বিএসটিআই নিবন্ধিত পাস্তুরিত দুধে ‘মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান’ থাকার অভিযোগের পেছনে ‘আমদানিকারকদের কারসাজি’ আছে কি না- সেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
Published : 30 Jul 2019, 04:31 PM
মঙ্গলবার লন্ডন থেকে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকায় আওয়ামী লীগের বিশেষ জরুরি বৈঠকে যুক্ত হয়ে সমসায়িক বিভিন্ন প্রসঙ্গের সঙ্গে পাস্তুরিত দুধ নিয়েও কথা বলেন সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “আমি লক্ষ করলাম, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই দুধ পরীক্ষা করে একজন বলে দিল যে, দুধ ব্যবহারযোগ্য নয়। সঙ্গে সঙ্গে রিট করা হয়। সে কারণে বলে দেওয়া হয় পাঁচ সপ্তাহ দুধ ব্যবহার করা যাবে না বা পাস্তুরিত করা যাবে না!”
সরকার যখন দুধের খামার করে গ্রামের মানুষকে স্বনির্ভর হতে উৎসাহিত করছে, পাশাপাশি দেশের চাহিদা মিটিয়ে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে জোর দিচ্ছে, তখনই ‘হঠাৎ এক একেটা তথ্য দিয়ে’ দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির পথে কেন ‘বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে’- সেই প্রশ্ন রাখেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “এখানে আমার মনে হচ্ছে আমদানিকারক যারা, তাদের কোনো কারসাজি আছে কি না, এটাও দেখা উচিত বা তারা কোনোভাবে উৎসাহিত করছে কি না।”
দুধে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিয়ে ‘গুজব ছড়িয়ে’ রপ্তানি কাজে সমস্যা সৃষ্টি করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “যারা এই বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত দেন, তাদেরও ভাবা উচিৎ, ভেবে দেখা উচিৎ, যে হঠাৎ একটা কথা বলে গুজব ছড়িয়ে আমাদের রপ্তানি কাজে সমস্যা সৃষ্টি করা, দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাক… এই আতঙ্ক সৃষ্টি করা বা দেশে উৎপাদিত পন্যের মান সম্পর্কে কথা বললে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
“কাজেই এইসব বিষয়গুলো ভালোভাবে জেনে তথ্য নিয়ে ব্যবস্থা করা উচিত। তবে গুজব যারা ছড়াবে বা এই ধরণের মিথ্যা তথ্যদিয়ে যারা বিভ্রান্ত করবে, তাদের উপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়াল ডিজিস রিসার্চ, বাংলাদেশ’র (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণা নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই গবেষণায় বলা হয়, বাজারে থাকা ৭৫ শতাংশ পাস্তুরিত দুধেই ভেজাল রয়েছে; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বাজারে থাকা সাতটি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে হাই কোর্ট বাজারে থাকা বিএসটিআই অনুমোদিত সব কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। সেই পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের বেঞ্চ রোববার রুলসহ আদেশ দেয়। বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত ১৪ কোম্পানির সবগুলোকেই ৫ সপ্তাহ পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ রাখতে বলা হয় ওই আদেশে। সেই সঙ্গে জনসাধারণকে পাস্তুরিত দুধ কেনা ও খাওয়ায় ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। এন্টিবায়োটিক, সীসাসহ ক্ষতিকারক উপাদান থাকায় বিএসটিআই অনুমোদিত ওই ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন কেন আইনগত কর্তৃত্ববর্হিভূত ও সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না এবং এসব দুধ পরিশুদ্ধ করে বাজারজাত করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় হাই কোর্টের রুলে। ১৪টি কোম্পানিসহ বিবাদীদের দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া বিএসটিআই নতুন করে পাস্তুরিত দুধের মানদণ্ড নির্ধারণে কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা আকরে জানাতে বলা হয়। |
“দুধ একটা পুষ্টিকর খাদ্য; আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যেন এই দুধটা খেতে পারে, আমাদের দেশের মানুষও যেন এই দুধ ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা আমরা করছি। আমাদের খাদ্যদ্রব্য এবং রপ্তানিযোগ্য পন্য যথাযতভাবে যাতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়, সেজন্য আমরা উন্নতমানের পরীক্ষাগার করে দিয়েছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, প্রতিটি খাদ্যপণ্য যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরীক্ষা করে বাজারজাত করা হয়, সে ব্যবস্থা সরকার করে দিয়েছে।
