গ্রিন কোজির ‘ভূত’ রাজধানীজুড়েই

বেইলি রোডের পুড়ে যাওয়া ভবনটিতে যে যে অনিয়মের কথা উঠে আসছে, নগরীর শত শত রেস্তোরাঁ ভবনেই একই চিত্র।

ওবায়দুর মাসুমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2024, 07:53 PM
Updated : 3 March 2024, 07:53 PM

বেইলি রোডের পুড়ে যাওয়া ভবনটির কঙ্কালসার দেহ নগরীর অন্য এলাকাতেও ভীতি তৈরি করছে, কারণ একই ধরনের অনিয়ম আর অবহেলা চলে আসছে বহু ভবনেই।

রেস্তোরাঁয় ঠাসা তিন এলাকা ধানমন্ডি, মিরপুর ও খিলগাঁও ঘুরে দেখা গেছে, গ্রিন কোজি কটেজের মতই অব্যবস্থাপনা বহু ভবনে।

ভবনগুলো আবাসিক কি বাণিজ্যিক, বাণিজ্যিক হলেই সেটি রেস্তোরাঁ করার মত উপযোগী কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। আর খালি চোখেই ধরা পড়ে নিয়ম লঙ্ঘনের চিত্র।

বেইলি রোডের দুর্ঘটনার পর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ আসলে কী করে- সেই প্রশ্ন নতুন করে উঠছে। এই তিনটি এলাকার চিত্র সেই প্রশ্ন আরো বড় করবে।

তবে কেবল এই তিন এলাকা নয়, গোটা রাজধানীতেই আসলে একই চিত্র মিলবে। আবাসিক ভবনের নিচতলায় যেখানে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকার কথা, সেখানে রেস্তোরাঁ বসানোর ঘটনা দেখা যায় অহরহ।

গত কয়েক বছরে ঢাকায় রেস্তোরাঁ ব্যবসার ব্যাপক চল তৈরি হয়েছে। যে কোনো লোকালয়ে সড়ক ধরে কিছুদূর হাঁটলেই খাবারের দোকান বা রেস্তোরাঁ দেখা যায়। সড়কের ধারে ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানেরও কমতি নেই। প্রশ্ন হল, সেগুলো অগ্নি ঝুঁকি মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে কি না।

বৃহস্পতিবার রাতে গ্রিন কোজি কটেজের আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর ফায়ার সার্ভিস জানায়, সেই ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। প্রথমে আবাসিক ও পরে অফিসের কাজে ব্যবহারের জন্য বাণিজ্যিক অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে অধিকাংশ ফ্লোর মিলিয়ে ছিল ১৪টি খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ।

সেসব দোকানে সারাদিন মানুষের আনাগোনা থাকত, অথচ লিফট বাদে সিঁড়ি মোটে একটি। তাও এতটাই সরু যে একসঙ্গে পাঁচজন চলাচল করতে পারেনি।

ভবনের সেই সিঁড়িতে আবার রাখা ছিল সিলিন্ডার, রেস্তোরাঁর নানা মালামাল। নিচ তলায় একটি চায়ের দোকানে জ্বলে উঠা আগুনের মাত্রা কমে এলেও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন ওপরের দিকে উঠতে থাকে।

কাচ ঘেরা ফ্লোরগুলো থেকে মানুষ নামতে না পেরে আটকা পড়েছে গ্যাস চেম্বারে। অনেকের মৃত্যু হয়েছে কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়ায়।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে একই রকম পরিণতির ঝুঁকি দেখা গেছে। এমনও ভবন পাওয়া গেছে, যেখানে একটি ফ্লোরে ব্যাংকের শাখা, বাকিগুলোর বেশিরভাগে রেস্তোরাঁ। আগুন সেই ভবনে লাগলে ব্যাংকটির কী হবে, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, তারা জানতে পেরেছেন, বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে সেগুলোতে রেস্তোরাঁ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের এখানে কিছু করার নেই।

সিটি করপোরেশন বলছে, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য থাকে না, তাই তারা ট্রেড লাইসেন্স আটকাতে পারে না।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, তারা অনিয়ম দেখলে কেবল নোটিস করতে পারে, কিন্তু মামলার ক্ষমতা নেই।

