রোহিঙ্গা ঢলের ৪ বছর: ফেরানো আর কতদূর?

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আটকে থাকা আর তাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে বিরোধের মধ্যে পার হচ্ছে বাংলাদেশে শরণার্থী ঢলের আরেকটি বছর।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 August 2021, 05:58 PM
Updated : 24 August 2021, 06:31 PM

চলতি বছরের শুরুতে চীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের ফেরানোর প্রক্রিয়ায় আশার আলো দেখা গেলেও ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সেটি থমকে যায়।

দেশটিতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির টালমাটাল অবস্থা এবং করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সেই আলোচনাও আর সামনে এগোয়নি।

একজন রোহিঙ্গাকেও গত চার বছরে ফেরাতে না পারার হতাশার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গারা নির্যাতিত ও বাস্তুচ্যুত জনগণ, আমরা কিছুদিনের জন্য তাদেরকে এখানে আশ্রয় দিয়েছি। আমাদের অগ্রাধিকার ইস্যু হচ্ছে তারা ফিরে যাবে।

“প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারও বলেছে, তাদেরকে নিয়ে যাবে। চার বছর হল যায় নাই, তারা কিন্তু কখনও বলে নাই, নেবে না। আমাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে তাদের ফেরত পাঠানো।”

বাংলাদেশ সরকার বরাবরই প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় ভূমিকা চাইছে। তবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা ও দেশ তেমন উদ্যোগ নিচ্ছে না।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে অল্প কয়েকদিনে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী।

চার বছর আগে প্রাণ বাঁচাতে এভাবে ছুটে বাংলাদেশে আসে রোহিঙ্গারা। ফাইল ছবি

এতে আগে থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাসহ মোট শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখের বেশি, জেলার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।

রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নির্যাতনকে তখন ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী’ উদাহরণ হিসাবে বর্ণনা করেছিল জাতিসংঘ। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় ওঠার মধ্যে অনেকে একে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়।

প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার নতুন সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এখন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

তবে, সামরিক সরকার ক্ষমতা থাকার মধ্যেও দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগোনো সম্ভব বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে সরকার কক্সবাজারের ক্যাম্প থেকে ছয় দফায় প্রায় ১৯ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর করেছে।

গত এক বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গণমাধ্যমের শিরোনামজুড়ে ছিল কক্সবাজার ও ভাসানচর থেকে এই শরণার্থীদের পালানোর চেষ্টা, কক্সবাজারের ক্যাম্পে আগুন এবং ক্যাম্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড।

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির। ফাইল ছবি

আটকে আছে প্রত্যাবাসন

২০১৭ সালের রোহিঙ্গা ঢলের পাঁচ মাসের মাথায় তাদেরকে দুই বছরের মধ্যে স্বভূমে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার চুক্তি সই করে।

চুক্তির আলোকে ২০১৯ সালে দু’দফায় ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ভেস্তে যায়; রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ না থাকার কথা তুলে সে সময় যেতে রাজি হননি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

এরপর থেকে ফেরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনার বাইরে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে গত ১৯ জানুয়ারি চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকের পর চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর আশা প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ।

চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লুও জাওহুইয়ের সভাপতিত্বে বৈঠকে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা উপমন্ত্রী হাউ দো সুয়ান।

ওই বৈঠকে থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিন দেশের মধ্যে ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একইসঙ্গে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল দুই দেশের ডিজি পর্যায়ে হটলাইন চালুর।

সে সময় বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছিল, ছয় দফায় মোট ৮ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৪২ হাজারের ভেরিফিকেশন করেছে মিয়ানমার।

এরপর দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদলের পর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনাও এগিয়ে নেয়নি সামরিক জান্তার সরকার।

সামরিক সরকার এলেও অতীতে তাদের ক্ষমতায় থাকার মধ্যে দু’বার প্রত্যাবাসনের উদাহরণ এখনও আশাবাদী করছে বাংলাদেশকে।

পরিবর্তিত সরকার হলেও প্রত্যাবাসন সম্ভব জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছিলেন, “আগে যখন মিয়ানমারে সামরিক সরকার ছিল, ’৭৮ বা ’৯২ সালে, সামরিক সরকারের সময়ে প্রত্যাবাসনটা হয়েছে। এখন কেন নয়?”

