিন্তু বিক্রি হতে পারে, যদি প্রতিযোগিতা থাকে।”
প্রতিযোগিতা না থাকলে বেঁধে দেওয়া দামও টিকবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকার তো অনেক কিছুরই দাম বেঁধে দেয়, বাস্তবে সেটার প্রতিফলন হয় না। কারণ, মার্কেট তার নিজস্ব মেকানিজমে চলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের আমদানিকারক হোক, রিফাইনার হোক, প্রডিউসার খুব কমে গেছে, সেটা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই চেষ্টা করতে হবে।”
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়লেও যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে, তখন তা হয় না বলে মন্তব্য করে গোলাম রহমান বলেন, “আমাদের ব্যবসায়ীরা সব সময় সুযোগে থাকে এবং লাভ বাড়াতে চায়। এটাতে কোনো সন্দেহ নাই।
“আমাদের দেশের সবাই আসলে সংকট তৈরি করে দাবি আদায় করে। ধর্মঘট করে দাবি আদায় করে। আবার সংকট তৈরি না হলেও কেউ কোনো সিদ্ধান্তও নেয় না। এটা একেবারে সর্বস্তরে।”