তিন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই, এমন কোনো ব্যবস্থাপনা নেই, যেখানে এক ক্লিকে সব তথ্য চলে আসবে। ফলে ভবন মালিককের ‘ইচ্ছাকৃত’ অনিয়ম ঠেকানোর সুযোগ নেই।

চিত্রটা ভীতিকর

জিগাতলার কেয়ারি ক্রিসেন্ট প্লাজা ১১ তলা। ভবনটির নিচতলায় একটি রেস্তোরাঁ। দোতলায় বিভিন্ন ধরনের দোকান। তিন থেকে ওপরের প্রতিটি ফ্লোরেই রেস্তোরাঁ।

ভবনটিতে অগ্নি নির্গমন পথ আছে বটে, তবে দুর্ঘটনা ঘটে গেলে সেই পথ দিয়ে কতজনের পক্ষে বের হওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্ন আছে।

ওই পথেও আবার রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। সেসব সিলিন্ডার থেকে রেস্তোরাঁগুলোর চুলায় গ্যাস সরবরাহ করা হয়। অগ্নি নির্গমন পথেই আবার কর্মীদের রাতে শোয়ার ব্যবস্থা। পথটি ময়লা-আবর্জনাতেও ভর্তি।

ভবনের নিচতলায় অগ্নি নির্গমন পথ দিয়ে বের হওয়ার আসলে সুযোগও নেই। কারণ, সেই স্থানটি জেনারেটর ও নানা মালামাল দিয়ে আটকে রাখা।

ভবনটিতে রেস্তোরাঁ মালিকদের একটি সমিতি আছে, তার সভাপতি শোয়েব খান। এই অবস্থা কেন- এই প্রশ্নে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবনের ফায়ার এক্সিটে যত সিলিন্ডার রাখা আছে, সেগুলো ভবনের নিচে আমরা একটা শেড করে নামিয়ে দেব। এটা আগামী তিন দিনের মধ্যে করব।”

কম বেশি একই চিত্র ধানমন্ডির বহু ভবনে। সাত মসজিদ সড়কের কে বি প্লাজা নামের ১৩ তলা ভবনে গুনে গুনে রেস্তোরাঁ পাওয়া গেল ১২টি।

এই ভবনে দুটি লিফট এবং একটি সিঁড়ি ছাড়াও অগ্নি নির্গমন পথ রয়েছে। ভবনটির উপর তলা থেকে নিচ তলা পর্যন্ত অগ্নি নির্গমন পথে তেমন প্রতিবন্ধকতা নেই। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে কেউ নিচতলায় এসেই পড়বেন বিপাকে।

কারণ, সেখানে বের হওয়ার পথে রাখা হয়েছে কাপড়ের দোকানের মালামাল। জায়গাটা এতটাই সরু যে স্বাভাবিক অবস্থাতেই কারো পক্ষে বের হওয়া কষ্টকর, জরুরি অবস্থায় যখন হুড়োহুড়ি তৈরি হবে, তখন তা আরো বেশি কঠিন হয়ে যাবে।

সরু পথটি দিয়ে বের হতে পারলে সামনে পড়বে সারি সারি সিলিন্ডার, সেগুলোর কতগুলো আবার দাঁড় করিয়ে রাখা দেখা গেল, কতগুলো মেঝেতে পড়েছিল আড়াআড়িভাবে।

সাত মসজিদ রোডের ৭৫৪ হোল্ডিংয়ের সাত তলা ভবনটি পরিচিত স্টার কাবাব বিল্ডিং নামে। সেখানে স্টার কাবাব ছাড়াও আছে পিৎজা হাট, দোসা এক্সপ্রেস, পিৎজা বার্গ, ক্যাফে ওস্টেরিয়া, ওল্ড টেরেস, মুভ অ্যান্ড পিক, দ্য ডাম্পলিং হাট নামে খাবারের দোকান।

এ ভবনে শত শত মানুষের আনাগোনা থাকে নিত্য দিন। তাদের সংখ্যার তুলনায় লিফটটি বেশ ছোট, আর সিঁড়িটাও সরু।

ভবনের পেছনে স্টিল দিয়ে একটি অগ্নি নির্গমন পথ করা হলেও সেটি ব্যবহার করার মত নয়। সেই জরুরি নির্গমন পথের সিঁড়ি শেষ হয়েছে যেখানে, সেখান থেকে সরাসরি বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সেই পথটি আটকে দেওয়া, একটি দরজা দিয়ে ভবনের নিচ তলায় ঢুকতে হয়। এরপর মূল দরজা নিয়ে বের হতে হয়।

Also Read: টুইন পিকে অবৈধ ৪০ ফুট, রেস্তোরাঁ ‘রাজউক আইনের লঙ্ঘন’

Also Read: আগুন-বিস্ফোরণ: ‘সরকারি কর্মকর্তারা কোথায়?’

