নির্বাচন কমিশন বলছে, অনলাইনে ‘অপপ্রচার’ ঠেকানোর কাজটি জটিল। এখনও বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।
Published : 30 Nov 2023, 12:27 AM
যে কোনো দেশেই এখন নির্বাচন এলে সোশাল মিডিয়া হয়ে ওঠে মাথাব্যথার বড় কারণ। বাংলাদেশও যে সে বাস্তবতার বাইরে নয়, নির্বাচন কমিশন তা মানে। তবে ভোট সামনে রেখে সোশাল মিডিয়ায় গুজব, অপপ্রচার বা অবৈধ প্রচার ঠেকাতে কোনো উদ্যোগ এখনও নেই।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ‘গুজব ও অপপ্রচার’ প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তদারকিতে একটি টিম করেছিল ইসি। সার্বক্ষণিক নজরদারির নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। তবে এবার তফসিল ঘোষণার পর সপ্তাহ পেরোলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সাংবিধানিক সংস্থাটি।
নির্বাচন ঘিরে সংঘাত-সহিংতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে কাজ করে। কিন্তু অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানো বা উসকানি ঠেকানোর কাজটি সহজ নয়। ভোটের সময় এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সুপারিশ এসেছে। গেল অগাস্টে ফেইসবুকের মালিক মেটার সঙ্গে বৈঠকও করেছে ইসি। কিন্তু এরপর আর আলোচনা এগোয়নি।
ইন্টারনেটে ‘অপপ্রচারমূলক কন্টেন্ট’ শনাক্ত করার প্রক্রিয়া ‘বেশ জটিল’ বলে মনে করেন ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখনও এ বিষয়ে কমিশনে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামীতে কোনো সভায় এ নিয়ে আলোচনা হলে পরবর্তী পদক্ষেপ জানানো সম্ভব হবে।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে ৭ জানুয়ারি। মনোনয়ন জমার শেষ দিন ৩০ নভেম্বর; বাছাই ১-৪ ডিসেম্বর ও প্রত্যাহারের শেষ সময় ১৭ ডিসেম্বর। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক পেয়ে প্রচার শুরু হবে, যা চলবে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত।
ইতোমধ্যে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকে আগাম প্রচারে পোস্টার-ব্যানার লাগিয়েছেন। সেগুলো নিজ খরচে সরাতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিয়ম ভেঙে সোশাল মিডিয়ায় যে প্রচার চলছে, তা আটকানোর কোনো পথ জানা নেই ইসির।
মেটার আগ্রহে ‘অপপ্রচার ঠেকাতে’ গত অগাস্টে ইসি সচিবালয় বৈঠক হয়েছিল। সেসময় ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেছিলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ইসির সহায়তায় মেটা তাদের কার্যক্রম শুরু করবে। ইসির কাছে যেটা নেতিবাচক মনে হবে, সেটা জানালে তারা সরিয়ে ফেলবে। শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন কনটেন্টের ক্ষেত্রেই এমন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সেই উদ্যোগের অগ্রগতি জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোশাল মিডিয়ায় অপপ্রচারমূলক কন্টেন্ট শনাক্ত করাও বেশ জটিল। বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক ‘অপপ্রচারমূলক’ শব্দগুলো বাছাই করে তাদেরকে জানাতে হবে। আবার যারা এ ধরনের কন্টেন্ট করে, তারাও শব্দগুলো যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধরা না পড়ে সে বিষয়ে পটু।
“মেটা আমাদের সঙ্গে তাদের আগ্রহেই বসেছিল। এখন তো আর এ নিয়ে আলোচনা হয়নি তাদের সঙ্গে। নির্বাচন কমিশন এখনও এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। সামনে আলোচনা হলে এ নিয়ে আপডেট জানাতে পারব।”
এবার তফসিল ঘোষণার আগে ১ নভেম্বরের আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় গুজব প্রতিরোধে ‘নির্বাচনে দিন’ ফেইসবুক বন্ধ রাখার একটি সুপারিশ আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির অতিরিক্ত সচিব বলেন, “মেটার বিষয়ে তো আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। তাদের গ্রাহকদের কথা বিবেচনা করবে তারা। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় যে কোনো প্রস্তাব আসতে পারে, সুপারিশ করতে পারেন যে কেউ। ভোটের দিনে এ ধরনের (ফেইসবুক বন্ধ রাখা) বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।”
তবে ইসি কর্মকর্তারা জানান, ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে প্রচার শুরুর পর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা, বিভিন্ন সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ সভা হতে পারে। তখন সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
ভোটের দিনে ইন্টারনেট সেবা
ভোটের সময় মোবাইল সেবায় ‘বিঘ্ন’ ঘটলে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তার প্রত্যাশা, ‘সরকারও বিষয়টা বুঝবে’।
আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সাংবাদিক নীতিমালা নিয়ে গত ১৩ মার্চ সিইসি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় ভোটের দিন মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট সেবায় নানা ধরনের বিঘ্ন ঘটার অভিজ্ঞতার কথা উঠে আসে। ইন্টারনেটের ধীরগতি ও মোবাইল নেটওয়ার্ক জটিলতায় তাৎক্ষণিক তথ্য পেতে বিলম্ব হওয়া এবং যোগাযোগ বিড়ম্বনার কথা জানানো হয়।
