ভয়ঙ্কর এক ‘আগুনে গোলা’, কয়েক সেকেন্ডে সব ছারখার

গত চার দিন ধরে বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউ, এইচডিইউ ইউনিটগুলোর সামনে ভিড় করে আছেন গাজীপুরের দগ্ধদের স্বজনরা। কেউ চোখের পানি ফেলছেন, রক্তের জন্য ছোটাছুটি করছেন কেউ।

আমিনুল ইসলামঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2024, 07:05 AM
Updated : 17 March 2024, 07:05 AM

শনিবার সন্ধ্যা, ইফতারির সময় হয়ে গেছে প্রায়। ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউর সামনে তখন স্বজনদের দারুণ ব্যস্ততা।

চার বছরের তৈয়বা আর তার ভাই ছয় বছরের তাওহিদের জন্য ‘সাদা রক্তের’ সন্ধানে ছোটাছুটি করছিলেন স্বজনরা। দুই শিশুর বাবা অটোরিকশা চালক মো. সজল পরামর্শ করছিলেন স্বজনদের সঙ্গে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে খবর এল, তৈয়বা নেই। কান্নার রোল পড়ে গেল পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।

এরপর তাদের কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাওহিদের জন্য রক্ত যোগাড়ে, আবার কেউ তৈয়বার লাশ বুঝে নিতে সজলকে সহায়তা করতে গেলেন।

গত ১৩ মার্চ এরকম ইফতারের সময়ই গাজীপুরের কালিয়াকৈরে টপস্টার গার্মেন্টস এলাকায় ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডে তৈয়বা আর তার ভাই তাওহিদসহ ৩২ জন দগ্ধ হয়।

প্রতিবেশীদের একজন বাসার ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডারটি গলিতে রেখে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে শোঁ শোঁ শব্দে গ্যাস বের হচ্ছিল। কেউ একজন ভেজা চটের বস্তা দিয়ে সিলিন্ডারটি পেঁচিয়ে রেখেছিলেন।

সেখানে কী হচ্ছে সেটা দেখতে ভিড় করেছিল উৎসুক শিশুরাও। এর মধ্যেই পাশের আরেক বাসায় রান্নার জন্য চুলা ধরালে মুহূর্তে আগুনে ছেয়ে যায় গলিপথ। পুড়ে যায় সেখানে থাকা শিশু, বৃদ্ধ, যুবকসহ সবাই।

অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে ৩২ জনকে ভর্তি করা হয় ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। তাদের মধ্যে ১৯ জনের পোড়ার মাত্রা ছিল ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ। তাদের মধ্যে তৈয়বাসহ মোট পাঁচজন এ পর্যন্ত মারা গেছেন।  

দগ্ধ এই লোকগুলোর কেউ পোশাক কর্মী, কেউ জুট গুদামের শ্রমিক, কেউ অটোরিকশার চালক। দগ্ধ শিশুরা তাদের পরিবারেরই সন্তান।

গত চার দিন ধরে বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউ, এইচডিইউ ইউনিটগুলোর সামনে ভিড় করে আছেন গাজীপুরের দগ্ধদের স্বজনরা। কেউ চোখের পানি ফেলছেন, রক্তের জন্য ছোটাছুটি করছেন কেউ।

শনিবার সন্ধ্যায় কথা হয় তৈয়বা আর তাওহিদের খালু মো. রিফাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, বুধবার শিশু দুটি হইচই শুনে বাইরে গিয়েই আগুনের কবলে পড়ে। ডাক্তার বলেছিলেন, ‘সাদা রক্ত’ লাগবে। সেটা যোগাড় করার জন্য বাইরে গিয়েছিলেন, ফিরেই শোনেন তৈয়বা নেই।

এখন তাওহিদকে বাঁচানোর চেষ্টায় আছেন সবাই। বোনের মত তারও পোড়ার মাত্রা ৮০ শতাংশ বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

১০ সেকেন্ডে সব ছারখার

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের বাইরে বসে ছিলেন পোশাক কর্মী আল আমিন। তার সত্তোরর্ধ্ব মা কমলা খাতুন এবং ২৪ বছরের জামাতা লালন ওই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। কমলা খাতুনের পোড়ার মাত্রা ৮০ শতাংশের বেশি, আর লালনের পুড়েছে ৪০ শতাংশ।

আল আমিন বলছেন, তার সামনের বাসার বাসিন্দা শফিকুল ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডারটি গলির মধ্যে রেখে যান। সেখানে ১০ সেকেন্ডের একটি অগ্নিগোলকের মত তৈরি হয়। তাতেই সবাই জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।

“ওই সিলিন্ডারটা থেকে শোঁ শোঁ শব্দে গ্যাস বের হচ্ছিল। ভয় পেয়ে শফিকুল সেটা ঘরের বাইরে গলিতে রেখে যায়। সেটা ঘিরে আবার উৎসুক মানুষের জটলা তৈরি হয়।

“তখন ছিল ইফতারির আগ মুহূর্ত। ওই সময়ই শফিকুলের বাড়ির আরেক ভাড়াটিয়া ফাতেমার মা গলিতে লাকড়ির চুলায় আগুন দিচ্ছিলেন। তিনি চুলায় আগুনটা জ্বালিয়ে ঘরে ঢোকা মাত্র গলির মধ্যে দপ করে একটা আগুনের গোলা তৈরি হল, আবার নিভেও গেল। কিন্তু এর মধ্যে রাস্তায় থাকা সবাই পুড়ে গেল।”

আল আমিন জানান, যারা ঘরে ছিলেন, তাদের কারো কিছু হয়নি। ঘটনার সময়ে তার মা কমলা খাতুন বাড়ির দরজায় আর লালন বাইরে ছিলেন। দুজনেই পুড়ে যান।

পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনে কথা হয় মো. ফজলুর সঙ্গে। তার বোন শিল্পী বেগম (৪০) ও শিল্পীর দুই ছেলে ১০ বছরের নীরব ও তিন বছরের নিলয় ওই আগুনে পুড়েছে।

ফজলু বলছেন, পরিবারটির এখন খুবই দুঃসময় যাচ্ছে। সবাই চেষ্টা করছেন তার বোনের পাশে থেকে সহায়তা করার।

‘আব্বা, দোয়া কইরো’

২২ বছরের পোশাককর্মী মো. নাদেনের শরীর পুড়েছে ৮৫ শতাংশের বেশি, পুড়েছে শ্বাসনালীও। তার বাবা দিনমজুর আব্দুর রহিম পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনে বসে চোখের পানি ফেলছিলেন।

আব্দুর রহিম বলেন, “আমি ইফতার মুখে দিছি, ঠিক এই সময় ফোনে জানলাম নাদেন আগুনে পুড়ে গেছে, তাকে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। আমি তখন কেরানীগঞ্জ আছিলাম। নাদেন তার বউ-বাচ্চা নিয়া ওই এলাকায় (টপস্টার) থাকে। আমি হাসপাতালে আইসা পোলার কাছে গেলাম, অবস্থা ভালা না। পোলায় খালি কইল, ‘আব্বা দোয়া কইরো, আমার জন্য।"

আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন আব্দুর রহিম। তিনি বলতে থাকেন, “কি কমু ভাই, পোলার আমার পুরা শরীরডাই পুড়ছে।”

নাদেনের দুই বছরের একটি ছেলে আছে। তার স্ত্রী রয়েছেন স্বামীর পাশে। বাইরে অন্য স্বজনেরা। চিকিৎসা চলছে, তবে সবাই উদ্বিগ্ন,  কখন যে কী খবর আসে!