Also Read: শহরজুড়ে ‘মৃত্যুফাঁদ’, মানুষ মরলেই ‘জাগে’ কর্তৃপক্ষ

যে দরজা নিয়ে নিচ তলায় মানুষ ঢুকবে, সেখানেও গ্যাসের অনেকগুলো সিলিন্ডার রাখা আছে। সেখান থেকে পাইপ দিয়ে ওপরের রেস্তোরাঁয় গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

এভাবে প্রায় সবগুলো ভবনেই একাধিক রেস্তোরাঁ। কোথাও জরুরি অগ্নি নির্গমন পথ নেই, থাকলেও গ্যাস সিলিন্ডার, জেনারেটর, ময়লা আবর্জনা রাখা। ভবনগুলোর সিঁড়ি অপ্রশস্ত, লিফটের ধারণক্ষমতা কম।

খিলগাঁওয়ের শহীদ বাকী সড়কের দুই পাশেই বহুতল ভবনে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। বিকাল আর সন্ধ্যায় ওই এলাকাটি হয়ে উঠে লোকারণ্য। 

একাধিক ভবনে রেস্তোরাঁর সঙ্গে আছে আবাসিক ফ্ল্যাট, আছে অন্য বাণিজ্যিক স্থাপনা। কোনো কোনো ভবনে নেই জরুরি অগ্নি নির্গমন পথ। সিঁড়িগুলো সরু, তাতে আবার মালামাল রাখা।

স্কাইভিউ নাজমা টাওয়ার নামে নয় তলা একটি বহুতল ভবনের ছয়টি ফ্লোরে রেস্তোরাঁ। ওই ভবনের সামনে পিছনে দুটি লিফট একটি সিঁড়ি থাকলে অগ্নি নির্গমন পথ নেই। এই ভবনের বিভিন্ন তলায় সিঁড়িতে ময়লার ড্রাম, ভাঙা চেয়ার ও গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা।

৫৬৬/এ নাইটিঙ্গেল স্কাইভিউ টাওয়ারের প্রতিটি ফ্লোরেই রেস্তোরাঁ। ওই ভবনের একটি লিফট, একটি সরু সিঁড়ি, তবে কোনো অগ্নি নির্গমন পথ নেই। লিফটের একসঙ্গে চার জনের বেশি উঠতে মানা। সিঁড়িতে জেনারেটরসহ বিভিন্ন মালামাল রাখা।

ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁর কর্মী হাসানুজ্জামান বলেন, “এই লিফটে চারজনের বেশি উঠলে কাঁপাকাঁপি করে। ভয় তো লাগেই। কিন্তু কী করা যাবে, চাকরি করতেই হবে।”

বেইলি রোডের অভিজ্ঞতায় ক্রেতাদের মনে ভয়

গোড়ানের বাসিন্দা মোহাম্মদ উল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মাঝেমধ্যে রেস্তরাঁয় খেতে যাই। তবে সেগুলোর পরিবেশ মোটেও নিরাপদ না।

“কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এখান থেকে উদ্ধার করার কোনো সুযোগ নেই। মূল সিঁড়িটাই সরু যে, উঠতে গেলে একজনের সঙ্গে আরেকজনের ধাক্কা লাগে। এখন আমি সেসব রেস্তোরাঁ এড়িয়ে চলি, নিচের দোকানগুলোয় খাই।”

বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর ধানমন্ডির একটি রেস্তোরাঁয় দাওয়াত খেতে হিয়ে অস্বস্তিতে পড়ার কথা জানিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছেন সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর।

তিনি বলেন, “পার্টি শেষ হতে হতে সাড়ে ১১টা। লিফটের সামনে অনেক মানুষের ভিড়। তাই আমরা কেউ কেউ ফায়ার এক্সিট দিয়ে হেঁটে ১১ তলা থেকে নেমে আসব ভেবেছি। আর তখনই এক অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল।

