সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই যে ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধকে জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ বলছে, তার ১১টির নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চাইতে বেশি সীসার উপস্থিতি পাওয়ার কথা হাই কোর্টকে জানিয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
Published : 16 Jul 2019, 01:39 PM
তার কোনোটিতে আবার মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় ক্যাডমিয়াম পাওয়ার কথাও জানিয়েছে সরকারি এ সংস্থাটি।
পাশাপাশি বাজারে বিক্রি হওয়া খোলা দুধের নমুনাতেও মিলেছে গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি সীসা ও ক্যাডিমিয়ামের উপস্থিতি।
মানুষের শরীরে অতিরিক্ত সীসা বা ক্যাডমিয়াম জমা হলে স্নায়ুতন্ত্রের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে, রক্তের রোগ তৈরি হতে পারে, এমনকি কিডনি জটিলতা বা ক্যান্সারও দেখা দিতে পারে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এই প্রতিবেদন মঙ্গলবার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়।
সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বিসিএসআইআর, প্লাজমা প্লাস, ওয়াফেন রিসার্চ, পারমাণু শক্তি কমিশন ও আইসিডিডিআরবি’র ল্যাবে পাস্তুরিত দুধ, খোলা দুধ ও গোখাদ্য পরীক্ষা করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
সেই পরীক্ষায় বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত ১৪টি কোম্পানির মধ্যে ১১টির পাস্তুরিত দুধে সীসা পাওয়া গেছে। কোনো কোনোটিতে পাওয়া গেছে ক্যাডমিয়াম।
কোম্পানিগুলো হল- মিল্কভিটা, ডেইরি ফ্রেশ, ইগলু, ফার্ম ফ্রেশ, আফতাব মিল্ক, আল্ট্রা মিল্ক, আড়ং ডেইরি, প্রাণ মিল্ক, আইরান, পিউরা, সেইফ মিল্ক।
আদালতের আদেশে বলা হয়, ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও বিএসটিআই কী আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে, সে বিষয়ে ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে বাস্তবায়ন প্রতিবেদন দিতে হবে।
এছাড়া পশু চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কোনো ফার্মেসি অ্যানিমেল অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বা বিতরণ করতে পারবে না। কোনো খামারি বা কেউ প্রেসক্রিপশন ছাড়া গবাদিপশুকে অ্যান্টিবায়োটিক দিতেও পারবে না।
আদেশের পাশাপাশি একটি রুল জারি করেছে হাই কোর্ট। জনস্বার্থে পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত তরল দুধ, খাদ্য ও পশুখাদ্যের মান পরীক্ষা ও গবেষণায় বিএসটিআই নিবন্ধিত দুধ কোম্পানিগুলোকে একটি তহবিল গঠন করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।
বিএসটিআই এবং দুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলোকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের ওই প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন আইনজীবী মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম।
বিএসটিআইয়ের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ব্যারিস্টার সরকার এম আর হাসান মামুন। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
আদেশের পর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদ বলেন, বিএসটিআই ২০০২ সালে পাস্তুরিত দুধের যে মান নির্ধারণ করেছিল তার ভিত্তিতেই বাজারে থাকা দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এই প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তবে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক বা ডিটারজেন্টের উপস্থিতি সেখানে পরীক্ষা করা হয়নি।
“আমরা তিনটি সরকারি সংস্থার ল্যাব ও তিনটি বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করেছি। অলমোস্ট সবকটি দুধের স্যাম্পলেই গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি সীসা ও ক্যাডমিয়া পাওয়া গেছে। গোখাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত কিছু পাওয়া যায়নি।”
অন্যদিকে সরকার এম আর হাসান মামুন সাংবাদিকদের বলেন, গত মে মাসে বিএসটিআই প্রক্রিয়াজাত দুধ ও পাস্তুরিত দুধের ৩০৫টি নমুনা পরীক্ষা করেছিল। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখন যে ১১ কোম্পানির দুধে মাত্রাতিরিক্ত সীসা বা ক্যাডমিয়াম পেয়েছে, বিএসটিআইয়ের পরীক্ষার সময় তা ছিল না।