সিইসি তখন বলেন, “এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে যেন ‘সন্দেহের সৃষ্টি না হয়’ সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে; স্বচ্ছতার বিষয়ে জোর দিতে হবে।”
ভোটের সময় নেটওয়ার্ক জটিলতা কে তৈরি করে, সে বিষয়ে তিনি ‘অবগত নন’ বলে দাবি করেন সিইসি।
তার ভাষ্য, “নেটওয়ার্ক স্লো… এটাকে অপকৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয় কিনা, সরকারের অনুধাবন করা উচিত। সরকারের কাছে এ বক্তব্য যে কেউ করতে পারে- নির্বাচনে এ জিনিসগুলো না করাই বোধ হয় ভালো হবে। তাহলে সন্দেহের উদ্রেক হবে।”
শুক্রবার মৌলভীবাজারে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, ভোটের দিন মোবাইল নেটওয়ার্ক স্বাভাবিক রাখতে বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ।
অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ যেন অপপ্রচার বা গুজব না ছড়ায় সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চান তিনি।
এ নির্বাচন কমিশনার বলেন, “অনিবন্ধিত অনলাইন, আইপিটিভির পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও রয়েছে। তাতে যেন মিথ্যা ও অপপ্রচারমূলক কোনো তথ্য প্রচার না করা হয়। অবাধ তথ্য প্রবাহে আমরা বিশ্বাসী। কাজেই নির্বাচনের দিন মোবাইল নেটওয়ার্কগুলো যেন স্বাভাবিক থাকে, সেজন্য সরকারের কাছে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
গত নির্বাচনেও ছিল নজরদারি
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোবাইল ফোন অপারেটর, টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের সঙ্গে এক দফা বৈঠক করে তখনকার নির্বাচন কমিশন। পরে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গেও আলোচনা করে।
বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি থাকলেও নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রচার শুরুর এক সপ্তাহ পর ১৯ ডিসেম্বর থেকে সোশাল মিডিয়া মনিটরিংয়ে একটি কমিটিও করে।
তদরকি দলের প্রধান হিসেবে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ছাড়াও পুলিশ হেড কোয়ার্টার, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ, র্যাব, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), বিটিআরসি এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) থেকে একজন করে প্রতিনিধি এবং নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে করা হয় টিম।
তখনকার ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, সোশাল মিডিয়া কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না বলে মত দেয় বিটিআরসি। তবে যারা গুজব ছড়াবে, সহিংসতা ও অপপ্রচার ছড়াবে তাদের বিষয়ে এনটিএমসি, বিটিআরসি ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিট মনিটরিং করবে।
‘চ্যালেঞ্জ’ দেখছেন তথ্যমন্ত্রী
মঙ্গলবার সচিবালয়ের তথ্য অধিদপ্তরে ‘গুজব প্রতিরোধ সেল এবং ফ্যাক্টস চেকিং কমিটির’ সঙ্গে বৈঠক শেষে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, দেশে যখন কেউ গুজব রটায়, তখন তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা যদি আইসিটি অ্যাক্টে হয়, তখন আবার পত্রিকায় প্রশ্ন করে কেন মামলা হল।
“গুজবটাতো অনলাইনেই ছড়ানো হয় বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম; সেটি তো ডিজিটাল মাধ্যম। ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব ছড়ালে তো ডিজিটাল আইনেই মামলা হবে। কিন্তু সে মামলা করলে তখন আবার অনেকে বলে, আবার কেউ কেউ চেঁচামেচি করে কেন মামলা হল, এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রেপ্তার করলে তো সেটি নিয়ে আরও বেশি কথাবার্তা হয়, সে কী করেছে সেটি তখন ঢাকা পড়ে যায়।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনতে নতুন আইন করা হবে বলে জানান তিনি।
গেল জানুয়ারিতে ডিসি সম্মেলনে অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল, আইপিটিভি ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়ানোর ব্যাপারে জেলা প্রশাসকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেন তথ্যমন্ত্রী।
ডিসিদের সঙ্গে সভার পর মন্ত্রী বলেন, “দেখা যায় জেলাপর্যায়ে অনেকগুলো অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল, আপিটিভি আছে, ইউটিউব আছে; সেখানে যারা কাজ করে তারা আবার নিজেদের সাংবাদিক বলে পরিচয় দেন। এসব প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ভুল-গুজব-বিভ্রান্তি ছড়ায়৷ এটি বড় চ্যালেঞ্জ।”
আইপিটিভি বা অনলাইনে গুজবের বিরুদ্ধে ডিসিদের পদক্ষেপ কেমন হবে- এমন প্রশ্নে হাছান মাহমুদ বলেন, “তারা চাইলেই ব্যবস্থা নিতে পারে না, প্রক্রিয়া আছে। বিটিআরসিকে জানাতে হয়। মনে রাখতে হবে- গুজব ছড়ায় দ্রুত, কিন্তু ব্যবস্থা নিতে অনেক সময় লাগে।”
আরও পড়ুন-
ফেসবুক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক ইসির
ভোটের সময় ফেইসবুকে অপপ্রচার ঠেকাতে ইসিকে ‘সহযোগিতা দেবে’ মেটা
ভোটের সময় মোবাইল সেবায় ‘বিঘ্ন’ জনমনে সন্দেহ জাগায়: সিইসি
সামাজিক মাধ্যম তদারকিতে ইসির ৮ সদস্যের টিম
দেশে ফেইসবুক-ইউটিউবকে নিবন্ধনে আনতে আইন হবে: তথ্যমন্ত্রী
সোশাল মিডিয়ায় সার্বক্ষণিক নজরদারির নির্দেশ ইসির
অনিবন্ধিত পোর্টাল ও আইপিটিভির ‘গুজব’ বড় চ্যালেঞ্জ: তথ্যমন্ত্রী