Also Read: নিয়ম ভাঙায় আগেও জরিমানা করা হয়েছিল গ্রিন কোজি কটেজকে

Also Read: গ্রিন কোজি কটেজ বীভৎসরূপে

Also Read: অগ্নি দুর্ঘটনা: দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ কর্মকর্তার সর্বোচ্চ জরিমানা চায় মানবাধিকার কমিশন

“সিঁড়িতে রাখা হয়েছিল খাবারের অবশিষ্টাংশ, বস্তা থেকে চুঁইয়ে পড়ছিল দুর্গন্ধযুক্ত খাবারের তরল অংশ, সিঁড়ি একেবারে পিচ্ছিল।”

তিনি লিখেছেন, “কোথাও কোথাও রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। কোথাও কোথাও মনে হচ্ছিল খাবার স্টোর করে রাখা হয়েছে। সরাসরি সিঁড়ি দিয়ে নামা যাচ্ছিল না, অবশ্যই হাতল ধরে নামতে হচ্ছিল।

“বেইলি রোডের ঘটনার পর মনে হচ্ছে, এ ধরনের ভবনগুলোতে যেসব রেস্তোরাঁ গজিয়ে উঠেছে, সেসব রেস্তোরাঁর মালিকেরা মানুষের জীবনকে খুব একটা মূল্য দেয় না।”

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাশেদুল আলম সন্তানদের নিয়ে প্রায়ই ধানমন্ডির বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খেতে যেতেন। বেইলি রোডের ঘটনার পর এখন ভয় ঢুকেছে মনে।

তিনি বলেন, “সব ভবনেরই কিছু সেইফ এক্সিট থাকে। জরুরি কিছু হলে যেন নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই এলাকার বেশিরভাগ ভবনের লিফট ছোট, সিঁড়ি আরও সরু। আবার সিঁড়ির মধ্যে মালামাল, গ্যাস সিলিন্ডার রাখে। ফলে কোনো ঝামেলা হলে মানুষ যে নিরাপদে নেমে আসবে তা সম্ভব না। আরেকটি ভয়ংকর বিষয়।”

বোধোদয়, নাকি লুকানোর চেষ্টা?

গ্রিন কোজি কটেজে প্রাণহানির তৃতীয় দিনে রোববার মিরপুর ১২ নম্বরে সফুরা টাওয়ার সিটি নামে একটি বহুতল ভবনের প্রধান ফটক বন্ধ পাওয়া যায়। ভেতরের সবগুলো রেস্তোরাঁও বন্ধ।

কয়েকটি রেস্তোরাঁর কর্মীরা জানিয়েছেন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর ভবন মালিক আগামী সাতদিন রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ রাখতে বলেছেন।

তবে এটি বোধোদয় নাকি ভবনের অনিয়ম ঢাকার চেষ্টা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ওই ভবন ঘুরে দেখা গেছে, ছোট ছোট দুটি লিফট। কোনো অগ্নি নির্গমন পথ নেই।

একটি রেস্তোরাঁর একজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ভবনের ১০ তলার প্রতিটিতে রেস্টুরেন্ট। পিক আওয়ারে এখানে পাঁচশর বেশি মানুষ আসে। কিন্তু কোনো ফায়ার এক্সিট নাই।

Also Read: ছাড়পত্রের পর ভবনে নজরদারি না থাকা নিয়ে প্রশ্ন চুন্নুর

Also Read: অগ্নিকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘অবহেলা’ দায়ী: ৪৮ নাগরিক

“বছর খানেক আগে একবার ভবনের জেনারেটরে আগুন লেগেছিল। তখন থেকেই ভবন মালিককে বলা হচ্ছে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো করার জন্য। কিন্তু এতদিন করে নাই। বেইলি রোডে আগুন লাগার পর এখন তারা কিছু কাজ করবে। আমাদের মৌখিকভাবে বলে দেওয়া হয়েছে বন্ধ রাখার জন্য।”

ওই ভবন মালিকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে ভবন দেখভালের দায়িত্বে থাকা জাফর আলী নামে একজন দাবি করেন, অগ্নিনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই ভবনে আছে। কিছু মেরামতের জন্য রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

“আমাদের ভবনের কিছু কাজ করতে হবে। এজন্য বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কাজ শেষ হলে সাতদিন পর আবার চালু হবে।”

সেই ভবনটি ছাড়াও পল্লবী, ১০ নম্বর ও ১ নম্বর গোলচত্বর এলাকায় এমন বহু ভবন রয়েছে, সেগুলোর অগ্নি ঝুঁকি খালি চোখেই ধরা পড়ে।