এমন প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা থাকলেও প্রত্যাবাসনের জন্য সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পশ্চিমা দেশগুলোকে বলতে হবে, আপনারা আপনাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে থাকেন, কিন্তু রোহিঙ্গা বিষয়টা আলাদা করে ফেলেন। যেহেতু সব মাধ্যমে বলেছে একটা জেনোসাইড কিংবা মানবতা বিরোধী অপরাধ হয়েছে…

”আপনারা যদি আইনকানুন, নিয়ম, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কথা বলেন, তাহলে আপনারা আপনাদের ব্যবসা-বাণিজ্য রাখেন, কিন্তু আপনারা রোহিঙ্গাটাকে আলাদা করে ফেলেন।”

অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল সরকারকে চাপ দেওয়ার ‘একটা সুযোগ’ আছে এখন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সরকার যেহেতু অভ্যন্তরীণভাবে দুর্বল, আন্তর্জাতিক কমিউনিটি যদি বলে যে, দেখো, ঠিক আছে, আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাব, তোমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে আসো।

”বাংলাদেশের সরকার, মিডিয়া ও নাগরিকদের সব মাধ্যমে চাপটা বজায় রাখতে হবে, যাতে আলোচনা হারিয়ে না যায়। বড় আকারে আন্তর্জাতিকীকরণ আমরা করতে পারছি না, হয়ত মহামারীর কারণে। হয়ত আগামীতে পরিস্থিতি ভালো হবে।”

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেছেন, মিয়ানমার যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে অভ্যন্তরীণভাবে, তাতে রোহিঙ্গা ইস্যু এগোনোর সুযোগ বেশি নেই। স্থবিরতার কারণে বাংলাদেশ সরকার চেষ্টা করলেও লাভ নাই।

”দ্বিপাক্ষিক বলেন, ত্রিপাক্ষিক বলেন, বহুপাক্ষিকভাবে বলেন, এসব আলোচনা থমকে আছে। তবে থমকে থাকলেও আমরা যেসব বন্ধু দেশের সঙ্গে কাজ করি, তাদের সঙ্গে যদি কন্টিনিউয়াস অ্যাংগেজমেন্ট রাখি, কারণ যখনই মিয়ানমারের পরিবেশ অনুকূল হবে, তখনই যেন চাপটা বজায় রাখতে পারি।

”এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টা ত্বরান্বিত করতে পারি। সেজন্য আমাদের সক্রিয় থাকতে পারি। কাজেই মিয়ানমার না হলেও অন্য বন্ধুদের সাথে সক্রিয় যোগাযোগ রাখতে পারি, প্রয়োজনে শক্তিশালী করতে পারি।”

প্রত্যাবাসন আটকে থাকার মধ্যে রোহিঙ্গাদের জীবনমান নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রস্তাব সম্প্রতি নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ।

শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশে অন্তর্ভুক্ত করাসহ একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাবসহ ’রিফিউজি পলিসি রিফর্ম ফ্রেমওয়ার্ক’ নামে ১৬টি দেশের শরণার্থী ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটি।

সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয় থেকে ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়ে মতামত চেয়ে ৩০ জুন তা অর্থমন্ত্রী বরাবর পাঠানো হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রতিবেদনে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, কাজ করা, চলাফেরা, জমি কেনা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত হওয়াসহ সব ধরনের আইনি অধিকার শরণার্থীদের দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

“আমরা রিপোর্টটা- যেহেতু প্রথমত এরা (রোহিঙ্গারা) শরণার্থী না- আমরা পুরোপুরি রিজেক্ট করেছি।”

সরকারের এমন প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয় বলেছিল, এটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন, সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য নয়।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়নের দুই বছর পূর্তিতে কক্সবাজারে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে সমাবেশে রোহিঙ্গারা। ফাইল ছবি: কেএম আসাদ

