সামাজিক মাধ্যমসহ সর্বত্র পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে মুনাফাভোগীদের কোণঠাসা করার একটা আওয়াজ ওঠে। সেটির প্রভাব বাজারে পড়তে দেখা গেছে।
Published : 11 Dec 2023, 11:36 PM
অনেকটা রাতারাতি রান্নার অন্যতম অনুষঙ্গ পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে নানামুখী চাপে সেই বাড়তি দাম এক দিনও টিকে থাকেনি। ফলে অনেক খুচরা দোকানি ১৭০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে এনে এখন পড়েছেন বিপাকে।
খুচরায় বিক্রি হচ্ছে কম; এরমধ্যেই পাইকারি ও আড়তে পেঁয়াজের চড়া বাজারও পড়তে শুরু করেছে। শনিবার বাজার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার দুই দিনের মাথায় খোঁজ নিয়ে সোমবার এমন চিত্র দেখা গেছে।
অনেকেই বলছেন, পণ্যের সংকটের সময় ভোক্তারা আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা থেকে কেনাকাটা বাড়িয়ে দেন, যা এবারও পেঁয়াজের ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে এক দিনের ব্যবধানেই ঘুরে গেছে এবারের কেনাকাটার প্রবণতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে মুনাফাভোগীদের কোণঠাসা করার একটা আওয়াজ ওঠে। সেটির প্রভাব যে বাজারে পড়তে শুরু করেছে তা সোমবার ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে লক্ষ্য করা গেছে।
এর সঙ্গে ভোক্তা অধিকার ও জেলা প্রশাসনের দেশজুড়ে অভিযানে তেঁতে ওঠা পেঁয়াজের বাজারে ঝাঁজ আর তীব্র হয়নি। ফলে বাড়তি লাভের আশায় বেশি দরে কিনে এনে খুচরা বিক্রেতারা এখন আসল তোলার চাপে পড়েছেন। অন্যদিকে অভিযানের মুখে পাইকারি ক্রেতারাও অস্বস্তিতে পড়েছেন।
নিজেদের অভ্যন্তরীণ বাজার ঠিক রাখতে প্রথমে প্রতিটনে ৮০০ ডলার রপ্তানিমূল্য বেঁধে দেওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয় উপমহাদেশে পেঁয়াজের প্রধান যোগানদাতা ভারত। এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাত থেকেই আড়তে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দর। শুক্র ও শনিবার সকালের মধ্যেই পাল্লা দিয়ে খুচরায় দাম বাড়তে বাড়তে ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
মওসুমের শেষ দিকে দেশি পেঁয়াজের জোগান কমে আসায় গত এক মাস ধরে পেঁয়াজের বাজার ছিল ভারতীয় আমদানির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের ৯ তারিখ পর্যন্ত সময়ে পাঁচ লাখ ৭১ হাজার ৫৩৪ টন পেঁয়াজ বাংলাদেশে এসেছে, যার অধিকাংশই এসেছে শেষ তিন মাসে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, ভারত আমদানি বন্ধ করলেও মওসুমের এই পর্যায়ে মুড়িকাটা ও আগাম মওসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করেছে। আগামী তিন মাসে প্রায় আট লাখ টন এমন পেঁয়াজের যোগান পাওয়া যাবে। এগুলো শেষ হতে না হতেই চলে আসবে মওসুমের মূল পেঁয়াজ।
নিয়মিত বাজারে দাম কমা-বাড়ার খবরাখবর রাখেন এমন লোকজনের ধারণা, ভারত এখন যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সেটা অক্টোবর, নভেম্বরের দিকে নিলে বাজারে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তো। এখন পেঁয়াজের বাজার হঠাৎ করে বেড়ে গেলেও সেটা স্থায়ী হবে না, ধীরে ধীরে কমে আসবেই। কারণ, বাজারে নতুন মওসুমের পেঁয়াজ চলে এসেছে।
দাম কমছে যেসব কারণে
দাম আরও বেড়ে যাবে এমন আশঙ্কা থেকে শুক্রবার অধিক কেনাকাটার ফলে শনি, রবি ও সোমবার বাজারে পেঁয়াজের ক্রেতা ছিল খুবই কম। আবার অতি মুনাফার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একযোগে অভিযান শুরু করে দুই দিনে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করেছে।
কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করতে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান কেনা রসিদ দেখাতে পারেনি। আবার অনেকে গুদামে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে ভালো লাভের আশায় পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রাখতে গিয়ে ধরা খেয়েছে।
পণ্যের সংকটের সময় ভোক্তারা আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা থেকে কেনাকাটা বাড়িয়ে দেন যা এবার পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও হয়েছে। তবে এক দিনের ব্যবধানেই ঘুরে গেছে এবারের কেনাকাটার প্রবণতা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে মুনাফাভোগীদের কোণঠাসা করার আওয়াজ ওঠে। এর প্রভাব যে বাজারে পড়তে শুরু করেছে তা সোমবার ঢাকার বিভিন্ন বাজার ঘুরে লক্ষ্য করা গেছে।