“কিন্তু হঠাৎ করে একজন প্রফেসর তার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে একটা কথা ছড়িয়ে দিয়ে, এই যে একটা রিট করা এবং একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে আসা… এর প্রকৃত ফলাফলটা কী হবে সেটা তো কেউ চিন্তা করেন না।
“কারণ এই যে দুধটা বিক্রি করে যে মানুষটা তার জীবিকা নির্বাহ করে, গরুর দুধ বিক্রি করে ওই গরুর খাবার যোগাড় করা হয়। যারা এই খামার করেছেন, যারা গরু পালন করছেন, যাদের কাছ থেকে দুধ কেনা হচ্ছে, দারিদ্র্য বিমোচনেও আমরা মানুষকে গরু কিনে দিই।
“এই মনুষগুলো যদি দুধটা বিক্রি করতে না পারে, অর্থ যোগাড় করতে না পারে তাহলে গরুকেই বা কী খাবার দেবে, আর নিজেরাই বা কীভাবে চলবে। এই বাস্তবতাটা চিন্তা করা একান্তভাবে দরকার।”
দেশে যেসব বিদেশি দুধ আমদানি করা হয়, সেগুলোও পরীক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি জানি না, যিনি আমাদের দেশের দুধ পরীক্ষা করেছেন, তিনি এই বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গুঁড়ো দুধগুলো পরীক্ষা করেছেন কি না। আমার তো মনে হয় তিনি এটা কখনও করেন নাই।
“আমি অনুরোধ করব, তিনি যেন যে দুধগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে, বাজারজাত করা হচ্ছে, প্যাকেটজাত করা হচ্ছে, সেগুলো যেন পরীক্ষা করে দেখেন। আমরা আমদানিনির্ভর থাকতে চাই না। আমরা স্বনির্ভর হতে চাই।”
গরুর শরীরে এন্টিবায়োটিক দিলে দুধে তা ‘থাকতেই পারে’- এমন মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটি গরু যদি রোগাক্রান্ত হয়, তাহলে তাকে তো এন্টিবায়োটিক খাওয়াতেই হয়, তার দুধে এন্টিবায়োটিক পাওয়া যেতেই পারে। কোনো মা যদি অসুস্থ হয়, কেউ যদি এন্টিবায়োটিক নেয়, তাহলে মায়ের দুধেও এন্টিবায়োটিক পাওয়া যেতে পারে। সেটা নিশ্চয় শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়।”
শেখ হাসিনা বলেন, বাজার থেকে কেনা দুধের প্যাকেটে মেয়াদ লেখা থাকে- কতদিন তা ভালো থাকবে। ‘প্রিজারভেটিভ’ দেওয়া হয় বলেই তা ভালো থাকে।
গুজব প্রসঙ্গ
দেশবাসীকে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। যদি কোনো মানুষকে অপরাধী মনে হয়, তাকে পিটিয়ে হত্যা করবেন না, তাকে পুলিশে সোপর্দ করুন।… এই গুজব শুনে একটা নিরীহ মানুষকে হত্যা করা, এটা যে কত বড় গুনার কাজ, কত বড় অপরাধ…।”
আশপাশে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের ধরিয়ে দিতেও দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “পত্রপত্রিকার প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে, সত্য তথ্য না জেনে আপনারা অহেতুক খবর ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেন না। সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে আপনারা অহেতুক খবর ছাড়াবেন না।”
প্রধানমন্ত্রী টেলিকনফারেন্সে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বন্যা কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, “আমি জানি, এখন দেশে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে সমস্যা চলছে। সে কারণে আমি ধন্যবাদ জানাই আমাদের পার্টির সকল নেতা কর্মী এবং দেশবাসীকে, যে তারা এ অবস্থায় অন্তত ধৈর্য্য ধরে রাখছেন।
“প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।… আমরা সব সময় যোগাযোগ রাখছি। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নিচ্ছি। দলীয় নেতাকর্মীদের বলব সবাইকে পাশে দাঁড়াতে।”
শিগগিরই দেশে ফিরবেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি হয়ত চিকিৎসার জন্য আটকা পড়ে গেছি। আমি ইউরোপে আমাদের সমস্ত এমবাসেডরদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের নিয়ে মিটিং করেছি। এখানেও কিছু নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলছি। আমি শিগগিরই চলে আসব। তাছাড়া আমাদের জাতীয় শোক দিবস পালন করব, সে কারণে তাড়াতাড়ি দেশে চলে আসব।”
সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দেশবাসীর জন্য আমার দোয়া আশীর্বাদ রইল, দোয়া আমি সব সময়ই করি। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানাচ্ছি।”
আরও খবর