“আজ পর্যন্ত শুনিনি এসব কোন ঘটনার দায় নির্ণয় করা হয়েছে। এ রকম করে তো চলতে পারে না”, বলেন একজন অধিকার কর্মী।
Published : 08 Apr 2024, 01:36 AM
বাড়িঘরে গ্যাসের আগুন আর বিস্ফোরণে শত শত মানুষের ঝলসে যাওয়া, একের পর এক মৃত্যু আর সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরও কারণ অনুসন্ধান করে সেগুলো ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, সিলিন্ডার ভর্তি গ্যাস ব্যবহার করতে গিয়েই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা থেকে বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জেনেছেন, পাইপলাইনের সংযোগ আছে, এমন বাড়িতেও আগুনের ঘটনা ঘটছে।
সিলিন্ডার বাজারজাতকারীদের দাবি, ব্যবহারকারীদের সচেতন হতে হবে। আবার তারাই সিলিন্ডার বিপণনের পদে পদে অবহেলা এবং অবৈধ গ্যাস রিফিল কারখানার কথা বলছেন।
তারা বলছেন, সিলিন্ডারগুলো নিরাপদ, তবে এগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হোসপাইপ, রেগুলেটর, ক্লাম্পসহ সামগ্রীগুলো মানসম্মত কিনা, সেটা তাদের পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব না।
তাহলে সেটা কারা করবে? সেই প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। অথচ এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলছেন, তিন কোটির বেশি সিলিন্ডার এই মুহূর্তে বাজারে আছে।
প্রতিটি গ্যাসের আগুনের পর ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে একটা প্রতিবেদন দেয়। বড় ঘটনা ঘটলে সরকারি আরেক সংস্থা বিস্ফোরণ পরিদপ্তরও তদন্ত করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ ঘটনাতেই সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দায় নির্ণয় করা হয় না।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, “প্রয়োজন ব্যবহারকারীদের সতর্কতার।”
এই কর্মকর্তার ভাষ্য, বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে গ্যাস লিকেজ থেকে। এ বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে তারা বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছেন।
সিলিন্ডার বাজারজাতকারীদের সমিতি এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেছেন, তারাও পরিবেশক থেকে শুরু করে গ্রাহক পর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করবেন।
কিন্তু বাস্তবতা হল, গ্যাস থেকে অগ্নি দুর্ঘটনা থামছে না। ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসক বলেছেন, তারা আগের চেয়ে বেশি রোগী পাচ্ছেন।
গত এক মাসে এই হাসপাতালে আসা ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যারা গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। এত বেশি মৃত্যুর কারণ গাজীপুর ও ধামরাইয়ের দুটি ঘটনা।
তবে মাঝেমধ্যেই গ্যাসের কারণে আগুনে এক বা একাধিক মানুষের হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। হাসপাতালের চিকিৎসায় বেঁচে ফিরলেও ভুগতে হয় মানুষকে।
পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় শহুরে পরিবারগুলো ফ্ল্যাট বাড়িতে বাস করছে। লাকড়ির চুলার কোনো সুযোগ নেই, বিদ্যুৎ সংকটের এই সময়ে বৈদ্যুতিক চুলা ব্যবহার নির্ভরযোগ্য বা সাশ্রয়ী হয় না।
ফলে গ্যাসের চুলার কোনো বিকল্প এসব পরিবারের নেই। আর বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলে রান্নার জ্বালানি হিসেবে বেড়েছে গ্যাস সিলিন্ডারের চাহিদা। গ্যাস দুর্ঘটনার ব্যবহারকারীদের মধ্যে এসব ঘটনা আতঙ্কও ছড়াচ্ছে।
