দিনের তাপমাত্রা হু হু করে বাড়ছে, তবে রাতে তেমন নয়। আগামী দুয়েকদিন পর হালকা ঝড়-বৃষ্টির আভাস থাকলেও তেমন সুখবর দিচ্ছে না আবহাওয়ার বার্তা।
Published : 14 Apr 2023, 10:06 PM
এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়বার এমন আবহাওয়ার মুখোমুখি ঢাকাবাসী; তপ্ত রোদ আর গরমে ঘরে-বাইরে হাঁসফাঁস অবস্থা, তাপদাহের তীব্র জ্বালাপোড়ার মধ্যেই বাংলা বর্ষবরণের দিনটি কাটল ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে।
চৈত্রের শেষ কয়েকটা দিনের অবস্থা আগাম জানান দিচ্ছিল নতুন বছরের শুরুটাও হতে যাচ্ছে তাপপ্রবাহকে সঙ্গী করে, বর্ধিত এ খরতাপ বছরের প্রথম দিনই টের পাচ্ছে নগরবাসী।
শুক্রবার বর্ষবরণের আনন্দে বেরিয়ে অসহনীয় গরম ও তপ্ত বাতাসের হলকা চামড়ায় জ্বলুনি বাড়ালে বাইরে টিকতে না পেরে নিরানন্দ মনে আগেভাগেই বাড়ির পথও ধরেছেন কেউ কেউ। নতুন বছরে ছুটির আমেজে ঈদের কেনাকাটাতেও বাগড়া বাঁধিয়েছে গরমের তীব্রতা।
বাঙালিয়ানা সাজে এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় এসেছিলেন নুসাইবা আক্তার শিমু। বর্ষবরণের ঘোরাঘুরিকে কাটছাঁট করে তার মত অনেকেই তাড়াতাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শিমু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "প্রতিবছরই তো বর্ষবরণে আসি, কিন্তু এবার গরমটা একটু বেশিই। এই রোদে ঘুরাঘুরি করা প্রায় অসম্ভব। বাসায় চলে যাব।"
আগারগাঁও এলাকায় ১০ বছর মেয়েকে নিয়ে বাংলা বর্ষবরণের আমেজে রিকশায় চড়েছিলেন শাওন-মালিহা দম্পতি। তাদের ভাষ্য, "রোদ সরাসরি যেন মাথায় এসে লাগছে। বছরের প্রথম দিন ছুটির দিন, বাচ্চা বের হতে চায়। কিন্তু যে রোদ। এটা তো বের হওয়ার পরিস্থিতি না।"
মাথার উপর গনগনে সূর্য্য ও অসহ্য গরমে শুধু বছরের প্রথম এ দিন নয়, গত কয়েকদিন ধরেই বাইরে একদণ্ড টিকে থাকাই মুশকিল। এরমধ্যেও অনেকেরই নিয়মিত কাজ বন্ধ রাখার জো নেই; সরকারি ছুটি বলে বাড়িমুখো মানুষের আছে ঈদের কেনাকাটার তাড়া।
গরমে স্বাভাবিক অবস্থাতেই যেখানে ওষ্ঠাগত প্রাণ, তার মাঝে রোজা রেখে যারা এসব কাজে নেমেছেন তারা ঘেমেনেয়ে একাকার হচ্ছেন।
আবহাওয়ার রেকর্ডও জাগাচ্ছে শঙ্কা
আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, দখিনা বাতাস নেই। সাগর থেকে উপকূল হয়ে যে বাতাস আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশের কথা সেটা আসছে না। ফলে আর্দ্রতা নেই। এতে গরমের হলকা ছুঁচের মত বিঁধছে শরীরে।
থার্মোমিটারে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার যে মান আবহাওয়া অধিদপ্তর গত পাঁচ দিন ধরে জানিয়ে আসছে তাতে এ দুইয়ের মাঝে ব্যবধান প্রায় অর্ধেক। শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪১.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে তেঁতুলিয়ায় ২০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অপরদিকে চৈত্রের তপ্তদিন পেরিয়ে বৈশাখের শুরুতেই একদশকের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আরেকটি রেকর্ড ছুঁয়েছে ঢাকা।
তাপদাহে পুড়ছে দেশ, ঢাকায় পারদ উঠেছে ৪০.২ ডিগ্রিতে
তাপপ্রবাহ নিয়ে কৃষি অধিদপ্তরের সতর্কতা
বৃষ্টি কবে? আভাস দিল আবহাওয়া বিভাগ
ছয় দশকের মধ্যে ঢাকায় এমন গরম এর আগে আরেকবার অনুভূত হয় বছর দশেক আগে। এবার সেই রেকর্ডও ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা দুয়েকদিনের মধ্যে।