কাজ করছে না সরকারি কর্মকৌশল

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভবনের অকুপেন্সি টাইপের (ব্যবহার ভেদে ভবনের শ্রেণিবিন্যাস) ওপর রাজউক থেকে অনুমোদন নিতে হয়। অকুপেন্সি টাইপ রেস্তোরাঁর জন্য হলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে হয়। রেস্তোরাঁয় বেশি লোক সমাগম হবে, তাই বড় লিফট করতে হবে, বেশি জায়গা ছাড়তে হবে।

“এ কারণে ভবন মালিকরা অফিসের জন্য অকুপেন্সি নিয়ে রাজউকের কাছে নকশা অনুমোদন করায়। পরে ভাড়া দেয় রেস্তোরাঁ হিসেবে। আমি যতটুকু জানি, ধানমন্ডি, খিলগাঁওসহ বেশিরভাগ এলাকার রেস্তোরাঁগুলো করা হয়েছে বাণিজ্যিক অনুমোদন নেওয়া ভবনে।”

তাহলে এখন কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না- এই প্রশ্নে রাজউক কর্মকর্তা বলেন, “ভবনটি নির্মাণের আগে এবং নির্মাণের সময় ছাড়া রাজউকের নিয়ন্ত্রণের তেমন জায়গা থাকে না। এক্ষেত্রে অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কাজ করতে পারে।

“যে অকুপেন্সি দিয়ে নকশা অনুমোদন করেছে, ওই অকুপেন্সি ছাড়া অন্য ব্যবহার করলে সিটি করপোরেশন ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া এবং প্রতি বছর নবায়নের সময় সেটা চেক করতে পারে। অকুপেন্সির বাইরে গেলে ট্রেড লাইসেন্স স্থগিত করে দিতে পারে।

“ফ্ল্যাট কেনাবেচার ক্ষেত্রে যে অকুপেন্সিতে অনুমোদন হয়েছে এর বাইরে অন্য কোনো ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেটি সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে চেক করতে হবে। এই দুটি জায়গায় আটকাতে হবে।”

নগর কর্তৃপক্ষ কেন এই কাজগুলো করে না- এই প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রেড লাইসেন্স করার একটি প্রক্রিয়া আছে। ভবন মালিক যদি রেস্টুরেন্ট করতে চায় আমাদের এখান থেকে কর্মকর্তারা গিয়ে দেখেন রেস্টুরেন্ট করার মত পরিবেশ আছে কি না। পরিবেশ থাকা সাপেক্ষে অন্যান্য সংস্থাগুলোর ছাড়পত্র থাকলে আমরা ট্রেড লাইসেন্স দিই।

“রাজউক যদি ভবনের প্ল্যান শেয়ার করে, তাহলে আমরা বলতে পারতাম যে ওইখানে রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি নাই। কিন্তু তারা সেটা করে না।”

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ফায়ার সার্ভিস মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিদর্শন করে অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন করেন, নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য ফায়ার সেইফটি প্ল্যান গ্রহণের অনুরোধ জানায়। কিন্তু আইনি সুযোগ না থাকায় ফায়ার সার্ভিস মামলা করতে পারে না।

“আইন লঙ্ঘন হলে নোটিস দিই। অগ্নি নিরাপত্তা বাড়াতে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগও রেখেছি আমরা। তবে আইনে পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় আমরা এসব ভবনের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না।”

সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহম্মদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংস্থাগুলো দায় এড়াতে চাইছে। নিয়মিত তদারকি থাকলে এগুলো এভাবে চলার কথা নয়।”

তিনি বলেন, “এসব ভবনে কী ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। নগরের জননিরাপত্তা সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অগ্নিঝুঁকির জন্য ফায়ার সার্ভিস এবং সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার হলে সেটা দেখবে বিস্ফোরক অধিদপ্তর।

“কিন্তু সংস্থাগুলো তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করছে না। করলে এগুলো চলতে পারত না। অনিরাপদভাবে এগুলো একদিন চলতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত রেস্তোরাঁগুলো নিরাপদ না হচ্ছে ততক্ষণ সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। খাওয়ার চেয়ে বেঁচে থাকা জরুরি। জীবন বাঁচাতে সরকারকে কঠোর হতে হয়।”