মিরপুর বড়বাগ কাঁচাবাজারের মুদি দোকানি সিরাজুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার দোকান খোলার পর দেখি মানুষজন ২/৩ কেজি করে পেঁয়াজ কিনে নিচ্ছে। সেদিন দেড়শ টাকা করে বিক্রি করেছিলাম। বিকালে কিনতে গিয়ে দেখি পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের কেজি ১৭০ টাকা। এখন গত তিন দিনে এক বস্তা পেঁয়াজও বিক্রি হয়নি। মানুষজন আধাকেজি, আড়াইশ গ্রাম করে পেঁয়াজ কিনছে।
একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন পীরেরবাগের দোকনি ফেরদৌস আলম। গত শুক্রবার ১৭০ টাকা করে পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ কেনার পর এখন তিনি ১৭০ টাকা করেও বিক্রি করতে পারছেন না।
ফেরদৌস বলেন, লোকজন এসে দাম শুনে চলে যায়। কেউ কিনলেও আধাকেজি, এককেজির বেশি নয়। বাজারে নতুন যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ এসেছে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০০ টাকায়, ১২০ টাকায়।
ফেরদৌসের পাশে শাহাদাত নামের এক মুদি দোকানি বলেন, কাস্টমারের আচরণ এটা নতুন কিছু নয়। শুক্রবার অনেক রেগুলোর কাস্টমার ফোন করে পাঁচ কেজি করে পেঁয়াজ কিনে নিয়ে গেছেন। তখন আর অত বেশি দাম রাখতে পারি নাই। কেজি ১০০ টাকায় কেনা পেঁয়াজ হয়তো সর্বোচ্চ ১৩০ টাকা রেখেছি। এখন পাইকারিতে কিনতে গেলেও লাগে ১৫০ টাকা। এদিকে ক্রেতাও গেছে কমে। সব মিলিয়ে একটা অস্থির অবস্থা।
ঢাকার আগারগাঁওয়ের গৃহিণী সাদিয়া বিনতে সিদ্দিকী জানান, দাম বাড়ার পর আর পেঁয়াজ কেনা হয়নি। সবজি বাজারে গাছসহ যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে দুই দিন চালিয়ে দিয়েছেন। বাসায় আগের কিছু পেঁয়াজ আছে। পেঁয়াজের ব্যবহার একটু কমিয়ে দিলে দাম আগের জায়গায় ফিরে আসবে। তাছাড়া নতুন পেঁয়াজও বাজারে এসে গেছে।
এদিকে পেঁয়াজের দাম আকস্মিকভাবে অস্বাভাবিক বাড়ানোর প্রতিবাদে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেক রাঁধুনিকে সরব হতে দেখা গেছে। তাদের অধিকাংশই রান্নায় পেঁয়াজ বয়কট করে বাজারে প্রভাব ফেলার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
রোববার সকালে তাহেরা বিনতে ইসলাম সুমনা নামের একজন লিখেন, আমি রান্নায় পেঁয়াজ বয়কট করলাম। বিভা ইন্দু নামের নেটিজানের বক্তব্য হচ্ছে, মার্চ পর্যন্ত একটি পেঁয়াজও কেনা থেকে বিরত থাকুন।
অনেকে পেঁয়াজ বয়কটের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইভেন্ট চালু করে সেখানে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছেন, যার প্রভাব বাজারে পড়েছেন বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
শ্যামপুর পাইকারি বাজারের বিক্রেতা ইন্দ্রিস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভারত থেকে রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় মাঝে এক দিনের জন্য পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজি ১৬০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। এখন আবার দামটা কমে এসেছে। আজকে ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতিকেজি ১২০ টাকা থেকে ১৩০ টাকায় এবং দেশি মুড়িকাটা পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রোববার রাতে পাড়া মহল্লার বিভিন্ন ভ্যানে ও দোকানে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি ১৫০ টাকায়। ভ্যানের বিক্রেতারা সাধারণত দিনে কিনে দিনেই বিক্রি করে শেষ করেন।
এছাড়া সোমবার ভ্যানে ফেরি করে সবজি বিক্রেতারা প্রতিকেজি ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকায় মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন।
আরও পড়ুন:
হবিগঞ্জে একসঙ্গে ১ কেজির বেশি পেঁয়াজ বিক্রি নিষেধ
পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা, প্রতিবাদে কৃষকদের পথ অবরোধ
দুই দিনে চট্টগ্রাম বন্দরে পেঁয়াজ এসেছে ২২৬ টন
পেঁয়াজে ঝাঁজ: সীমান্তের আমদানিকারকদের ‘দুষলেন’ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা
পেঁয়াজের বাজার চড়ল এক দিনেই, কোথাও কেজি ২২০ টাকা