দেশে গত এক মাসে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের ৮০ শতাংশের দেহেই করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ধরন ওমিক্রন পাওয়া গেছে বলে আলাদা দুটি গবেষণায় উঠে এসেছে।
Published : 10 Feb 2022, 07:27 PM
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর সারাদেশে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) নিজ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নমুনায় এমনটা দেখতে পেয়েছে।
আইইডিসিআর এর অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে গত ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে সংগ্রহ করা নমুনার জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্সের ফলাফল তুলে ধরা হয়।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির বুধবারের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশের ৮ বিভাগ থেকে ২৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৮৩টি নমুনা নেওয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগ থেকে।
চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে ৫১, রাজশাহী থেকে ৩৪, খুলনা থেকে ২৬, বরিশাল থেকে ১৫, সিলেট থেকে ১০, রংপুর থেকে ১৪ এবং ময়মনসিংহ থেকে ৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “এর মধ্যে ১৪৮টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে। ১১৮টি নমুনায় করোনাভাইরাসের ধরন ওমিক্রন পাওয়া গেছে, যা ৮০ শতাংশ। বাকি ৩০টি নমুনায় অর্থাৎ ২০ শতাংশ নমুনায় মিলেছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।”
ওমিক্রনের মধ্যে দুটি সাব ভ্যারিয়েন্ট বা উপধারা পাওয়া গেছে। সিকোয়েন্স করা মোট নমুনার মধ্যে ৩৯ শতাংশ উপধারা বিএ.১ এবং ৪১ শতাংশ বিএ.২ উপধারা পাওয়ার কথা জানিয়েছে আইইডিসিআর।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওমিক্রনের বিএ.২ সাব ভ্যারিয়েন্ট বিএ.১ থেকে বেশি সংক্রমণ করে।
“বিএ.১ যখন প্রাধান্য বিস্তার করছিল তখন সংক্রমণ চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে কমে যায়। কিন্তু বিএ২. ভ্যারিয়েন্ট প্রমিনেন্ট থাকলে ৭ থেকে আট সপ্তাহ লাগে কমতে। এ কারণে সংক্রমণটা ধীরে ধীরে কমবে।”
করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকে মনে করেন, টিকা নিলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হয় না, এটা ভুল ধারণা।
“টিকা নিলে সিভিয়ারিটি কমবে, হাসপাতালে রোগী কমবে এবং মৃত্যুর সংখ্যা কমবে। কিন্তু সংক্রমণ হবে না, এমন নয়। এ কারণে টিকা নিতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানলে যে কোনো ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।”
বিএসএমএমইউ’তে ভর্তি কোভিড রোগীর ৮৮ শতাংশই ওমিক্রন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষণায় পাওয়া ফলাফলে বলা হয় গত এক মাসে হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া কোভিড রোগীর ৮৮ শতাংশই ওমিক্রনে আক্রান্ত।
বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডা. মিলন মিলনায়তনে উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ ‘জিনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্ট’ এর ফলাফল পর্যালোচনা করে এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, গত ৯ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড- ১৯ আক্রান্ত ৯৩৭ জনের নমুনার জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্স করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
হাসপাতালে ভর্তি এবং বহির্বিভাগের রোগী মিলিয়ে ওমিক্রন আক্রান্তের সংখ্যা তুলে ধরে উপাচার্য বলেন, “ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ৮২ শতাংশ এবং ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ১৮ শতাংশ পেয়েছি।
“এই সময়ে ওমিক্রনের সাব ভ্যারিয়েন্ট (উপধারা) বিএ.১, বিএ.১.১, বিএ.২ পরিলক্ষিত হয়েছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিএ.২ বেশি সংক্রামক।”
বিএসএমএমইউ উপাচার্য গত বছর ৮ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রহ করা নমুনার জিন বিন্যাস বা জিনোম সিকোয়েন্সে পাওয়া ফলাফল তুলে ধরে জানান, তখন এই উপধারাটি পাওয়া যায়নি।
শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “সংগৃহীত স্যাম্পলের ২০ শতাংশ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট ছিল। এ সময় মাত্র একটি সাব ভ্যারিয়েন্ট বিএ.১ পেয়েছিলাম এবং ৮০ শতাংশ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়।
“সে সময় আমরা পরবর্তী মাসের এই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট গুণিতক হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম।”
উপাচার্য বলেন, “ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি সংক্রামক। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট জিনোমে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট থেকে বেশি মিউটেশন পাওয়া গেছে। যার বেশির ভাগ ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে হয়েছে।
“এই স্পাইক প্রোটিনের উপর ভিক্তি করে বেশির ভাগ ভ্যাক্সিন তৈরি করা হয়ে থাকে। স্পাইক প্রোটিনের গঠনগত বদলের কারণেই প্রচলিত ভ্যাকসিনের পরেও ওমিক্রন সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়।”
এ সময় সাত মাস পনের দিন ধরে পরিচালিত ‘জেনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্ট’ টিমের প্রধান পৃষ্ঠপোষক শারফুদ্দিন গবেষণায় পাওয়া পর্যালোচনাগুলো তুলে ধরেন-
>> ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এখন বাংলাদেশের কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রধান উৎস, যেটি কিছুদিন পূর্বেও ডেলটা ছিল।
>> দুই ডোজ টিকা দেওয়ার পরও ওমিক্রনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এটা প্রমাণ করে যে, ভ্যারিয়েন্ট নয় টিকা নেওয়ায় রোগের প্রখরতা কম হয়েছে; তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছেন এমন রোগীরও ওমিক্রন পাওয়া গেছে।
>> হাসপাতালে ভর্তি রোগীর জিনোম সিকোয়েন্স করে আমরা ৬৫ শতাংশ রোগীর ওমিক্রন এবং ৩৫ শতাংশ রোগীর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছি।
>> মৃদু উপসর্গের কারণে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীদের থেকে দ্রুত সংক্রমণের প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।
>> ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এ ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে কম মাথাব্যাথা এবং সর্দির মতো উপসর্গ হয়। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা কম।
>> এই গবেষণার জেনোমিক ডেটাবেজ থেকে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
আরও পড়ুন