সরকারের চার উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে সিদ্ধান্তের কথা জানাবে রপ্তানি খাতের সবচেয়ে বড় সংগঠনটি।
Published : 24 Sep 2024, 03:26 AM
পোশাক খাতের শ্রমিকদের ১৮ দফার মধ্যে মজুরি এবং বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ‘ইনক্রিমেন্ট’ বাড়ানোর দাবি কোনোভাবেই না মানার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ।
গাজীপুর ও আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে সোমবার সন্ধ্যায় সংগঠনের উত্তরা কার্যালয়ে ‘বিশেষ সাধারণ সভায়’ এমন সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠনটি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সদস্যদের মতামত জানতে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ এ সভা ডাকে।
বিশেষ সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তটি মঙ্গলবার অনুষ্ঠিতব্য শ্রম মন্ত্রণালয়ে সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের চার উপদেষ্টাকে জানাবে রপ্তানি খাতের সংগঠনটি।
বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বলেন, ‘‘সভায় উপস্থিত সদস্যরা একমত হয়েছেন নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি ও বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনা হবে না।’’
তার অভিযোগ, শ্রমিকদের নামে বিভিন্ন ফেডারেশন ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ১৮ দফা দাবি তুলেছে।
এর আগে এদিন দুপুরে শ্রম অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে ‘গার্মেন্টস শিল্প সেক্টরে সৃষ্ট শ্রম অসন্তোষ বিষয়ক শ্রমিক ও মালিক প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে সভা’ হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। সেখানে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএ সভাপতিসহ উদ্যোক্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে ১৮টি দাবি কারখানা মালিকদের কাছে তুলে ধরা হয়। মন্ত্রণালয়ের জিজ্ঞাসায় বিজিএমইএ নেতারা বলেন, সদস্যদের মতামত নিয়ে তারা সিদ্ধান্ত জানাবেন।
শ্রমিকদের দাবি সংক্রান্ত ১৮টি বিষয় গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বিজিএমইএকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল শ্রম মন্ত্রণালয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে জরুরি সাধারণ সভা ডেকেছিল বিজিএমইএ।
সাড়ে ৫টায় শুরু হয়ে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত চলা এ সভায় বর্তমান নেতৃত্ব ও ঢাকার আশুলিয়া থেকে আসা কারখানা মালিকরা কথা বলেন।
রপ্তানি বাণিজ্য আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি অবদান রাখা তৈরি পোশাক খাতে বেতন ও শ্রম অধিকারের নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রায় এক মাস ধরে আন্দোলন চলছে ঢাকার সাভার ও গাজীপুরের শিল্প এলাকার কারখানায়।
মাঝে কয়েকদিন বন্ধ থাকলেও গত দুই দিন ধরে গাজীপুর ও আশুলিয়ায় আবার অনেক কারখানায় আন্দোলনে নেমেছে শ্রমিকরা। আন্দোলন বন্ধ থাকার সময়ে শতাধিক কারখানা বন্ধ ছিল বকেয়া বেতন ইস্যুতে।
সোমবারও আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানা দুপুরের পর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ‘নো ওয়ার্ক, নো পে (কাজ নেই মজুরি নেই)’।
সকালে সাভারের আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে বকেয়া বেতনের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে একটি তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। এর জের ধরে ৫১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, যার মধ্যে ৪৩টি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। আটটি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।
শুরুতে বেতন পরিশোধ ও টিফিন ভাতা দেওয়াসহ আরও কয়েকটি বিষয়ে শ্রমিকদের দাবি ঘুরপাক খেলেও এখন তাতে যোগ হয়েছে ১৮ দফা।
