রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসারস কো অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রির ওপর হাই কোর্টের জারি করা নিষেধাজ্ঞা আট সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালত।
Published : 29 Jul 2019, 04:54 PM
মিল্ক ভিটার এক আবেদনের শুনানি করে চেম্বার বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান সোমবার এই আদেশ দেন। এর ফলে বাজারে মিল্ক ভিটার দুধ বিক্রিতে কোনো বাধা থাকছে না।
তবে সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত বাকি ১৩টি কোম্পানি কোনো আবেদন না করায় তাদের পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন পাঁচ সপ্তাহ বন্ধই থাকছে বলে জানিয়েছেন মিল্ক ভিটার অন্যতম আইনজীবী মহিউদ্দিন মো. হানিফ ফরহাদ।
সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “চেম্বার আদালতের আদেশের ফলে মিল্ক ভিটার দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে কোনো বাধা থাকছে না।”
এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্ট গত ১৪ জুলাই বাজারে থাকা বিএসটিআই অনুমোদিত সব কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। সেই প্রতিবেদন রোববার হাই কোর্টে জমা পড়ে। সেখানে দেখা যায়, ১৪ কোম্পানির দুধের সবগুলোতেই এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি রয়েছে। আর ১০টি কোম্পানির দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
ওই প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেয়।
বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত ১৪ কোম্পানির সবগুলোকেই ৫ সপ্তাহ পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ রাখতে বলা হয় ওই আদেশে। সেই সঙ্গে জনসাধারণকে পাস্তুরিত দুধ কেনা ও খাওয়ায় ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানি মিল্ক ভিটাসহ ওই ১৪টি প্রতিষ্ঠানই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছিল। হাই কোর্টের এই আদেশের ফলে দেশে বৈধভাবে পাস্তুরিত দুধ বিক্রির সুযোগ পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
এন্টিবায়োটিক, সীসাসহ ক্ষতিকারক উপাদান থাকায় বিএসটিআই অনুমোদিত ওই ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন কেন আইনগত কর্তৃত্ববর্হিভূত ও সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না এবং এসব দুধ পরিশুদ্ধ করে বাজারজাত করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় হাই কোর্টের রুলে।
১৪টি কোম্পানিসহ বিবাদীদের দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া বিএসটিআই নতুন করে পাস্তুরিত দুধের মানদণ্ড নির্ধারণে কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা আকরে জানাতে বলা হয়।
১৪ কোম্পানির দুধ
# আফতাব মিল্ক অ্যন্ড মিল্ক প্রডাক্ট লিমিটেডের আফতাব
# আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ফার্মফ্রেশ মিল্ক
# আমেরিকান ডেইরি লিমিটেডের মো
# বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসারস কো অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের মিল্ক ভিটা
# বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যন্ড ফুডস লিমিটেডের ডেইরি ফ্রেশ
# ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেন্টের আড়ং ডেইরি
# ড্যানিশ ডেইরি ফার্ম লিমিটেডের আয়রান
# ইছামতি ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টের পিউরা
# ইগলু ডেইরি লিমিটেডের ইগলু
# প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের প্রাণ মিল্ক
# উত্তরবঙ্গ ডেইরির মিল্ক ফ্রেশ
# শিলাইদহ ডেইরির আল্ট্রা
# পূর্ব বাংলা ডেইরি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের আরওয়া
# তানিয়া ডেইরি এন্ড ফুড প্রোডাক্টস সেইফ
আদেশের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “মিল্ক ভিটা হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছিল। চেম্বার বিচারপতি ৮ সপ্তাহের জন্য আদেশটি স্থগিত করে দিয়েছেন।”