বেইলি রোডে গত ২৯ ফেব্রুয়ারির আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনাতেও গ্যাস লিকেজের বিষয়টি সামনে এসেছে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স) তাজুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই ভবনের নীচতলায় ‘চা চুমুক’ নামের কফিশপের ইলেকট্রিক কেটলির শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেই আগুনটাকে অতিমাত্রায় ছড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে লিকেজের কারণে জমে থাকা গ্যাস। যার কারণে চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আগুন পুরো নীচতলা গ্রাস করে নেয়।”
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের ধারণা, এখন মোট জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ এলপিজি ব্যবহার করে, ২৫ শতাংশ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করে। বাকিরা বিভিন্ন ধরনের চুলা ব্যবহার করে থাকতে পারেন।
দুর্ঘটনা ‘বেড়েছে’
শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক মো. তরিকুল ইসলাম বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরা এসব ঘটনার শিকার হচ্ছেন, যারা বদ্ধ ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন।
ঢাকা শহরের চেয়ে আশপাশের শহরতলি এলাকাগুলোতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বেশি।
ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে গত ২৬ মার্চ রাতে ফ্ল্যাটের ভেতর গ্যাস থেকে সৃষ্ট আগুনে একটি পরিবারের চারজন দগ্ধ হন। সোমবার পর্যন্ত পরিবারটির স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের কলেজপড়ুয়া ছেলের মৃত্যু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে এখনো চিকিৎসাধীন।
ধামরাই ফায়ার স্টেশনের ইনচার্জ সোহেল রানা বলছেন, ওই ফ্ল্যাটে তারা দুটি গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছেন। সিলিন্ডার লিকেজ থেকে গ্যাস জমে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করছেন তারা।
এসব ক্ষেত্রে সাধারণত সিলিন্ডার থেকে বের হওয়া গ্যাস ফ্ল্যাটে জমে থাকে এবং কোথাও সামান্যতম আগুনের ছোঁয়া পেলেই বিস্ফোরণের মত জ্বলে ওঠে। উচ্চ তাপমাত্রার এই আগুন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এতে ঘরের আসবাব তেমন না পুড়লেও কয়েক সেকেন্ডেই মানুষের দেহ মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়।
তবে গাজীপুরের তেলিরচালায় গত ১৩ মার্চ খোলা জায়গাতেই সিলিন্ডার গ্যাসের আগুনে পুড়ে যান ৩৬ জন। তাদের মধ্যে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ একটি সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হতে থাকলে সেটিকে রাস্তায় রেখে যান বাড়ির মালিক।
শো শো শব্দে কিছুক্ষণ গ্যাস বের হওয়ার মধ্যে পাশের বাড়ির এক নারী নিজের ঘরে চুলা জ্বালতে গেলে দপ করে আগুন জ্বলে উঠে কয়েক সেকেন্ডেই নিভে যায়। আগুনে একটা বাড়ির কাঠ, দেওয়াল কিংবা দরজা-জানালার কিছুই পোড়েনি। পুড়েছে শুধু মানুষের শরীর।
কালিয়াকৈর থানার ওসি এ এফ এম নাসিম বলছেন, “আমরা সিলিন্ডারটা জব্দ করে নিয়ে এসেছি। সেটার রেগুলেটরের চাবি ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছে। সেখান থেকেই শব্দ করে গ্যাস বের হচ্ছিল। ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণে আমাদের শেখানো হয়েছে যে এ ধরনের গ্যাস লিকেজের ক্ষেত্রে আগুনে আঙুল দিয়ে চেপে ধরেই সেটা বন্ধ করা সম্ভব।”
ফায়ার সার্ভিসের হিসেবে, গত বছর সারা দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি আগুন লেগেছিল। এর মধ্যে গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে ৭৭০টি আগুন লাগে যা মোট আগুনের ২ দশমিক ৭৯ শতাংশ। গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ থেকে ১২৫টি আগুনের কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের ইনচার্জ শাহজাহান শিকদার বলছেন, “এটা ঠিক যে, গ্যাসের আগুনগুলো ছোট হলেও হতাহতের পরিমাণ বেশি হচ্ছে। এসব আগুনে মানুষের শ্বাসনালী ও মুখমণ্ডল পুড়ে গিয়ে মৃত্যুর পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের কথা
