ওয়াংয়ের ঢাকা সফর: রোহিঙ্গাদের ফেরানোর অগ্রগতির সম্ভাবনা কতটা?

নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে গত কয়েক বছর থেকে কথাবার্তা এগোলেও বাস্তবে অগ্রগতি নেই বললেই চলে।

মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2022, 03:43 AM
Updated : 6 August 2022, 03:43 AM

মিয়ানমারের ‘ঘনিষ্ঠ’ বন্ধু হিসেবে পরিচিত চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আবারও জোর দেবে সরকার; আর বিশ্লেষকদেরও প্রত্যাশা এ বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে গতি আনতে ভূমিকা রাখবে এবারের আলোচনা।

নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে গত কয়েক বছর থেকে কথাবার্তা এগোলেও বাস্তবে অগ্রগতি নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক চাপে কয়েক দফার আলোচনায় এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

দেশটির বিশাল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বছরের পর বছর শরনার্থী শিবির পরিচালনা করতে গিয়ে আর্থ-সামাজিক চাপ সামলাতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

এ কারণে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এর এবারের ঢাকা সফরে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরতে চাইছে বাংলাদেশ সরকার।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, “রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের টপ প্রায়োরিটি এজেন্ডা। এ সফরে এই ইস্যু গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হবে।”

আর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এ সফর অগ্রগতির বন্ধ দুয়ার যেমন খুলতে পারে, তেমনি কার্যকর পদক্ষেপের জন্য মিয়ানমারের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্য দেশকেও এতে যুক্ত করা দরকার।

প্রত্যাবাসনকে বারবার পাশ কাটিয়ে যাওয়া মিয়ানমারের জন্য পরিস্থিতি এখন বেশ কিছুটা ‘পরিবর্তিত’ মন্তব্য করে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তাদের আপত্তির আবেদন খারিজ হয়ে গেছে, যুক্তরাষ্ট্র জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিয়েছে আর জাপানসহ বিভিন্ন দেশ প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিচ্ছে।

“এখন যে অবস্থা, সেই অবস্থায় কিছুটা অগ্রগতি হলে আমি তেমন আশ্চর্য হব না। এখন তো বিভিন্ন রকমের চাপের মুখে আছে মিয়ানমার সরকার। তাছাড়া, চীনও চাইবে যে তাদের আন্তর্জাতিক ইমেজটাকে যদি আরও কোনোভাবে উন্নত করা যায়।”

মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, বহু আলোচনা আর আহ্বানের পরও প্রত্যাবাসন আটকে থাকার ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দুদেশকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করে চীন।

এ কারণে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছেন সরকারের নীতি নির্ধারক, বিশ্লেষক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা এই বার্তা পেয়েছি যে মিয়ানমার যে পথে যাচ্ছে তা নিয়ে চীনেরও রিজার্ভেশন রয়েছে।”

শনিবার এমন এক সময়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং দুদিনের জন্য ঢাকায় আসছেন, তার ঠিক ১৯ দিন পর পাঁচ বছর পূর্তি হতে চলেছে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢলের।

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।

আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি।

২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হননি রোহিঙ্গারা।

চীনের সঙ্গে ২০২১ সালের জানুয়ারির ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পরের মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুই দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক হবে। কিন্তু এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির শুরুতে মিয়ানমারে অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা।

সেসময় ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে পরীক্ষামূলকভাবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো শুরুর পরিকল্পনা কথা বাংলাদেশ সরকার বললেও সেটা আর হয়নি।

ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের এক বছরের মাথায় চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’ এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

এরপর গত ১৪ জুন হয় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে বৈঠকে নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

এসব সভায় রোহিঙ্গাদের যাচাই (ভেরিফিকেশন) প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি এবং স্বেচ্ছায় ফেরানোর পথ তৈরি করতে তাদের মধ্যে আস্থা তৈরির কার্যক্রম নেওয়ার আহ্বান জানানো হয় বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান।

এক কর্মকর্তা জানান, জেডব্লিউজি’র বৈঠকের আগে পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক তথ্য মিয়ানমারের কাছে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৫৮ হাজারের কিছু বেশি মানুষকে যাচাইবাছাই করার করার কথা জানায় তারা।

যাদের ‘ভেরিফাই’ করার কথা মিয়ানমার বলেছে, সেখানেও গলদ থাকার কথা বিভিন্ন সময় তুলে ধরেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। পরিবারের দুয়েকজনকে ভেরিফাই করলেও বাকিদের বাদ রাখার বহু উদাহরণ পাওয়ার কথা জানান তিনি।

