রোহিঙ্গা সঙ্কট: 'বন্ধু' রাষ্ট্রগুলোর ব্যবসায়ী মনোভাবে মোমেনের হতাশা

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "২০১৭ সালের পর মিয়ানমারে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ ও ব্যবসা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।"

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2022, 03:11 PM
Updated : 28 July 2022, 03:11 PM

রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ 'না নিয়ে' উল্টো মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়ায় হতাশা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

বৃহস্পতিবার ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে (আইইউবি) একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এ অভিযোগ করেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, "সত্তর ও আশির দশকে রোহিঙ্গাদের যখন ফিরিয়ে নিয়েছিল মিয়ানমার, তখন তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর মিয়ানমারে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ ও ব্যবসা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।”

২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কিছু স্থাপনায়‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেইসঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গাদের ঢল।

জাতিসংঘের একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী অভিযানের পর ৭ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাদের কথায় উঠে এসেছে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়েরভয়াবহ বিবরণ।

মিয়ানমারের এই নির্যাতন ছিল ‘গণহত্যামূলক কাজ’। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওইঅভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে

আব্দুল মোমেন বলেন, "স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে আমাদের সমর্থন যুগিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই পাঁচ দশকে আমাদের এখানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

“কিন্তু গত পাঁচ বছরে মিয়ানমারে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা খুব হাস্যকর শোনা যায় যে, তারা কিছু জেনারেলের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।”

রাখাইন রাজ্যে পাঁচ বছর আগে দমনমূলক সেনা অভিযানের ঘটনায় দেশটির বেশ কজন জেনারেলের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা।

মিয়ানমারে ইউরোপের বিনিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমাদের অনুমান হচ্ছে, জাতিগত নিধনের উদাহরণ তৈরির পর থেকে মিয়ানমারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিনিয়োগ ২-৩ গুণ থেকে ১৫ গুণ বেড়েছে।”

মোমেন বলেন, "প্রায় পাঁচ বছর হতে চললেও একজন রোহিঙ্গাও তাদের ভিটেমাটিতে ফিরে যায়নি। এর মধ্যে অনেক মুখের কথা আমরা শুনেছি কিন্তু তারা যায়নি। এটা হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টদায়ক দিক।"

জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও এই জনগোষ্ঠী কেবল বঞ্চিতই হয়েছে এবং বছরের পর বছর তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

“এরপরও এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসব ঘটনাকে অগ্রভাগে নিয়ে আসেনি। দেখে মনে হয়, এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের দুর্বলতা রয়েছে।”

আসিয়ান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করার আশ্বাস পাওয়ার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের মাধ্যমে একটি সভাও হয়েছে।

“মিটিংগুলোতে মিয়ানমার এটা-সেটা বলে, কিন্তু তারা কখনো বলেনি ওদেরকে ফেরত নেবে না। এটা তাদের বাইরের চেহারা। কিন্তু আমাদের তাদের অন্য চেহারা আমরা জানি না।”

রোহিঙ্গাদের দ্রুত সময়ে ফেরাতে না পারলে এই অঞ্চলে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়বে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এটা কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয়, এটা বিশ্ববাসীর বিষয়।

"কিন্তু বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনায় তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার পর বিশ্ব নেতারা এক্ষেত্রে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।”

অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) শাব্বির আহমেদ চৌধুরী বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট কেবল সমাধান হয়নি তা নয়; আমরা আসলে জানি না এই সমস্যা কখনো আসলে সমাধান হবে কি-না।

এই সংকটকে 'বেশ জটিল' অভিহিত করে তিনি বলেন, “এটা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিষয় নয়। আমাদেরকে আরও গবেষণা করতে হবে, যাতে আমরা যথাযথ একটা সমাধান বের করতে পারি।

“ক্ষমতাধর দেশগুলোও রয়েছে মিয়ানমারের পেছনে। আমরা বড় কোনো সাফল্য অর্জন করতে না পারার এটাও একটা বড় কারণ।”

বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি ইয়োহানেস ফন ডেয়ার ক্লাউভ অনুষ্ঠানে বলেন, “এখন ৯ লাখের বেশি নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ক্যাম্পগুলোতে আছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বোঝা ও চ্যালেঞ্জের।

"বাংলাদেশকে এই অবস্থায় একা ফেলে রাখা যাবে না। কারণ, শরণার্থী সংকট কেবল আশ্রয়দাতা দেশের দায়িত্ব নয়। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”

রোহিঙ্গা ইস্যুকে কঠিন সংকট উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এর গোড়ার কারণগুলো আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে, আর সেটা মিয়ানমারেই রয়েছে। সেখানে তাদেরকে নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি, অধিকার, সেবাগ্রহণের সুযোগ ও নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।”

তাদের সেই অধিকার নিশ্চিতে কূটনৈতিক ও সম্মিলিত রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আইইউবি প্রকাশিত "রোহিঙ্গা ক্যাম্প ন্যারেটিভ: টেলস ফ্রম দ্য 'লেসার রোডস' ট্রাভেলড” শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থের উন্মোচন অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য তহবিল গঠনের কথা তুলে ধরে আইইউবি উপাচার্য তানভীর হাসান বলেন, “প্রানবস্ত একটি গবেষক সম্প্রদায় পেতে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের সংযোগ ঘটানো জরুরি।

"শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীরাও গবেষণা প্রকাশ করছে, এটা আমার জন্য বেশ উৎসাহব্যঞ্জক।”

তিনি জানান, সমাজ, সরকার ও বিদ্যায়তনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার জন্য আইইউবি কাজ করে যাচ্ছে।

আইইউবির গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ এ. হোসেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত বইয়ের ১৩টি অধ্যায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণাকর্মের পাশাপাশি বিশ্লেষককের লেখাও স্থান পেয়েছে।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক করীম, আইইউবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল হাই সরকার, রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বক্তব্য দেন।