সারা দেশে থেকেই গ্যাসের আগুনে পোড়া রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসছেন ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। এ ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক মো. তরিকুল ইসলাম বলছেন, গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত গ্যাস থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে।
মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এর শিকার হচ্ছে বেশি। ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে বলে সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বলছেন তিনি।
রোগীদের কাছ থেকে এই চিকিৎসক যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে পাইপলাইনের সংযোগ আছে, দুর্ঘটনা এমন ঘরেও হয়েছে।
তিনি বলেন, “রোগীরা আমাদের যেটা বলে, সেটা হচ্ছে, কিছুদিন থেকেই হয়ত তারা গ্যাসের গন্ধ পাচ্ছিল, তারা বাড়ির মালিককে বিষয়টি জানানোর পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যেসব বাড়িতে সাধারণত লাইনের গ্যাস আছে সেগুলোতে এরকম ঘটনা ঘটে।
“আরেক ধরনের ঘটনা ঘটে, যারা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করে তাদের ক্ষেত্রে। তারা নিজেরা কিছু বুঝতেই পারেননি। এরপর যখন তারা চুলা জ্বালানোর জন্য ম্যাচের কাঠি বা লাইটার জ্বালান তখন পুরো ঘরে আগুন লেগে যায়। হয়ত তাদের অসাবধানতা বশত লিকেজ হয়ে ঘরের মধ্যে গ্যাস জমে ছিল, সেখান থেকেই এই ধরনের ঘটনাগুলো ঘটে।”
উচ্চবিত্ত বা একেবারেই দরিদ্র রোগী আসছে না জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, “মূল ঢাকা শহরেও এ ধরনের ঘটনা কম। ঢাকার আশপাশে সাভার, ধামরাই, আশুলিয়া, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, এসব এলাকা থেকে রোগীরা বেশি আসছেন।”
উৎকণ্ঠায় মানুষ
পরপর নানা ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে। অনেকে এখন বাড়ির নিচে সিলিন্ডার রাখার ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। মোহাম্মদপুরের বছিলার বাসিন্দা জেরিন সারোয়ার বলছেন, গত দুই বছর ধরে সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করছেন। নানা দুর্ঘটনার কথা জানার পর বাড়িওয়ালাকে বলেছেন সিলিন্ডার নিচে রাখার ব্যবস্থা করতে।
একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্স মিতালী রায় বলছেন, তার স্বামী-স্ত্রী দুজনই কর্মজীবী হওয়ায় গৃহকর্মীর ওপর নির্ভর করতে হয়। গ্যাসের দুর্ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় গৃহকর্মীকে প্রতিদিন বারবার করে গ্যাসের চুলা বন্ধ করার পর সিলিন্ডারের রেগুলেটরের চাবিও বন্ধ করতে বলেন। রাতে শোয়ার আগে তিনি নিজে একবার দেখে নেন।
দায় নেবে কে?
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল বিডিনিউজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, যে কোনো দুর্ঘটনার তো দায় নির্ণয়ের একটা বিষয় থাকে। সড়ক দুর্ঘটনার পরও কিন্তু মামলা হয়, দায়ী চালক বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু এই যে গ্যাস দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, এত এত মানুষ মারা যাচ্ছে, পুড়ে গিয়ে ভুক্তভোগী হচ্ছে, এগুলোর দায় কেউ নেবে না তা তো হতে পারে না।
