এন্টিবায়োটিক ও সীসা পাওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর বাজারের গুঁড়া দুধও পরীক্ষা করে দেখা দরকার বলে মত এসেছে হাই কোর্ট থেকে।
Published : 29 Jul 2019, 08:40 PM
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়ন প্রতিবেদনের উপর শুনানিতে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার এই মত দেয়।
তবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম গুঁড়া দুধ পরীক্ষায় নির্দেশনা চাইলেও আদালত তা দেয়নি।
সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই যে ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধকে জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলছে, তার ১০টির নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চাইতে বেশি সীসার উপস্থিতি পাওয়ার কথা জানায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
গত ১৬ জুলাই ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার ভিত্তিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআই কী আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে রোববারের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম সোমবার সে বাস্তবায়ন প্রতিবেদনটিই আদালতে উপস্থাপন করেন।
শুনানিতে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “আমরা শুধু বাজারের খোলা ও তরল দুধ নিয়ে ব্যস্ত আছি। গুঁড়া দুধে কী আছে, সেটিও দেখা দরকার। আমরা চাই না দেশীয় দুধ বন্ধ হয়ে বিদেশি গুঁড়া দুধে বাজার সয়লাব হয়ে যাক। বিদেশি গুঁড়া দুধ বাংলাদেশের বাজার দখল করুক এটা আমাদের কাম্য নয়।”
এর আগে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ ১৪ কোম্পানির সবগুলোর পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়।
ওই বেঞ্চের নির্দেশের পর দুধ বেচতে না পেরে পাবনার খামারিরা রাস্তায় ঢেলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিবাদ হয়েছে সিরাজগঞ্জেও।
বিচারক বলেন, “দেশীয় খামারিদের দুধ বন্ধ হোক, এটা আমরা চাই না। আমাদের চাওয়া, দেশীয় খামারিদের দুধের উৎপাদনের বিস্তার আরও বাড়ক। তবে সেটা হতে হবে নিরাপদ ও মান সম্পন্ন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। কোনোভাবেই তা যেন জনস্বাস্থ্যের জন্য অনিরাপদ ও ঝুঁকি না হয়।”
এসময় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম বলেন, গুঁড়ো দুধ পরীক্ষার নির্দেশ দিতে পারে আদালত।
এসময় বিচারক বলেন, “এটা দেখার দায়িত্ব আপনাদের ও বিএসটিআইর। আদালতকে কেন আদেশ দিতে হবে? আইনে আপনাদেরই তো ক্ষমতা দেওয়া আছে। আপনারা কেন সেটা পরীক্ষা করছেন না?”
জবাবে এ আইনজীবী বলেন, “আমরা পরীক্ষা করতে গেলে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসায়ীরাই প্রশ্ন তুলবে যে, কেন আমরা তা পরীক্ষা করছি। আদালত আদেশ দিলে সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না।”
এরপর বিএসটিআইর আইনজীবী সরকার এম আর হাসান বলেন, “দুধে যে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে তার অধিকাংশই সহনীয় মাত্রায়। আর সীসা পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে সামান্য কিছু উপরে। তাই এই দুধ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কি না, তা পরীক্ষা করে মতামত জানতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা যেতে পারে।”
তখন আগামী ২০ অক্টোবর পরবর্তী আদেশের জন্য রেখে জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, “হাই কোর্টের আরেকটি বেঞ্চ পাস্তরিত দুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধে নির্দেশ দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কী অবস্থা দাঁড়ায়, তা দেখা দরকার। এরপর আমরা আদেশ দেব।”
বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে কী রয়েছে- জানতে চাইলে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথমত বিএসটিআইকে আমরা চিঠি দিয়ে বলেছি, যেন তারা এই ১০টি পাস্তুরিত দুধের মান ঠিক করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, ১৫টি দুধ উদপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি যে, উৎপাদনের প্রতিটি স্তরে নির্ধারিত মান বজায় রাখতে। তৃতীয়ত, আমরা জানিয়েছি যে, গত দুই মাসে বিভিন্ন সুপার মল, দোকানে ১৫টির বেশি ভ্রম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে এবং যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হওয়ার কারণে ১৭ লক্ষ টাকার উপর জরিমানা করেছি। চতুর্থত বলেছি, সুনির্দিষ্টভাবে জামিন অযোগ্য ধারায় ১০টি পাস্তুরিত দুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে নিরাপদ খাদ্য আদালতে মামলা করেছি।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নিরাপত্তার বিষয়টিও আদালতের নজরে আনেন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গো খাদ্য, দুধ, দই ও বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ চালায় জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল)। তাতে দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও সীসা পাওয়া যায়।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয় হাই কোর্টের এই বেঞ্চ।
সেই আদেশে বলা হয়, ১৫ দিনের মধ্যে জরিপ চালিয়ে বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটিকে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে।
এরপর ২৩ জুন বিএসটিআইয়ের আইনজীবী আদালতকে বলেন, বিএসটিআই যেসব প্রতিষ্ঠানকে পাস্তুরিত দুধ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে, কেবল তাদের মান ঠিক থাকছে কি না- তা দেখভাল করার দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের।
আদালত তখন আদেশ দেয়, বিএসটিআইয়ের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কতগুলো কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ ঢাকার বাজারে আছে দুই সপ্তাহের মধ্যে তার তালিকা দিতে হবে।
এদিকে আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় বাজারে থাকা ৭৫ শতাংশ পাস্তুরিত দুধে ভেজাল থাকার তথ্য এলে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।
তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ থেকে পাস্তুরিত দুধ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আসে।
তবে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি সোমবার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসারস কো অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করেছে।