একেবারে যে সীমা থাকছে না তা নয়; সুদের হার ঠিক করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি কত বেশি সুদ নেওয়া যাবে তা বেঁধে দিয়েছে।
Published : 02 Jul 2023, 12:18 AM
বছর তিনেকের বেশি সময় ধরে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়ার যে সুবিধা উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পেয়ে আসছিলেন তাতে ছেদ পড়ছে; কোরবানির ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কার্যদিবস থেকেই বাড়ছে সব ধরনের ব্যাংক ঋণের সুদহার।
রোববার থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ আর থাকছে না, যা সরকারি সিদ্ধান্তে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এতদিন চলে আসছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ মেনে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আর্থিক খাত সংস্কারের শর্তের অংশ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের মুদ্রানীতি অনুসরণ করেই ঋণের সুদহারের সীমা উঠে যাচ্ছে। একেবারে যে সর্বোচ্চ সীমা থাকছে না তা নয়; সুদের হার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করে তা বাজারভিত্তিক করার কথা যেমন বলছে, তেমনি কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কত বেশি সুদ নিতে পারবে তা বেঁধে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২ জুলাই সকালে জুন মাসের ‘স্মার্ট’ (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) এ হার কত তা জানালে ব্যাংকগুলো সেটির সঙ্গে সুদহার সমন্বয় করে নেবে। এমন একটি ‘সুদহার করিডোর’ এর মাধ্যমে ঋণের সুদহার ঠিক করার প্রক্রিয়া বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে মুদ্রানীতিতে।
তবে নতুন সুদহার গ্রাহক পর্যায়ে বাস্তবায়নে মাস খানেক সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। গ্রাহকের সঙ্গে সম্পর্ক এবং নতুন ঋণ দিতে আলোচেনা ও দরকষাকষির মাধ্যমে একটা পর্যায়ে আসতে সময় লাগবে বলে তাদের ধারণা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি) এর সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘কিছু গ্রাহকের পক্ষ থেকে আপত্তি আসতে পারে সুদহার বাড়ানোতে। এটি সমন্বয় করতে ও প্রভাব বুঝতে কিছুটা সময় লাগবে ব্যাংকিং খাতের।’’
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মে মাসের স্মার্ট অনুসরণ করে ব্যাংকের বড় ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হবে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ, ছোট ঋণে তা ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং এনবিএফআই এর বেলায় তা ১২ শতাংশের ঘরে থাকতে হবে।
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণের সুদহার বাড়লে আমানতের সুদহারকে তা আরও ঊর্ধ্বমুখী করবে। বর্তমানে আমানতের বিপরীতে গড় সুদ ৬ শতাংশের ঘরে রয়েছে। তবে তারল্য সংকটে ভুগতে থাকা অনেক ব্যাংক ৮ শতাংশ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে।
সুদহারের বিদ্যমান সীমা তুলে দেওয়ার পেছনে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হারের রাশ টেনে ধরাকে প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগামী ছয় মাসের আঁটসাঁট মূদ্রানীতিতে তেমন ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘মুদ্রানীতি রিভিউ’ প্রতিবেদনে এর আগে বলা হয়, মুদ্রা সংকোচনের নীতিতে সুদহার বাড়িয়ে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশার চেয়েও কমেছে। অর্থনীতিবিদরা যদিও অনেক আগ থেকেই সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন।
অর্থনীতিতে গতি আনতে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে গিয়ে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তিতে যাওয়ার পর ঋণের সর্বোচ্চ সীমার সেই ‘রাজনৈতিক’ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার সময়কাল একটু দ্রুতই হল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে সুদহারের সঙ্গে বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়া এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব করার আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি চালুর সিদ্ধান্তও রোববার থেকে কার্যকর হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য জানিয়েছে বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ প্রকাশ করা হবে না। এখনকার মত মোট রিজার্ভ প্রকাশ করা হবে। অন্যদিকে বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের উপর ছেড়ে দিতে আরও একটু সময় নেওয়ার কথাও জানানো হয়েছে।
যেভাবে নির্ধারণ ঋণের নতুন সুদহার
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের বাজারসুদকে ভিত্তি ধরে একটি রেফারেন্স রেট নির্ণয় করা হবে, যেটির নাম হবে ‘স্মার্ট’।
নতুন ও বিদ্যমান ঋণের বেলায় স্মার্ট এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক।
ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ঋণের সুদহার নির্ধারণ করবে স্মার্ট এর সঙ্গে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদ যোগ করে।
নতুন-পুরনো উভয় ঋণে ‘স্মার্ট’ সুদহার, কার্যকর জুলাইয়ে
‘আঁটসাঁট’ মুদ্রানীতিতে বাড়ল রেপো হার, উঠল সুদহারের সীমা
রেপো হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা মেলেনি: ঢাকা চেম্বার
আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের সুদহার ঠিক করে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক
প্রতি মাসের ১ তারিখে স্মার্ট এর গড় সুদহার জানিয়ে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। মে মাসের স্মার্ট সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এরসঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ যোগ করলে ব্যাংক গ্রাহকের ঋণের সুদহার দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। জুন মাসে যে সুদহার ঘোষণা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
বরাবরের মতো কৃষি ও পল্লী ঋণের সুদহার সাধারণ ঋণের চেয়ে ১ শতাংশ কম হবে। সেক্ষেত্রে ‘স্মাট’ রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ মার্জিন যোগ হবে।
ব্যক্তির ক্ষেত্রে গৃহ ঋণ (জমি-ফ্লাট), ভোক্তা ঋণ (গাড়ি, আসবাব, মোটরসাইকেলসহ কিস্তিতে যেকোনো পণ্য ক্রয়ে নেওয়া ঋণ) এর সুদ ব্যয় বাড়বে।
কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাত ও ভোক্তা ঋণের আওতায় ব্যক্তিগত ঋণ ও গাড়ি ক্রয় এর ক্ষেত্রে ব্যাংক আরও ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ যোগ করতে পারবে। এ চার্জ বছরে সর্বোচ্চ একবার যোগ করা যাবে।
নতুন সুদহার নির্ধারণের জন্য ব্যাংকগুলো স্থির বা পরিবর্তনশীল যেকোনো একটি প্রক্রিয়া গ্রাহকের সম্মতি অনুযায়ী ঠিক করা যাবে। তবে কোনো ব্যাংক ছয় মাসের আগে কোনো গ্রাহকের সুদহার বদলাতে পারবে না। সুদহার বদলের আগে গ্রাহককে অবশ্যই জানাতে হবে।