‘দাবিগুলো শ্রমিকদের নয়’
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রেদওয়ান আহমেদ বলেন, ‘‘সমস্যাটি শুরু হয়েছিল নাসা গ্রুপ থেকে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে, মহা ডাকাতি করে ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদে। এখন তিনি বিদেশে বা গোপনে আছেন, কই আছেন তা জানিনা।
‘‘শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে শ্রম অসন্তোষ করছেন। সমস্যা তো সামলানো গেছিল, শুরুতেই ওখানে হাত দিলে এত বড় হত না। এখন নজরুলরা কোটি কোটি টাকা ঢালছেন শ্রমিকদের পেছনে ভাঙচুর করতে, কারখানা বন্ধ করতে। সরকার ও শিল্পকে ধ্বংস করতে।’’
শ্রমিকদের নামে দেওয়া দাবিগুলো কোনো শ্রমিকদের নয় জানিয়ে প্যাট্রিয়ট গ্রুপের ইমরান বলেন, ‘‘গত ডিসেম্বরে নতুন মজুরি হার বাস্তবায়ন করেছি। নতুন বেতন, বোনাস চালু করেছি। সরকার বদল হওয়ায় ৯ মাস পরে কেনো এখন আবার কেনো মজুরি হার বাড়ানো হবে।
‘‘এখন কেনো নতুন দাবি উঠেছে আমাদের বিপদে ফেলানোর জন্য। হাজিরা বেতন ও মাতৃত্বকালীন ভাতা দেয়ার যায়। কালো ছায়া দেখতে পাচ্ছি গার্মেন্টস খাতে। গার্মেন্টস যদি ধ্বংস হয় তাহলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।’’
আদি এপারেলসের উদ্যোক্তা মোস্তফা মনোয়ার বলেন, ‘‘অর্থনীতির অন্য খাতগুলোতেও শ্রমিক আছে। সেখানে কোনো শ্রম অধিকার নিয়ে কথা হয় না। শুধু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে হয়। এখানে বৈষম্য হচ্ছে।
‘‘আমরা ফ্যাক্টরি দিয়ে বিপদে পড়ে গেছি। স্থানীয় চাঁদাবাজদের দিয়ে চলতে হয়। শ্রম আইন সংশোধন করা দরকার। এখানেও সমস্যা আছে।’’
এআর জিনসের উদ্যোক্তা নাজমুল কবির বলেন, ‘‘গত ডিসেম্বরে বেতন ৮ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা করে আগের সরকার চাপিয়ে দিয়েছে। আমরা বলেছিলাম, ১০ হাজার টাকা করার। এত চাহিদাও ছিল না। কিন্তু সরকার আমাদের উপর চাপিয়ে দিল।’’
রাজনীতিমুক্ত বিজিএমই দাবি
এমবিএম এর পরিচালক কামরান সাদেক বলেন, ‘‘মোট ১৮টা ইস্যুর মধ্যে ১১টাতে অর্থ সংশ্লিষ্টতা নেই। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এটি মেনে নেওয়া যাবে বলে মনে করি। আলোচনা করেই করা যায়। বাকি বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন। আমাদের পক্ষে থেকেও দাবি করা যায়।’’
মালিকপক্ষের পক্ষ থেকেও দাবি তুলে ধরে শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতা করার পরামর্শ দেন তিনি।
মোটেক ফ্যাশনের মাসুদ কবির বলেন, ‘‘বিজিএমইএ তার সক্ষমতা হারিয়েছে। নখ, দন্তহীন হয়ে যাচ্ছে। নেতৃত্বের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’’
সিএসলি নিট কম্পোজিটের হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘বিজিএমইএ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ফলপ্রসু কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। ছোট বাচ্চাদের উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যবসার কিছুই বুঝে না। দাবিগুলো শ্রমিক ফেডারেশনের ইন্ধনে হচ্ছে। এগুলো দাবি কোনো শ্রমিকের না।’’
ডেনিম এপারেল লিমিটেডের হেলাল আহমেদ বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীদের চোর বলা হচ্ছে, বিজিএমইএ তার প্রতিবাদ করেনি। বিজিএমইএকে বলব, কোমরটা শক্ত করেন।’’
ইউরোজোনের পরিচালক মর্তুজা খান বলেন, ‘‘বিজিএমএই রাজনীতিমুক্ত হওয়া উচিত। এটিকে কোনো রাজনৈতিক দলের হওয়া উচিত না। আগে রাজনীতি ছিল না, মালিকরা রাজনীতি করতে বিজিএমইএকে ব্যবহার করে এমপি, মন্ত্রী হয়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘এখন বিজিএমইএর গুরুত্ব নাই। আমাদের সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে হবে। রাজনীতিমুক্ত বিজিএমইএ তা পারবে। আলোচনার আয়োজন করেন, কারখানা মালিকদেরও দোষ কম না। আমরা আলোচনা করেই অনেক কিছু ঠিক করতে পারি।’’