“তবে দুটি কেম্পানির দুধ তখন একেবারেই বিএসটিআইয়ের স্ট্যান্ডার্ডে ছিল না। সে দুটি কোম্পানিকে আমরা নোটিস করেছি।”
এসব প্রতিবেদন নিয়ে দ্বিমত বা সমর্থন করার কিছু নেই মন্তব্য করে এই আইনজীবী বলেন, “সবচেয়ে বড় কথা হল, বিএসটিআইকে বিশুদ্ধ দুধ দিতে হবে এবং তা দিতে বিএসটিআই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সমর্থন দিচ্ছে, এখন যা যা করতে হবে তাই করা হবে।”
এদিকে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়েছে, তাদের উৎপাদিত আড়ং পাস্তুরিত দুধের একটি নমুনা তারা গত ২৬ মে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদকে (বিসিএসআইআর) দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছে।
গত ১ জুলাই বিসিএসআইআর তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, আড়ং দুধের ওই নমুনায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া যায়নি।
কিন্তু নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আদালতে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে ২০ জুন বিসিএসআইআরের পরীক্ষাতেই আড়ং পাস্তুরিত দুধের নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি সীসা থাকার কথা বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আর্থিক সহায়তায় গো খাদ্য, দুধ, দই ও বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ নিয়ে সম্প্রতি একটি জরিপ চালায় জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগার (এনএফএসএল)। তাতে দুধে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক ও সীসা পাওয়া যায়।
ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর দেখে গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেয় হাই কোর্টের এই বেঞ্চ।
সেই আদেশে বলা হয়, ১৫ দিনের মধ্যে জরিপ চালিয়ে বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটিকে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন দিতে হবে।
এরপর ২৩ জুন বিএসটিআইয়ের আইনজীবী আদালতকে বলেন, বিএসটিআই যেসব প্রতিষ্ঠানকে পাস্তুরিত দুধ বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে, কেবল তাদের মান ঠিক থাকছে কি না- তা দেখভাল করার দায়িত্ব বিএসটিআইয়ের।
আদালত তখন আদেশ দেয়, বিএসটিআইয়ের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কতগুলো কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ ঢাকার বাজারে আছে দুই সপ্তাহের মধ্যে তার তালিকা দিতে হবে।
এদিকে আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় বাজারে থাকা ৭৫ শতাংশ পাস্তুরিত দুধে ভেজাল থাকার তথ্য এলে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী।
ওই রিটের প্রেক্ষিতে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে বাজারের পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সচিব এবং বিএসটিআই এর মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়।
এই নির্দেশের পর বিএসটিআই গত ২৫ জুন ওই বেঞ্চে যে প্রতিবেদন দেয়, সেখানে ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান না থাকার কথা আদালতকে জানানো হয়।
এদিকে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাই কোর্ট বেঞ্চ যে বাজারে জরিপ চালিয়ে যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিল, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার তা জমা দেয়।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী ফরিদুল ইসলাম ফরিদকে বলেন, “কেউ বলছেন দুধে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে। আবার কেউ বলছেন ক্ষতিকর উপাদান নেই। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুধ পরীক্ষার গবেষণা ফল প্রকাশের পর একজন সেক্রেটারি তাকে নিয়ে কথা বললেন। কিন্তু কেন? দুধ নিয়ে কি কোনো রাজনীতি হচ্ছে? তাহলে আমাদের বলুন।”
শুনানির এক পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ১৯টি প্যারামিটারে দুধ পরীক্ষা করেছেন। বিএসটিআই ৯টি প্যারামিটারে দুধ পরীক্ষা করেছে। আর আমরা ৫টি প্যারামিটারে দুধ পরীক্ষা করেছি।”
এ সময় বিচারক বলেন, “এইসব প্যারামিটারের কথা বলে বাঙালিকে হাই কোর্ট দেখাবেন না। দুধে এরকম ক্ষতিকর উপাদানের বিষয় অন্য দেশে হলে জরিমানা করতে করতে শেষ করে ফেলত।”