মিল্ক ভিটার অপর আইনজীবী মহিউদ্দিন মো. হানিফ বলেন, “মাথাব্যথার জন্য আমরা মাথা কেটে ফেলতে পরি না। হাই কোর্ট গতকাল যে আদেশ দিয়েছে, তাতে খামারিরা ও উৎপাদকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন, বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বেন।
“এটা উল্লেখ করে আমরা মিল্ক ভিটার ক্ষেত্রে হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়েছিলাম। আমরা বলেছি, দুধে এন্টিবায়োটিক বা অন্য সমস্যা থাকলে তা গ্র্যাজুয়ালি দূর করতে হবে। হঠাৎ বন্ধ করে দিলে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
এদিন আদালতে উপস্থিত বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসার্স কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. দেলোয়ার হোসাইন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফার ডটকমকে বলেন, হাই কোর্টের আদেশের পর ডেইরি শিল্পের সঙ্গে জড়িত কৃষক-খামারি সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
“একেবারে থমথমে বাকরুদ্ধ অবস্থা। তারপরও আদালতের আদেশ অনুযায়ী আমরা দুধ উৎপাদন, সংগ্রহ বন্ধ করে দিই। কোর্টের আদেশ যেহেতু মান্য করতেই হবে।
“আজকে আমাদের কাছে কিছু রিপোর্ট ছিল যেগুলো আমরা নিজস্ব উদ্যোগে পরীক্ষা করিয়েছিলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি ল্যাবরেটরিতে এই পরীক্ষা করিয়েছিলাম। সেগুলো আমরা চেম্বার আদালতে উপস্থাপনের জন্য দিয়েছিলাম।
“আদালত সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে হাই কোর্টের আদেশটি স্থগিত করেছেন। এতে খামারিরা অনেক উপকৃত হবেন। সারা দেশে খামারিদের মধ্যে একটা আনন্দ কাজ করবে।”
মিল্ক ভিটা যদি আবার দুধ উৎপাদন, সরবরাহ করে, তাতে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকারক উপাদান থাকবে কিনা- এই প্রশ্নে দেলোয়ার হোসাইন বলেন, “আজ কোর্ট যে স্টে অর্ডার দিয়েছে সেটা সন্তুষ্ট হয়েই দিয়েছে। বিভিন্ন ল্যাবরেটরি থেকে যে রিপোর্ট এসেছে তাতে মিল্ক ভিটার দুধ মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকারক নয়।”
সেক্ষেত্রে হাই কোর্টে যেসব সরকারি ল্যাবরেটরির প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে- সেগুলো ভুল কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “আগে যে রিপোর্ট হয়েছে সেসব রিপোর্টে বলা হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি আছে। এই অ্যান্টিবায়োটিক কত মাত্রায় মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর তা কিন্তু বলেনি। তাছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্যারামিটার বিএসটিআই এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেনি।
“এখন পর্যন্ত ল্যাবরেটরি টেস্টে যা পেয়েছি, তাতে বলতে পারি মিল্ক ভিটা দুধে ক্ষতিকর কোনো উপাদান নেই। গবেষকরা এন্টিবায়োটিক পেয়েছেন সত্যি। কিন্তু সেটা মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে সে মাত্রায় পায়নি। সে হিসাবে আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি মিল্ক ভিটার দুধ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না।”
বিএসটিআই যেখানে এন্টিবায়োটিকের মাত্রা নির্ধারণ করেনি, তাহলে এন্টিবায়োটিকের গ্রহণযোগ্য মাত্রা কোন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দিয়েছে- এই প্রশ্নে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “বিএসটিআই সেটা নির্ধারণ করে দিতে পারেনি। কিন্তু আমরা উন্নত দেশে যে স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করে সেটা ফলো করি। ইন্টারনেট সার্চে করে আমরা সেটা জেনেছি।”
মিল্ক ভিটা দৈনিক এক লাখ ২০ থেকে ৩০ হাজার লিটার দুধ বাজারে ছাড়তো যা ৭৫ হাজার লিটারে নেমে এসেছে জানিয়ে দেলোয়ার হোসাইন বলেন, “যেহেতু চেম্বার আদালত হাই কোর্টের আদেশটি স্থগিত করেছে, তাই মিল্ক ভিটা কাল থেকেই উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে যাবে।”