সভায় বিজিএমইএ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, ডে-কেয়ার সেন্টার, মাতৃত্বাকালীন ছুটি, হাজিরা বোনাস ও টিফিন ভাতাসহ বাকি সবগুলো দাবি আলোচনা করে পূরণ করা সম্ভব। চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মত দাবিগুলোতে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
পোশাক খাতে এমন অবস্থার মধ্যে এর আগে সবশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা উপস্থিতিতে পোশাক খাতের উদ্যোক্তা, শ্রমিক প্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সভা করেছিল বিজিএমইএ।
তারও আগে ৪ সেপ্টেম্বরও একটি সভা করেছিল। এসব সভার পরে কারখানা সচল হওয়ার সংখ্যা বেড়েছিল, অনেক কারখানার বেতনও পরিশোধ হয়।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ গত ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৯ শতাংশ কারখানা খোলা ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে।
কারখানা বন্ধের সংখ্যা ছিল ৩০টি আর গত অগাস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করেছে এমন কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ৩৩টি বা ৯৫ শতাংশ। আর বেতন দিতে পারেনি ১১১টি কারখানা বা ৫ শতাংশ।
শ্রম অসন্তোষের কারণে ইতোমধ্যে ১০-১৫ শতাংশ সম্ভ্যাব্য রপ্তানি আদেশ হারিয়েছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলে জানিয়েছেন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
শ্রমিকদের ১৮ দফা
১. মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনপূর্বক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ
২. যে সকল কারখানায় ২০২৩ সালে সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ও এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি তা দ্রুত বাস্তবায়ন
৩. শ্রম আইন সংশোধন করতে হবে
৪. কোনো শ্রমিকের চাকরি ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর চাকরি থেকে অব্যাহতি দিলে/চাকরিচ্যুত হলে একটি বেসিকের সমান অর্থ প্রদান করতে হবে, এর সাথে সাংঘর্ষিক শ্রম আইনের ২৭ ধারাসহ অন্যান্য ধারাসমূহ সংশোধন
৫. সকল প্রকার বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ
৬. হাজিরা বোনাস (২২৫ টাকা), টিফিন বিল (৫০ টাকা), নাইট বিল (১০০ টাকা) সকল কারখানায় সমান হারে বাড়াতে হবে
৭. সকল কারখানায় প্রভিডেন্ড ফান্ড ব্যবস্থা চালু
৮. বেতনের বিপরীতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ন্যূনতম ১০ শতাংশ করা
৯. শ্রমিকদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা চালু
১০. বিজিএমইএ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করা যাবে না; বায়োমেট্রিক তালিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। (বায়োমেট্রিক হল আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে কারখানায় প্রবেশাধিকার। আঙ্গুলের ছাপ গ্রহণ না করলে কারখানায় প্রবেশ করতে পারেন না কর্মীরা।)
১১. সকল প্রকার হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার
১২. ঝুট ব্যবসার আধিপত্য বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ
১৩. কলকারখানায় বৈষম্যবিহীন নিয়োগ প্রদান করতে হবে (নারী-পুরুষ সমান হারে নিয়োগ)
১৪. জুলাই বিপ্লবে ‘শহীদ’ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত
১৫. রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কল্যাণে তদন্তান্তে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ
১৬. শ্রম আইন অনুযায়ী সকল কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন
১৭. অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ ও
১৮. নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ ১২০ দিন নির্ধারণ
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় সড়ক অবরোধ করে শ্রমিক বিক্ষোভ, ৫১ কারখানা বন্ধ