রানা প্লাজা ধস: বিচার শেষ হয়নি ১০ বছরেও

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 April 2023, 11:17 AM
Updated : 24 April 2023, 11:17 AM

সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত বিধির মামলার বিচার শেষ হয়নি এক দশকেও।

উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর গত বছর হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এরপর বিচারে কিছুটা গতিও আসে। তবে ইমারত বিধি না মেনে ভবন তৈরির মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে।

রানা প্লাজা ধসের পরপর বেশ কয়েকটি মামলা হলেও এ দুটিই মূল মামলা। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে অধিকাংশ আসামি জামিনে বা পলাতক রয়েছেন।

মামলার মূল আসামি সোহেল রানাও সম্প্রতি হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন। তবে আপিল বিভাগ সেই জামিন স্থগিত করে দেওয়ায় এখনো মুক্তি পাননি তিনি।

মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে দুটি অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।

এর একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয়। আর ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে অপর অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুই অভিযোগপত্রে মোট আসামি ছিলেন ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। আসামিদের মধ্যে তিনজন ইতোমধ্যে মারা গেছেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। ওই ভবনে থাকা কয়েকটি পোশাক কারখানার ৫ হাজারের মতো শ্রমিক তার নিচে চাপা পড়েন।

কয়েকদিনের উদ্ধার তৎপরতায় ১ হাজার ১৩৬ জনের লাশ তুলে আনা হয়। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক আহত ও পঙ্গু হন।

ঘটনার পাঁচদিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে সোহেল রানাকে যশোরের বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণে গতি

মূলত ঢাকার জেলা ও দায়রা আদালতের নতুন বিচারক এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া এবং রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলি বিমল সমাদ্দারের উদ্যোগেই এ মামলা গতি ফিরে পায়।

এর আগে অভিযোগ উঠেছিল, কয়েকজন আসামির আবেদনে উচ্চ আদালত থেকে দেওয়া স্থগিতাদেশের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে জজ আদালতে আসছে না, দিনের পর দিন তা পড়ে থাকছে।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে হত্যা মামলার বিচার শুরুর আদেশ দেন।

এ মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবন মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কলু খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন এরইমধ্যে মারা গেছেন।

অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন মামলা বাতিল চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। তাদের আবেদনে হাই কোর্ট মামলার কার্যক্রম স্থগিত করে রুল জারি করে।

উচ্চ আদালতের ওই স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। সম্প্রতি মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়।

অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

গত এক বছরে মামলাটিতে ৪৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে উচ্চ আদালতের আদেশ বার বার চিঠি দিয়ে অবগত করার পর স্থগিতাদেশ বাতিলের আদেশ নিয়ে আসি। আমি ব্যক্তিগতভাবে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে গিয়েছিলাম।

“সম্ভবত আরো দুই জন আসামির স্থগিতাদেশ রয়ে গেছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের আদশে সম্পর্কে এখনো কোনো খবর পাইনি।”

কবে নাগাদ মামলাটির বিচার শেষ হবে বলে আশা করছেন জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমাদ্দার বলেন, “এ মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ৫৯৪ জন। প্রায় ছয় বছর উচ্চ আদালতের আদেশে বিচারকাজ স্থগিত ছিল। গত বছর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর এক বছরে প্রায় অর্ধশত সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। প্রতি মাসেই তারিখ হচ্ছে। আমরা ১০/১৫ জন সাক্ষীর প্রতি কোর্ট থেকে সমন ইস্যু করছি।

“অনেক সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার সময় তাদের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হলেও তারা এখন সেই ঠিকানায় থাকছেন না। অনেকে অসুস্থ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন বলে আদালতে আসতে পারছেন না। তবুও প্রতি তারিখে অন্তত ৫/৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিচ্ছেন। সাক্ষী এলে কাউকে ফিরিয়ে

দেওয়া হচ্ছে না।”

রানার পক্ষে হাই কোর্টে আইনজীবী ছিলেন সাবেক আইন মন্ত্রী কামরুল ইসলাম, আর জজ আদালতে ছিলেন ফারুক আহাম্মদসহ কয়েকজন।

ফারুক বলছেন, মামলা মামলার গতিতে চলুক, তাতে তাদের আপত্তি নেই। তবে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকা আসামির জামিন পাওয়ার অধিকার আছে।

সাত বছর ধরে স্থগিত ইমারত বিধির মামলা

রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় মামলা করেন।

২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এরপর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৬ সালের ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার

জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ এবং সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে।

অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল্লাহার আবেদনে তার ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় হাই কোর্ট। ফলে দীর্ঘদিনেও এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি বলে জানান অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল।

তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দাখিলের জন্য সোমবার দিন ধার্য রয়েছে।

দুদকের দুই মামলায় রায়

রানা প্লাজা ধসের পর সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে তিনটি মামলা করে দুদক। যার মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। ওই মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে আদালত।

এছাড়া ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা রয়েছে।