কুড়িগ্রাম আর রংপুরের কিছু এলাকা যখন বন্যার পানিতে ভাসছে, তখন পানির জন্য হা পিত্যেশ পাশের জেলাগুলোতে।
Published : 13 Jul 2022, 01:07 AM
আষাঢ় শেষ হতে চললেও টানা বৃষ্টিহীন দিন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় জেলায় টানা বৃষ্টিহীন দিন আমন ধানের চাষিদের ফেলেছে দুশ্চিন্তায়।
আর কদিন পরেই আমন আবাদ শুরু করবেন তারা, তার আগে খটখটে শুকনো মাঠে কৃষকের ‘সর্বনাশ’ দেখছেন ফজলুল হক।
ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বীরহলি গ্রামের এই কৃষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমনের চারা রোপণের জন্য ক্ষেতে অন্তত তিন ইঞ্চি পানি প্রয়োজন। এজন্য এসময় বৃষ্টি না হলেই কৃষকের সর্বনাশ।”
বীরহলি গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ‘লাচ্ছি নদী’। শীর্ণ নদীটি বর্ষায় দুকূল উপচে আশপাশের জমিগুলোকেও প্লাবিত করে। তখনই আমন চাষে নামেন কৃষকেরা। কিন্তু এবার আষাঢ় শেষ হয়ে এলেও নদীতেও নেই পানি।
বীরহলি গ্রামের ফজলুল হকসহ কয়েকজন মিলে ২৫ বিঘা জমিতে আমন চাষের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এলাকাটি বরেন্দ্র সেচ প্রকল্পের আওতায় হলেও ওই প্রকল্পের সুবিধা পুরোপুরি পাচ্ছেন না বলে জানালেন তারা।
তাই উত্তরাঞ্চলের এই জেলাগুলোর কৃষকরা এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। খানিকটা মেঘ দেখলেই আশাবাদী হচ্ছেন, কিন্তু তা বৃষ্টি হয়ে না ঝরায় ডুবছেন হতাশায়।
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার কৃষক মো. রাজু দুদিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১১ দিন হল কোনো বৃষ্টি নেই। মাঝে মাঝে আকাশে মেঘ জমছে, কিন্তু কোনো বৃষ্টি নেই।”
আবহাওয়া অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের বুলেটিনে বলা হচ্ছে, রাজশাহী, পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার উপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।
বৃহত্তর দিনাজপুরের এই অঞ্চলটির জন্য বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস নেই আবহাওয়ার বুলেটিনে।
আবহাওয়াবিদ ড. আব্দুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম রয়েছে। আরও কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কোভিড মহামারীর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে বিশ্বের টালমাটাল অবস্থায় যখন সমূহ সঙ্কট মোকাবেলায় খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তখন আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণ দেখা যাচ্ছে।
“এমন প্রভাব কৃষিতে পড়তে পারে,” বলছেন আবহাওয়াবিদ মান্নান।
তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, আমন চারা রোপণের জন্য এখনও কয়েকদিন সময় আছে। ততদিনে বৃষ্টিতে ভিজতে পারে মাটি।
ঠাকুরগাঁও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবু হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা মনে করছি, আগামী সপ্তাহ থেকে আমন লাগানো পুরোদমে শুরু হবে। সেই হিসেবে এখনও সময় আছে।”
এখন কৃষকরা বপন করবেন রোপা আমন। আষাঢ় মাসে বীজতলায় বীজ বোনা হয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে মূল জমিতে রোপণ করা হয় এবং কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে এই ধান কাটা হয়।
আমন মৌসুমে বিআর৪, বিআর৫, বিআর১০, বিআর১১, ব্রি ধান৩০, ব্রি ধান৩২, ব্রি ধান৩৩, ব্রি ধান৩৪, ব্রি ধান৩৯, ব্রি ধান৪৯, ব্রি ধান৬২, ব্রি ধান৭৯, ব্রি ধান৭১, ব্রি ধান৭২, ব্রি ধান৭৫, ব্রি ধান৮০, ব্রি ধান৮৭ চাষিরা আবাদ বেশি করে থাকেন।
এই অঞ্চলে আবহমান কাল ধরে আমন ধানই মূল ফসল হিসেবে স্বীকৃত ছিল। সেই কারণে হেমন্ত কালে নতুন ধান ওঠার উৎসবও এই আমনের সঙ্গেই যুক্ত।
দেশে আমন মৌসুমেই সবচেয়ে বেশি ধান আবাদ হয়ে থাকে। দুই বছর আগের তথ্য অনুযায়ী, ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষে ফলন আসে দেড় কোটি টন ধান। যেখানে আউশ ও বোরো আবাদ হয় যথাক্রমে ১১ লাখ ৩৪ হাজার এবং ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে।
পানির জন্য বাড়ছে খরচ, সেটাও দুশ্চিন্তার
বৃষ্টি না হওয়ায় আমন ক্ষেত ভেজাতে উত্তরাঞ্চলের অনেক কৃষক এরই মধ্যে গভীর নলকূপ (শ্যালো মেশিন) দিয়ে সেচ দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। তবে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে উৎপাদন খরচ।
বৃষ্টি কমার প্রভাব নিয়ে আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, “এর ফলে কৃষিতে প্রোডাকশন কম হওয়া এবং খরচ বাড়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়, যা ওভারঅল ইকোনমিতে ইম্প্যাক্ট ফেলবে।”
ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের কৃষক রাজু বলছেন, স্যালো মেশিন দিয়ে আমন চাষ করা খুবই ব্যয়বহুল হয়ে যায়। সেজন্য তিনি কিছুদিন অপেক্ষা করছেন। তবে ঈদের পর আর অপেক্ষার সুযোগ থাকবে না।
তবে আর অপেক্ষা করতে চাইছেন না পীরগঞ্জের বীরহলি গ্রামের ফজলুল হক। তিনি বলেন, “এখানে শেষ বৃষ্টি হয়েছে ১৫ দিন আগে। আমরা আর কারও অপেক্ষায় থাকতে পারলাম না। স্যালো মেশিন দিয়ে সেচ শুরু করে দিয়েছি।”
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার গুয়াগাঁও এলাকায় গভীর নলকূপের পানিতে সেচ দিচ্ছিলেন আবুল কাশেম নামের একজন কৃষক।
তিনি বলেন, তিন দিন পরপর জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। একেক দিনে শুধু তেলের খরচই ৫০০ টাকার বেশি লাগছে।
ফজলুল হক বলেন, “একটি সাড়ে ১২ হর্স পাওয়ারের আরেকটি ৬ হর্স পাওয়ারের মেশিন, দুইটা মেশিনে প্রতিদিন ১১শ টাকার শুধু ডিজেল লাগে। সঙ্গে দুই মেশিনের জন্য দুজন শ্রমিক লাগে। একেকজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক হাজিরা এখন অন্তত ৫০০ টাকা। এর বেশিও আছে। চারা রোপণের সময় অন্তত ছয় বার পানি দিতে হবে।”
সামনের বিপদের কথা স্মারণ করে তিনি বলেন, “এত পানি সেচ দিয়ে পরে উৎপাদন খরচই বেড়ে যায়। পরে আবার দাম পড়ে গেলে বিপদে পড়তে হয়।”
তিনি জানান, গত বছর এই অঞ্চলের কৃষকরা বিঘায় ৩০ থেকে ৪০ মণ আমন ধান পেয়েছিলেন।
সেচে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি কর্মকর্তা আবু হোসেন বলেন, “আমন মৌসুমে এখন যে অবস্থাটা চলছে, তার জন্য প্রায় সব কৃষকেরই সাপ্লিমেন্টারি ইরিগেশনের প্রস্তুতি থাকে। পানি সেচে একটু খরচ বাড়লেও এটা এই অঞ্চলের এমন একটা ফসল যে মানুষ খরচ নিয়ে চিন্তা করবে না, ওটা আবাদ করবেই।”
অন্য খরচও বাড়ছে
সেচের পাশাপাশি সার ও কীটনাশকে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথাও বলেন কৃষক ফজলুল হক।
তিনি জানান, এই বছর ৫০ কেজি এমওপি (পটাশ) সারের বস্তা কিনেছেন ১২০০ টাকায়। গত বছর কিনেছিলেন ৭৫০ টাকায়।
প্রতি বিঘা জমিতে দুই দফায় ৫০ কেজির মতো এমওপি সার দিতে হয়।
মরক্কো থেকে আসা টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) সারের বস্তা গত বছর ছিল ১০৫০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ১২০০ টাকা। তিউনিসিয়া থেকে আসা টিএসপি সারের বস্তা গত বছর ছিল ১২০০ টাকা, এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ১৪০০ টাকা।
একেক বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি সার লাগে।
ইউরিয়া সার বস্তায় ২০ টাকা বেড়ে ৮২০ টাকা হয়েছে। ডিএপি সারের দাম বদলায়নি, এবছরও তা ৮০০ টাকা বস্তা বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া জমিতে স্বল্প পরিমাণে জিংক, বোরন ও সালফার সার ব্যবহার করেন কৃষকরা।
ফজলুল হক বলেন, জিংকের দাম গতবার ছিল ১৩৫ টাকা প্রতি কেজি, এবছর তা বেড়ে হয়েছে ২২০ টাকা। বোরন সারের কেজি গতবার ছিল ১৬০ টাকা, এ বছর হয়েছে ২৩০ টাকা। দেড়শ টাকা কেজির সালফার সার এ বছর ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আমনের খেতে অন্তত চার ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। চাষিরা কার্বোফুরান নামের একটি কীটনাশক ব্যবহার করেন। এক বিঘা জমিতে তিন থেকে চার কেজি কার্বোফুরান লাগে।
ফজলুল বলেন, এই কীটনাশক গতবছর ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি দরে কিনেছিলেন। এ বছর তার দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৫ টাকা।
ধানের ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধে প্রচলিত একটি কীটনাশকের আধা লিটার বোতলের দাম গতবার ছিল ১৪০০ টাকা। এ বছর তা বেড়ে হয়েছে ১৮০০ টাকা।
সার ও কীটনাশকের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে কৃষি কর্মকর্তা আবু হোসেন বলেন, “এটা এখনও আমরা অফিসিয়ালি বলতে পারি না যে দাম বেড়ে গেছে। সরকারিভাবে এমন কোনো ঘোষণা আসেনি। সারের বণ্টনটা হয় সরকারি তত্ত্বাবধানে। সেখানে দাম বৃদ্ধির কোনো সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়নি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত হতে পারে, সেটা আমাদের জানা নেই।”
সারের বাড়তি দা্ম যেন কৃষকদের কাছ থেকে না নেওয়া হয়, সেজন্য ডিলারদের উপর নজরদারি আরও ‘কঠোর’ করবেন বলে জানান তিনি।
“যেহেতু মৌসুমটা পুরোদমে এখনও শুরু হয়নি, ধান লাগানোর সময় থেকেই আমাদের নজরদারিটা থাকবে। আমরা চেষ্টা করব, যাতে এগুলো সরকারি মূল্যের অতিরিক্ত দামে বিক্রি না হয়।”