বৃষ্টিহীন চৈত্রের শেষভাগে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে টানা তাপপ্রবাহের মধ্যে নববর্ষের দিন শুক্রবার রাজধানীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
১৯৬০ সালের পরে ঢাকায় এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। ১৯৬০ সালের এপ্রিলে ঢাকায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল।
আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ জানান, নিকট সময়ে ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিলেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। এর আগে ২০০৯ সালে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ছিলও এপ্রিলে ৩৯.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
পূর্বাভাস দিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, সারাদেশে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
ঢাকাতেও লু হাওয়ার মতো গায়ে বিঁধতে থাকা গরম বাতাস আর আবহাওয়ার এমন আচরণকে কেউ কেউ মরুকরণের বৈশিষ্ট্য বলছেন। তবে একে ঠিক মরুকরণ বলতে চান না ন্যাশনাল ওশানোগ্রাফিক অ্যান্ড মেরিটাইম ইনস্টিটিউটের (নোয়ামি) নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার দাশ।
তিনি বলেন, "সর্বোচ্চ, সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় অর্ধেক হলেও এটা যে একেবারে মরুকরণ তা বলা যাবে না। আর মরুকরণ হুট করে হয়েও যায় না। আবহাওয়া এমন আচরণ আগেও করেছে।"
‘গরমটা আজ টের পাচ্ছি’
রাজধানীর টেকনিক্যাল থেকে শনির আখড়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসে উঠে দরদর করে ঘামছিলেন বেসরকারি চাকুরিজীবী মশিউর রহমান। তিনি বলেন, "আমার সমস্যা হচ্ছে ডিহাইড্রেশন হচ্ছে অনেক। প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেছে। ইফতারের পর পানি খাই অনেক, স্যালাইন খাই। তবুও মনে হয় তেষ্টা মেটে না।"
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করা ধানমণ্ডিগামী লিটা বিশ্বাস বলেন, "আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকি বের হওয়া হয় কম। আজই বের হলাম। গরমটা আজ টের পাচ্ছি। তাপটা অনেক বেশি।"
টানা প্রায় এক সপ্তাহ ধরে রংপুর-সিলেট বাদে দেশের বাকি বিভাগগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। যেসব জায়গায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াচ্ছে সেখানে তা তীব্র তাপদাহে রূপ নিচ্ছে।
দখিনা বাতাসের দেখা নেই, গরমে হাঁসফাঁস
মৌসুমের উষ্ণতম দিন পার, বৈশাখের প্রথম দিনও হবে তপ্ত
ঢাকা নগরীতে ২৫ ‘হিট আইল্যান্ড’
ঢাকা, রাজশাহী, খুলনায় তীব্র তাপপ্রবাহের আভাস
তাপদাহে যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে
তীব্র এ গরমের আঁচ লেগেছে ঈদের ছুটি শুরুর আগের শেষ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নগরীর মার্কেটগুলোতে। ছোট বাচ্চা ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের কেনাকাটায় এসে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অনেককে।
এসি কিংবা ফ্যানের নিচে সময় পেলেই জিরিয়ে নিয়েছেন কেউ কেউ৷ কেউবা শরণাপন্ন হয়েছেন আখের রস, রাস্তার ধারের শরবত, আইসক্রিম, ঠান্ডা পানির।
অবস্থা বেগতিক বিক্রেতাদেরও। নিউমার্কেটের ফুটপাতে পায়জামা বিক্রির দোকান সাজিয়েছিলেন মো. আবু আনাস। দোকান চালাতেন সেলসম্যান দিয়ে।
