কংগ্রেসে তোলা প্রস্তাবটি পাস করতে অন্যান্য কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে বাংলাদেশি কমিউনিটিকেও যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
Published : 30 Oct 2022, 11:49 AM
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের উপর পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে মার্কিন কংগ্রেসে তোলা প্রস্তাব পাসের আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
শনিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে ‘হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস’ (এইচআরসিবিএম) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইডের’ স্বীকৃতি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত ১৪ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় প্রস্তাব আনেন কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট।
ওই প্রস্তাব পাসের দাবি জানিয়ে আয়োজক সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক প্রিয়া সাহা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা দুই লাখ নারীকে ধর্ষণ, ৩০ লাখ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তাদের নিপীড়নে এক কোটি মানুষ ঘরহারা হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল।
“পাকিস্তানি সেনারা ১ হাজার ১০০ জন বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, অধ্যাপক, পদার্থবিদ, আইনজীবী এবং লেখককে হত্যা করেছে। বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন সময়ের ১ হাজার ৯৪২টি গণকবর পাওয়া গেছে।”
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তাকারী যুদ্ধপরাধীদের বিচারের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে বাংলাদেশ সরকার। এ পর্যন্ত ৪৯ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। বর্তমানে ৫০০টিরও বেশি ঘটনা তদন্তাধীন রয়েছে এবং ৩৬টি মামলা আদালতে চলমান রয়েছে।”
একাত্তরে নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞকে জেনোসাইডের স্বীকৃতির দাবিতে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে তোলা রেজলুশন ‘এইচ.রেজ.১৪৩০’ পাসের আহ্বান জানান তিনি।
ভূ-রাজনীতি ও ইন্দোপ্যাসিফিক সম্পর্কের ওপর ঐতিহাসিক এই রেজলুশনের প্রভাব নিয়েও সংবাদ সম্মেলনে আলোচনা করেন বক্তারা।
মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্য শ্যাবট ওই প্রস্তাব আনার পর টুইটে লিখেছিলেন, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যা কোনোভাবেই ভুলতে দেওয়া যাবে না। ওহাইওর ফার্স্ট ডিস্ট্রিক্টের আমার সহকর্মী রো (রোহিত) খান্নার সহযোগিতায় আমি বাঙালি ও হিন্দুদের উপর চালানো সেই সুনির্দিষ্ট গণ-নৃশংসতার স্বীকৃতি আদায়ে প্রস্তাব পেশ করেছি।”
রোহিত খান্না টুইটে বলেন, এই ধরনের একটি প্রস্তাব কংগ্রেসে প্রথম আনার ক্ষেত্রে স্টিভ শ্যাবোটের সহযোগী হতে পেরে তিনি গর্বিত।
ওই প্রস্তাব পাসের দাবি জানিয়ে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কের এমিরেটাস অধ্যাপক সাচী জি. দস্তিদার গণহত্যা ও চরম দুর্দশার পারিবারিক অভিজ্ঞতা স্মরণ করেন সংবাদ সম্মেলনে।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক দ্বিজেন ভট্টাচার্য কংগ্রেসে এই প্রস্তাব আনা দুই কংগ্রেসম্যানের প্রশংসা করেছেন। দ্বিজেন ভট্টাচার্য যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
মিয়ামি কনস্যুলেটে বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল এসএম আলম মার্কিন আইনসভায় এই রেজলুশন পেশ করায় কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট ও রো খান্নাকে ধন্যবাদ জানান। এটি পাস করতে অন্যান্য কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ফোরাম অব ফ্রিডম এক্সপ্রেশনের সাধারণ সম্পাদক সালিম সামাদ, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ কমিউনিটির নেতা দিলিপ দেবনাথ, বালুচ হিউম্যান রাইটস সংগঠনের রাজ্জাক বালুচ, সিন্ধি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মুনাওয়ার ‘সুফি’ লাগারি, গোল্ড ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজির মিডিয়া ফেলো আদেল নাজারিয়ান উপস্থিত ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে।
এর আগে একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের উপর চালানো পাকিস্তানিদের বর্বরতাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘জেনোসাইড ওয়াচ’।
পাকিস্তানিদের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সেখানে বলা হয়, জেনোসাইড ওয়াচ এই স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাঙালিদের ওপর যেসব অপরাধ করেছে, তার মধ্যে ছিল ‘জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ’।
সেসব অপরাধ ও জেনোসাইডের ঘটনাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করে নিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বান জানিয়েছে জেনোসাইড ওয়াচ।
তার আগে চলতি বছরের প্রথম দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’ একাত্তরে বাংলাদেশিদের উপরে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান; শুরু হয় বাঙালির প্রতিরোধ পর্ব।
নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়। তখন থেকেই এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
আরও খবর:
একাত্তরের জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে প্রস্তাব