“আমরা আজ পর্যন্ত শুনিনি এসব ঘটনার কোনো দায় নির্ণয় করা হয়েছে। এ রকম করে তো চলতে পারে না। রাষ্ট্রকে এসবের দায় নিতে হবে, এসব ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো যাবে।”
তিনি বলেন, “দেশে গ্যাস সিলিন্ডারের এত বড় শিল্প গড়ে উঠেছে। কয়েক কোটি ভোক্তা তাদের। শিল্প কি কেবল লাভ করবে? ভোক্তাদের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না? গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার নিয়ে বড় আকারের সতর্কতামূলক প্রচার আমরা দেখছি না। এটা করতে হবে, দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।”
অবহেলা সব জায়গায়
এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আজম জে চৌধুরী সিলিন্ডারগুলো সঠিকভাবে পরিবহন ও সংরক্ষণে সাবধানতার অভাব এবং ব্যবহারকারীদেরও সচেতনতার অভাব দেখছেন।
ওমেরা পেট্রোলিয়ামের এই পরিচালক বলেন, “গাড়ি থেকে সিলিন্ডারগুলো নামানোর সময় দেখবেন কেমন ধুপ ধাপ করে ফেলে, কোনোভাবেই এ রকম হওয়া উচিত না।
“সিলিন্ডারগুলো অপারেটর থেকে ডিস্ট্রিবিউটর, সেখান থেকে ডিলার হয়ে গ্রাহক পর্যায়ে যায়, সবগুলো পর্যায়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”
সিলিন্ডার ‘এমনিতে খুব নিরাপদ’ দাবি করে তিনি বলেন, “একটা সিলিন্ডারের মুখে যে ভাল্ভ থাকে সেটা ফ্যাক্টরি থেকে বের হওয়ার আগে তিনবার চেক করা হয়। আমরা তো বিদেশেও সিলিন্ডার এক্সপোর্ট করছি। নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর আমাদের ফ্যাক্টরি থেকে সিলিন্ডার বের হয়।”
দুর্ঘটনার খবর শোনার পর আপনারা ইন্ডাস্ট্রি থেকে কোনো ধরনের তদন্ত করেন কি না জানতে চাইলে আজম জে চৌধুরী বলেন, “অবশ্যই করি। এটা তো কোম্পানির ইমেজের বিষয়, না হলে তো আমার সিলিন্ডার কেউ কিনবে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা হয়, সিলিন্ডারটা অক্ষত থাকে, কিন্তু জমা গ্যাসে বিস্ফোরণের মত শব্দ করে আগুন লেগে যায়।”
অবৈধ রিফিল কারখানা
আজম যে চৌধুরী যেভাবে সব কিছুকে নিরাপদ বলছেন, আসলে তার সব নিরাপদ না। কারণ, তার নিজের দেওয়া তথ্য বলছে, গত বছর ঢাকার উপকণ্ঠে অবৈধ সিলিন্ডার রিফিল কারখানায় গড়ে উঠেছে।
বড় সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার সময়ও আগুন লেগে কয়েকজন হতাহত হয়েছে।
এসব কারখানার বিষয়ে কী করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটা এখন দেশব্যাপী একটা সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শত শত কারখানা হয়েছে। বড় সিলিন্ডার থেকে ছোট সিলিন্ডারে গ্যাস ভরার এই অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা এখন এত চলছে যে এটা আমাদের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
“আবার সিলিন্ডারগুলো এখন বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়। বিষয়টা নিয়ে আমি এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। তিনি ডিসিদের চিঠি লেখার পর কক্সবাজার এবং উত্তরবঙ্গের কিছু জায়গায় অবৈধ সিলিন্ডার ট্রেডিং কারখানা জব্দ করা হয়েছিল। ডিসিরা অ্যাকশন নিয়েছেন, পুলিশও বেশ কিছু ধরেছে। কিন্তু এখনো সারা দেশে শতশত এ রকম কারখানা রয়েছে।”
আবার সিলিন্ডার নিয়েও আছে ব্যবসা।
আজম জে চৌধুরী বলেন, “আমাদের একটা সিলিন্ডারে যে স্টিল থাকে এটা বাজারে লোহার দরে বিক্রি করলে কয়েক হাজার টাকা পাওয়া যায়। ডিস্ট্রিবিউটর ভাবে, এটা তো কোম্পানির কাছ থেকে পাঁচশ টাকায় পাওয়া যায়, সে লোহার বেপারির কাছে দুই হাজার টাকায় সেটা বেচে দেয়। তখন ওই সিলিন্ডার স্টিল মিলে নিয়ে যায়।
“সেখানে এগুলো স্ক্র্যাপ করা (ভাঙা) হয়। সিলিন্ডার ভাঙার আগে ডিগ্যাসিফিকেশন করতে হয়। সেটা না করে সিলিন্ডার ভাঙতে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
সচেতন করবে কে?