কী বলছে ইউএনএইচসিআর

প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এক প্রশ্নে ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র হান্নাহ ম্যাকডনাল্ড বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরতে চায় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। এটা সম্ভব করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই উদ্যোগ বাড়াতে হবে, যাতে তারা অন্য কোথাও সুরক্ষা ও নিরাপত্তা চাইতে বাধ্য না হয়।

এক্ষেত্রে তাদের মাতৃভূমি মিয়ামনারে বাস্তবিক ও যথাযথ অগ্রগতির পাশাপাশি চলাচলের স্বাধীনতা, নিজ গ্রামে ফেরা, নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পথনির্দেশ এবং তাদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চিত হওয়ার উপর জোর দেন তিনি।

হান্নাহ ম্যাকডনাল্ড বলেন, “মিয়ানমারে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকার সময়ে শরণার্থীদের জন্য সম্মানজনক জীবন ও বাংলাদেশে অবস্থানের একটা উদ্দেশ্য তাদের সামনে থাকতে হবে।

“জীবিকার ব্যবস্থা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ তা নিশ্চিত করতে পারে। পাশাপাশি পরিবেশ নিরাপদ হলে তাদেরকে মিয়ানমারে টেকসই অন্তর্ভূক্তির জন্য প্রস্তুত করাও দরকার।”

ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে ইউএনএইচসিআর মুখপাত্র বলেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ২০১৮ সাল থেকে ’গঠনমূলকভাবে’ কাজ করছে জাতিসংঘ। মার্চে ওই দ্বীপে জাতিসংঘ প্রতিনিধিদলের পরিদর্শনের ধারাবাহিকতায় সেখানকার কার্যক্রমে সংস্থাটির সম্পৃক্ত হওয়ার আলোচনা চলে।

“মানবিকতার নীতি ও বিদ্যমান সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে ভাসানচরে সরকারের কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আলোচনা চূড়ান্ত করেছি আমরা।”

সমঝোতা চুক্তি চূড়ান্ত ও সই হওয়ার পর পরিচালন পরিকল্পনা ও রিসোর্চ মোবিলাইজেশনের কার্যক্রম আলোচনা চালানো হবে বলে জানান তিনি।

১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসানচরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফাইল ছবি

সেপ্টেম্বরে ভাসানচরে ‘সম্পৃক্ত হচ্ছে’ জাতিসংঘ

প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার যে কার্যক্রম সরকার হাতে নিয়েছে, অবশেষে তাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ।

রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর শুরুর ১০ মাসের মাথায় আগামী সেপ্টেম্বর থেকে সংস্থাটি ভাসানচর কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

রোববার সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “বর্তমানে ভাসানচর নিয়ে জাতিসংঘের চুক্তিটি আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখান থেকে ছাড় হয়ে আসলে এ সপ্তাহে না হলেও আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এটি সই হওয়ার জন্য চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে জাতিসংঘকে ভাসানচরের মানবিক কার্যক্রমে পাওয়া যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও এর বাইরে অবস্থান করা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসান চরে স্থানান্তরের কার্যক্রম শুরু করে সরকার।

১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতার মধ্যে গত ৪ ডিসেম্বরে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করা শুরু হয়। এ পর্যন্ত ছয় দফায় ১৮ হাজার ৩৩৪ জন শরণার্থীকে স্থানান্তর করেছে সরকার।

স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরুর সাড়ে তিন মাস পর ১৭ মার্চ প্রথমবারের মতো ভাসানচর পরিদর্শনে যায় জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধি দল।

এরপর ১০ বিদেশি দূতকে ভাসানচরে ঘুরিয়ে আনে সরকার। এই দুদলের বাইরে কেবল ওআইসির সহকারী মহাসচিবের নেতৃত্বে সংস্থার একটি প্রতিনিধি দল ভাসানচর পরিদর্শনে গিয়েছিল। 

