রানা প্লাজা ধস: মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ আটকে স্থগিতাদেশে

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যার অভিযোগ এনে করা মূল মামলাটির বিচার শুরু হয়নি পাঁচ বছরেও।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2018, 06:51 PM
Updated : 23 April 2018, 06:58 PM

ঘটনার পঞ্চম বছর পূর্তিতে মামলাটির নথিপত্র ঘেঁটে বহুল আলোচিত এই ঘটনায় আদালত কর্মকর্তা ও পুলিশের অবহেলার নজির পাওয়া যায়।

ঢাকার আদালতে বিচারাধীন মামলাটির রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি খন্দকার আব্দুল মান্নানের কাছে সোমবার সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি।

সাত আসামির আবেদনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় হাই কোর্টের স্থগিতাদেশ আসাকে কারণ দেখান তিনি।

অ্যাডভোকেট মান্নান একইসঙ্গে বলেন, “হাই কোর্টে যাদের মামলা স্থগিত হয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী ছাড়া বাকি সবার মামলার কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ উঠে গেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।

“কিন্তু হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে আমরা এখনও স্থগিতাদেশ খারিজের আদেশটি পাইনি। যে কারণে আমরা সাক্ষ্য নিতে পারছি না।”

নথিপত্রে দেখা যায়, এখন শুধু আসামি মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম আগামী ১২ মে পর্যন্ত স্থগিত রয়েছে।

এই সাত আসামির মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আবু বকর সিদ্দিক মারা যান। তার বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ায়। ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু সংবাদ তার আইনজীবী বিচারককে জানালে নিয়ম অনুযায়ী এ বিষয়ে পুলিশের কাছ থেকে তথ্য চেয়ে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।

পুলিশ তারিখের পর তারিখ পার করে কিছু দিন আগে আবু বকরের মৃত্যু নিশ্চিত করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়।

বিচারের দাবিতে এখনও পথে নামে শ্রমিক সংগঠনগুলো

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম এই ভবন ধসের ঘটনাটি ঘটে। ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা নামে এই ভবনে ছিল বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা।

ভবনটির ধ্বংসস্তূপ থেকে ১ হাজার ১৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত হন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক, যাদের অনেকে পঙ্গু হয়ে যান। দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

বিশ্বজুড়ে তোলপাড় তোলা এই ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে মামলা করেন।

দুই বছর পর ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে।

৪১ আসামির মধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা গেছেন। দুজনকে বাদ দিয়ে এখন আসামির সংখ্যা ৩৯ জন।

ধসে পড়ল রানা প্লাজা (ঘটনার দিন)

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিলেও সেখানেই আটকে আছে মামলা।

নথিপত্রে দেখা যায়, অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১১টি তারিখ পার হলেও বাদীসহ রাষ্ট্রপক্ষের অন্য সাক্ষীরা এসে ফিরে যাচ্ছেন।

গত ১৫ এপ্রিল  সাক্ষ্য গ্রহণের সর্বশেষ ধার্য দিন ছিল। বিচারক কুদ্দুস জামান আগামী ১৬ মে  পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছেন।

মামলার আসামিদের মধ্যে তিনজন মো. শাহ আলম মিঠু, মো. আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে প্রধান আসামি সোহেল রানাকে পালাতে সহযোগিতার জন্য দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় অভিযোগ আনা হয়। বাকি ৩৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ গঠন করা হয়।

আসামিদের মধ্যে সোহেল রানা কারাগারে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন মাহবুবুর রহমান, কামরুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম, রেজাউল করিম, নান্টু কন্ট্রাকটর ও নয়ন মিয়া।

রানার বাবা আব্দুল খালেক ও মা মর্জিনা বেগমসহ বাকি আসামিরা জামিনে রয়েছেন।

ইমারত নির্মাণ আইনে মামলাও আটকে

ভবন ধসের এই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা মামলাটির খবর নিতে গেলে ওই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, এটিরও সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না।

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করেন। রিভিশন মামলাটির আদেশ না পাওয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না। তারিখের পর তারিখ চলে যাচ্ছে।”

ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় মামলাটি করেছিলেন।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। প্রায় দুই বছর আগে অভিযোগ গঠন হয়েছে। কিন্তু সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে না।

সম্পদের মামলায় রানা-মার শাস্তি

সোহেল রানা ও তার বাবা-মার বিরুদ্ধে আরও মামলা করা হয়। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় সাজা হয়েছে রানা ও তার মায়ের।

রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা

সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় রানার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়।

২০১৭ সালের ২৯ অগাস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস এ রায় দেন।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মামলায় রানার মা মর্জিনা বেগমকে ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার সম্পদের ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা বাজেয়াপ্ত করেন বিচারক। গত ২৯ মার্চ জজ ইমরুল কায়েস এ মামলারও রায় দেন।

ঢাকার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, রানার বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা ও মাদকের মামলাও বিচারাধীন।