তাহলে ব্যবহারকারীদের সচেতন কে করবে- এই প্রশ্নে এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, “গত তিন-চারদিন আগে আমরা আমাদের অ্যাসোসিয়েশনে মিটিং করেছি। সেখানে আমাদের তিনটি লেবেলেই নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রত্যেক অপারেটর তাদের নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউটরকে ট্রেইনিং দেবে সিলিন্ডার ব্যবহার ও হ্যান্ডেল করার বিষয়ে। ডিলার এবং কনজিউমার লেবেলেও অপারেটররা সচেতনতা তৈরির জন্য ক্যাম্পেইন করবে।
“একটা সিলিন্ডার নতুন করে চুলার সঙ্গে কানেক্ট করার সময় কী কী সতর্কতা নিতে হবে এ বিষয়গুলো কখনো গ্রাহকদের বলে না ডিস্ট্রিবিউটর বা ডিলাররা। সেটা যেন হয় আমরা সে ব্যবস্থা করছি।”
যেসব মানুষ প্রথম সিলিন্ডার ব্যবহার করছেন, তাদের সচেতনতার জন্য কোম্পানিগুলো কী করছে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এক সময় আমরা টিভি বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এখন আবার কাজ শুরু হবে।”
বসুন্ধরা এলপিজির মহাব্যবস্থাপক জাকারিয়া জালাল বলেন, “সিলিন্ডারের দিক থেকে আমরা কিন্তু কোনো কিছু ঘাটতি রাখি না। যতগুলো সিলিন্ডার রিলেটেড দুর্ঘটনা ঘটেছে কোনোটাই কিন্তু সিলিন্ডার বিস্ফোরণ না।
“যেটা হয় সিলিন্ডারগুলো মিস হ্যান্ডেলিংয়ের কারণে হয়। সিলিন্ডারগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত হোসপাইপ, ক্ল্যাম্প বা রেগুলেটর যেগুলো লাগানো হয় সেগুলো যদি মানসম্মত না হয় সেগুলোর কারণে কিন্তু দুর্ঘটনাগুলো হচ্ছে।”
তাহলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো দায় থাকছে না? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের পার্টে কিন্তু সিলিন্ডার এবং ভাল্ব। এই দুটি জিনিসের নিশ্চয়তা আমরা দিয়ে থাকি।
“এই যে সিলিন্ডারের মিস অপারেশন এবং নন স্ট্যান্ডার্ড ফিটিংসগুলোর কারণে যে সমস্যাগুলো হচ্ছে এগুলো তদারকির দায়িত্ব অপারেটরের না। হোসপাইপ, রেগুলেটর বা ক্ল্যাম্পগুলো বিক্রি হচ্ছে সেগুলো বিক্রির দায়িত্ব তো আমাদের না।”
এই খাতে নিম্নমানের জিনিসগুলো কারা আমদানি করছে এটা দেখার দায়িত্ব কাদের- এই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
অপারেটদের চিঠি দিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর
দেশে গ্যাস সিলিন্ডার আমদানি ও বাজারজাতকরণের অনুমোদন দেয় সরকারের বিস্ফোরক পরিদপ্তর।
পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক ফারুক হোসেন বলছেন, “সিলিন্ডার বডি থেকে লিকেজ হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। এটার ভাল্বের ভেতরে যে ‘ও রিং’ থাকে সেটা ড্যামেজ হলে, বা যে হোস পাইপটা আছে সেটা নষ্ট হলে লিকেজ হতে পারে। গ্যাস সিলিন্ডারের রেগুলেটর ঠিকভাবে বন্ধ না করা হয়ে থাকলেও এটা হতে পারে। অনেক সময় চুলা বন্ধ করার পরও কিন্তু গ্যাস বের হয়।”
সিলিন্ডার বা গ্যাসের লিকেজ ঠেকাতে এই পরিদপ্তর কী ধরনের ব্যবস্থা নিচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলছেন, “আমরা লিকেজের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিচ্ছি।
“আর যারা অপারেটর এবং ডিস্ট্রিবিউটর আছেন তাদেরকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছি যে, তাদের সিলিন্ডারগুলোর কন্ডিশন কী সেটা আমাদের জানানোর জন্য। এবং সেটার ভিত্তিতে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”
আরও পড়ুন:
আশুলিয়ায় গ্যাস সিলিন্ডার রিফিল কারখানা যেন ‘মৃত্যুকূপ’
ভাসানচরে দগ্ধ পাঁচ শিশুর কেউ বাঁচল না
গ্রিন কোজির ‘ভূত’ রাজধানীজুড়েই
ধামরাইয়ে একই পরিবারের দগ্ধ চারজনের ৩ জনই মারা গেলেন
আশুলিয়া গ্যাস গুদামে বিস্ফোরণ: মৃত্যু বেড়ে ৩
গ্যাস সিলিন্ডারের গুদামে বিকট বিস্ফোরণের পর এলাকায় আগুন, আতঙ্ক
ভয়ঙ্কর এক ‘আগুনে গোলা’, কয়েক সেকেন্ডে সব ছারখার
গাজীপুরে গ্যাসের আগুন: চলে গেলেন দিনমজুর কুদ্দুস, মৃত্যু বেড়ে ১৭