পোড়া বগির নিচে রেললাইনে জানালার কাঁচের টুকরো, নারী-শিশুদের স্যান্ডেল, পোড়া কাপড়-ব্যাগসহ নানা কিছু জানান দিচ্ছিল শেষ সময়ে আতঙ্কিত বেনাপোল এক্সপ্রেসের যাত্রীদের বাঁচার যুদ্ধের কথা।
Published : 06 Jan 2024, 12:50 AM
ঢাকার গোপীবাগের ব্যাডমিন্টন খেলার ছোট্ট এক মাঠে শীতের কুয়াশা ভেজা রাতের আলো আঁধারে মানুষের ভিড়ের মধ্যে এদিক সেদিক ঘুরছেন এক নারী; যেখানেই কয়েকজনের জটলা দেখছেন সেখানেই গিয়ে খুঁজছেন কাউকে।
শুক্রবার রাতের সে সময়ে হ্যান্ডমাইকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী টুকু বারবার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছিলেন শিশুসহ এলিনা নামে এক নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এলিনা যদি এ ঘোষণা শুনতে পান তাহলে যেন এ ব্যাডমিন্টন কোর্টের সামনে আসেন
সেখানেই বোনের খোঁজে উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন তনিমা নামের ওই নারী। তিনি বলেন, তার বোন এলিনা ইয়ামিনের সঙ্গে তার পাঁচ মাসের শিশু আরফান হোসনেও রয়েছে। আগুন লেগে ট্রেন থামার পর থেকে আর তাদের খুঁজে পাচ্ছেন না। তাদের বাড়ি রাজবাড়ি।
গোপীবাগের ব্যাডমিন্টন কোর্টটি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রাসুলুল হক শাহীনের বাসার সামনে। অদূরেই রেললাইনে জ্বলন্ত বেনাপোল এক্সপ্রেস থামে। জ্বলন্ত সেই ট্রেন থেকে বেঁচে ফেরা যাত্রীরা সেখানে জড়ো হয়েছিলেন।
কিছু ব্যাগও কুড়িয়ে এনে সেখানে জড়ো করেছেন স্থানীয় লোকজন, যাদের মালিকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। চিৎকার, কান্না, বেঁচে ফেরার আনন্দ কিংবা আতঙ্কে যাত্রীরা। তারা পরিচিত অপরিচিত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সান্তনা দিচ্ছিলেন; কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন স্রষ্ঠাকে।
এ জটলার মধ্যেই তনিমা যেমন তার বোন এলিনা ও ভাগ্নের খোঁজে দিশেহারা হয়ে ঘুরছিলেন; তেমনি এক বাবাও তার শিশু সন্তানকে হন্যে হয়ে এদিক সেদিক খুঁজে ফিরছেন।
এরমধ্যেই গোলাপবাগ মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসছিল তিন বছরের শিশু আব্দুল্লাহকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বাবা মো. বাদশাহ শিশুটিকে খুঁজছেন। কেউ পেয়ে থাকলে যেন মসজিদে শিশুটিকে নিয়ে আসেন।
শুক্রবার রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি তার গন্তব্যস্থল কমলাপুর পৌঁছার কিলোমিটার দুয়েক আগে থেমে যেতে বাধ্য হয়। ট্রেনটির তিনটি বগি পুড়ে যায়।
বগি তিনটি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে তিনজনই একই পরিবারের, যারা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান।
ভোটের এ সময়ে বিএনপির ডাকা হরতালের আগের এ রাতে ৯টার দিকে গোপীবাগ আবাসিক এলাকার মধ্যে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে জ্বলতে দেখেন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় ব্যাগ হাতে অনেক যাত্রী হেঁটে ফিরে যাচ্ছেন। অনেকেই জড়ো হয়েছেন ওই ব্যাডমিন্টন মাঠে।
তাদের একজন আতিয়ার রহমান বলছেন, ‘ছ’ বগিতে তারা এক পরিবারের ছয়জন ছিলেন। হঠাৎ সামনে থেকে আগুন আগুন চীৎকার আসতে থাকে। এসময় ট্রেনটিও দাঁড়িয়ে যায়। তারা সবাই মিলে ট্রেন থেকে নামেন। আতঙ্ক আর তাড়াহুড়ায় কয়েকজনের ব্যাগ হারিয়ে গেছে। তাদের লোকেরা সেই ব্যাগ খুঁজতে বের হয়েছেন।
পোড়া ট্রেনটির নিচে রেললাইনের কালো পাথরের ফাঁকে ফাঁকে জানালার কাঁচের টুকরো, নারী-শিশুদের স্যান্ডেল, পোড়া কাপড়-ব্যাগসহ নানা কিছু জানান দিচ্ছিল শেষ সময়ে আতঙ্কিত যাত্রীদের বাঁচার যুদ্ধের কথা।
ট্রেনের দগ্ধ তিন যাত্রীকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলেন- চিকিৎসক কৌশিক বিশ্বাস, ব্যাংক কর্মকর্তা আসিফ মোহাম্মদ খান ও নাফিস আলম।
হাসপাতালে ব্যাংক কর্মকর্তা আসিফের বাবা আবু সিদ্দিক খান বলেন, আসিফের সঙ্গে তার স্ত্রী নাতাশাও ছিল। আসিফ বের হতে পারলেও নাতাশার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, “আগুন লাগার পর দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে আসিফ জানালা দিয়ে মাথা বের করেন। সে সময়ে লোকজন তাকে টেনে বের করতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি। ধারনা করা হচ্ছে, নাতাশা ট্রেনে রয়ে গেছে। তিনি বলেন, “আমরা এখনও নাতাশাকে পাইনি।”
আবু সিদ্দিক বলেন, তারা গেন্ডারিয়ার নারিন্দায় থাকেন। আসিফ ও তার স্ত্রী নাতাশা ফরিদপুরের ভাঙায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে আগুনের এ ঘটনার শিকার হন।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস এখন পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর দিলেও নিখোঁজের তথ্য মধ্যরাতেও বলতে পারেনি।
পুলিশের ওয়ারি বিভাগের উপ কমিশনার ইকবাল হোসেন বলছেন, চারজন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তবে কতজন নিখোঁজ রয়েছেন তা বলা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন:
‘বাচ্চা-বউ পুইড়া গেছে, বের হয়ে কী করব’
ঢাকায় বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন, নিহত ৪
বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন ‘স্পষ্ট নাশকতা’: ডিএমপি
রাজশাহীর পর সোনাগাজীতে ভোট কেন্দ্রে আগুন, স্কুলের অফিস সহকারী আটক