তিনি বলেন, "এই গরমে আমার সেলসম্যানের জন্ডিস হয়ে গেছে। নিজেই এখন দোকান চালাচ্ছি। অবস্থা ভয়াবহ। পুরো দিন দোকান চালাতে পারি না।"
নিউ মার্কেটে কেনাকাটা করতে এসে গরমে নাকাল সাইদুল ইসলাম বলেন, "গরমে জান যায় অবস্থা। একটা সময় মনে হইছে যা দেখি তাই পছন্দ হচ্ছে।"
তবে ঈদের আনন্দে গরম তেমনটা গায়ে লাগছে না সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজের। তিনি বলেন, "টেম্পারেচার বেড়েছে এটা ঠিক। তবে খুব গরম লাগছে না। ঈদের আনন্দের একটা ব্যাপার আছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে তার সাথেও হয়তো আমরা মানিয়ে নিচ্ছি।"
টান পড়েছে আয়ে
গরমে স্থবির হয়ে পড়েছে শ্রমজীবীদের জীবনও। মিরপুরের পশ্চিম মনিপুরে রিকশা চালানো মো. শহীদকে দেখা গেল এক চিলতে ছায়া পেয়ে বিশ্রাম নিতে বসে পড়েছেন সেখানেই।
গরমের কারণে তার আয়ও কমেছে। মাঝবয়সী এ চালক বলেন, "প্রচুর গরম। গরমের জন্য পরে বাইর হইছি। কষ্ট হয়, কী করুম, চালানি তো লাগবোই। গরমের কারণে খ্যাপ কমছে। আগে দিনে ছয় সাতশ ট্যাকা থাকতো, এহন তিন চাইরশর বেশি থাহে না।"
শ্যামলী এলাকায় গামছায় মাথা ঢেকে ঠায় বসে থাকা সিএনজি অটোরিকশাচালক মাইন উদ্দিন বলেন, "গরম পড়তাছে মাত্র, আজকে তো পয়লা বৈশাখ সামনে আরও গরম বাড়ব। সিএনজির ভিতরে ছোট ফ্যান লাগাইছি, এই ফ্যানে কুলায় না। জ্যামে পরলে বুঝা যায় গরম কদ্দুর পড়ছে।"
এই গরমে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন ট্রাফিক ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশরাও। শিশুমেলা এলাকায় দায়িত্বরতদের একজন বলেন, "অবস্থা খুবই ভয়াবহ। ড্রেসটা খুলে দেখাইলে বুঝতে পারতেন৷ গেঞ্জি পুরো ভিজে গেছে৷ আমাদের তো কাজে কোনো কম্প্রোমাইজের সুযোগ নাই।"
আগারগাঁওয়ের নানা হাসপাতালে সেবা নিতে আসা লোকজন এদিন খুঁজছেন দুদণ্ড ছায়া। উন্নয়ন কাজ চালাতে গিয়ে এই এলাকায় গাছ কমিয়ে ফেলার অভিযোগ করলেন কেউ কেউ।
রোমান চৌধুরী নামে এক চাকরিজীবী বলেন, "গরমে পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। রাস্তার ধারে শরবত খাইলাম। তাও কুলানো যায় না।"
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু) স্বজনকে দেখতে আসা আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, "এদিকে গাছ আছিল, মাইনষে আইসা বইতো, সব গাছটি কাইট্টা মরুভূমি বানাইয়া ফালাইসে। গাছ নাই কিছু নাই গরম। এহন যদি গাছ লাগাইয়া দেয় তাইলে যদি কমে।"
নোয়ামি এর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার বলেন, "সারাদিন গরম লাগছে, ঘাম হচ্ছে না, শরীর জ্বলছে এর কারণ হচ্ছে দখিনা বাতাস নেই। সাগর থেকে উপকূল হয়ে যে বাতাস আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশের কথা সেটা আসছে না। ফলে আর্দ্রতা নেই।"
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিরুদ্ধাচরণের ফলে এমন পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আমাদের গাছপালা নেই, নদী নেই, শুধু নদীই না পুকুরের মতো যে জলজ পরিবেশ আছে সেগুলোকেও আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। ফলে বাতাসে আর্দ্রতা তৈরি হচ্ছে না।
"আপনি বাংলামটর আর হাতিরঝিল দুটো জায়গায় দাঁড়ালেই এই পার্থ্যক্যটুকু বুঝতে পারবেন। বিকিরণের মাধ্যমে আমাদের অবকাঠামোতে যে তাপ আসে, সেই তাপ অবকাঠামো তো পরিবেশেই ছাড়ে। ফলে আমাদের পরিবেশ একটা হিট বোম্বে পরিণত হচ্ছে, আর আমরা এর মাঝে বাস করছি৷"