প্রত্যাবাসনে অগ্রগতির বিষয়ে এক প্রশ্নে গত মঙ্গলবার প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, “রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো অগ্রগতি নাই। মিয়ানমার তখনই রিঅ্যাক্ট করে যখন তাদের পেছনে গুলি লাগে, এমন একটা ব্যাপার আর কি।”

সামরিক সরকারকে সম্প্রতি নমপেনে অনুষ্ঠিত আসিয়ান রিজিওনাল ফোরাম থেকে বাদ দিয়ে ’শক্ত বার্তা’ দেওয়ার কথা তুলে ধরে গত বৃহস্পতিবার এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “একই সাথে চীনের স্টেট কাউন্সিলর যখন ভিজিট করছেন তার মাত্র দুই-আড়াই সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিজে) রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের প্রাথমিক রায় দিয়েছে।

“এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যখন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফরে আসছেন আমরা নিশ্চয়ই বার্তাটি দিব এবং তাদের আরও জোরালো ভূমিকা আহ্বান করব। যা হচ্ছে, প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চীনের সহযোগিতা আমরা অবশ্যই চাইব।”

এমন প্রেক্ষাপটে মহামারী আর মিয়ানমারে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের মধ্যে চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ সেভাবে না এগোলেও আশাহত না হওয়ার কথাই বললেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ।

তিনি বলেন, “চীন, আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে সাহায্য করতে পারে নাই। কিন্তু একমাত্র চীনইতো আগায় আসছে। তাদেরকে তো তাড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই আমাদের। তাদেরকে ধরে রাখতে হবে এবং তাদের কাছ থেকে যদি কিছু আদায় করতে পারি, সেটা আমাদের জন্য একটা পাওনা হবে।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ”মিয়ানমার নিজ থেকে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে নড়ে না। চাপে পড়লে তারা বৈঠকে বসে, এরপর শেষ।

“প্রথম কথা হচ্ছে রোহিঙ্গাদেরকে যেতে হবে স্বেচ্ছায়। আমরা চাচ্ছি, রোহিঙ্গাদেরকে তাদের বাড়িতে বা তাদের পছন্দমত জায়গায় পাঠাতে। কিন্তু আমাদের ধারণা, এখন তাদের গ্রাম আর তারা যে রকম রেখে আসছে, সে অবস্থায় নাই।”

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো ভূমিকা না থাকার পেছনে রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিপুল বিনিয়োগকে কারণ হিসাবে দায়ী করে থাকেন অনেক বিশ্লেষক।

রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ 'না নিয়ে' উল্টো মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়ায় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে হতাশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন।

তিনি বলেন, সত্তর ও আশির দশকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার সময় মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর সেখানে বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ ও ব্যবসা ব্যাপকহারে বেড়েছে।

উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগের তুলনা করে তিনি বলেন, "স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সমর্থন যুগিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই পাঁচ দশকে আমাদের এখানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

“কিন্তু গত পাঁচ বছরে মিয়ানমারে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা খুব হাস্যকর শোনা যায় যে, তারা কিছু জেনারেলের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।”

এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের শুধু চীনের উদ্যোগের উপর নির্ভর না করে অন্যান্য দেশকেও এর সঙ্গে যুক্ত করার পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লায়লুফার ইয়াসমীন।

তিনি বলেন, “আমরা মনে করছি, চায়নাই করতে পারবে আর কি… এভাবে করে আমরা চিন্তা করছি। শুধু চীন না আমেরিকা, রাশিয়া প্রত্যেককেই দেখতে হবে। কারণ প্রত্যেকেরই স্বার্থ মিয়ানমারের ক্ষেত্রে। এবং প্রত্যেকটা পার্টি যখন কনসেনসাসে না আসবে, তখন পর্যন্ত মিয়ানমার ইস্যুতে কোনো পরিবর্তন হবে না।

“একটা মাত্র অ্যাক্টরের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এটা সমাধান হবে, এমনটা না। আপনি দেখেন, রাশিয়া, আমেরিকা, চীন, ভারত- সবার স্বার্থ আছে এখানে। আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে মাল্টিপার্টি টক এখানে আনার।”

এক প্রশ্নে এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, “এই ইস্যুটা এখন এত ইনট্র্যাকটেবল হয়ে গেছে এখন, একটা আলোচনায় এটা সমাধান হবে, সেটা অবশ্যই না। হওয়া সম্ভবই না।

“এটাতে একটা সাসটেইন ইফোর্ট লাগবে। এই সাসটেইন ইফোর্টে আমি মনে করি, শুধু চীন দিয়ে কিন্তু হবে না।”