পরবর্তীতে চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ সফরে এসে ভাসানচরের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সহকারী কমিশনার গিলিয়ান ট্রিগস (সুরক্ষা) ও সহকারী কমিশনার (অপারেশনস) রাউফ মাজৌ।

ভাসানচর নিয়ে কালক্ষেপণের জন্য জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “আন্তর্জাতিক কমিউনিটি এতদিন ভাসানচর নিয়ে ছিল, বোঝাই যাচ্ছিল অন্য একটা বিষয় নিয়ে ছিল, এখনতো মেনেই নিয়েছে।

”খামোখা সময় নষ্ট করল, মিয়ানমারের সঙ্গে কিছু পারছে না, বাংলাদেশের উপর দিয়ে কথাবার্তা বলে যাচ্ছে। কিন্তু ২০ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ তো এক না। ইউএনএইচসিআর না থাকলেও ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে রাখতে পারবে। হয়ত অন্য দিকে ঝামেলা হবে, খাইয়ে পরিয়ে রাখতে পারবে।”

তিনি আরও বলেন, “কিন্তু ইউএনএইচসিআর যদি না থাকে, তাহলে তার ম্যান্ডেটই থাকে না। তাকে তো বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ এত এত রোহিঙ্গা, তোমরা নাই। সরকার অ্যাডামান্ট হওয়ায় তারা সম্পৃক্ত হচ্ছে এখন।”

এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “ভাসানচরের বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিমত থাকলেও এখন সেটা গ্রহণ করেছে। এখন তাদের সেখানে জরুরি সম্পৃক্ত হওয়া জরুরি।”

কক্সবাজারে বালুখালী শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গারা। ফাইল ছবি

রোহিঙ্গাদের পালানো ঠেকাতে…

চলতি মাসে ভাসানচরে থেকে পালানোর চেষ্টাকালে সলিল সমাধি হয়েছে অন্তত ১১ জন রোহিঙ্গার। এছাড়া সেখান থেকে গত ১০ মাসে পালানোর চেষ্টা করে আটক হয়েছেন কয়েকশ জন।

ভাসানচর থেকে পালানো ঠেকাতে সেখানে তাদের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন ও অধ্যাপক ইমতিয়াজ।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আশা জিইয়ে রাখতে চাষবাস, মাছ ধরাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু রাখা জরুরি। দোকান-খুলে দেওয়া, সেলাইয়ের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কৃষিবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও হতে পারে।

”এ ধরনের কাজগুলো সরকারি উদ্যোগে যদি সম্ভব হয় করলাম, আর না হয় আমাদের এখানে অনেক এনজিও আছে, যাদেরকে এই কাজে লাগানো যায়। এবং আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুরা যারা আছে, ইউনাইটেড ন্যাশনস বলেন, ইউএনডিপি বলেন, তাদের নিয়েও করা যায়। হবে হবে না বলে দ্রুততার সাথে শুরু হওয়া দরকার।“

তিনি বলেন, “মানুষগুলোর সামনে আশা তৈরি করতে হবে, যাতে তারা হতাশ না হয়ে যায়।

”তাহলে যতক্ষণ তারা বাংলাদেশে থাকবে, ততক্ষণ ইতিবাচক জায়গায় থাকবে, যখনই সময় আসবে তাদেরকে দ্রুত সময়ের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাব।”

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পালাক্রমে এনেও প্রশিক্ষণ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা যেতে পারে বলেও মনে করেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ।

তিনি বলেন, “ভাসানচরে যদি তাদেরকে কর্মসংস্থানে নিয়ে আসা যায়, তাহলে তাদের দিয়ে খরচ মেটানো যাবে।

”পালাক্রমেও যদি হয়, যে এক লাখ গেল, তারা ছয় মাস থেকে আবার ছয় মাস অন্য এক লাখ এলো, এভাবে পালাক্রমে হতে পারে। তাহলে একটা কর্মকাণ্ডের মধ্যে থাকল। ১০ লাখ তো রয়েই যাবে কক্সবাজারে।

আরও পড়ুন