পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন-বিক্রিতে ৫ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা

সীসাসহ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান থাকায় সরকারের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআইয়ের অনুমোদিত ১৪ কোম্পানির সবগুলোকেই ৫ সপ্তাহ পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2019, 10:15 AM
Updated : 29 July 2019, 12:20 PM

সেই সঙ্গে জনসাধারণকে পাস্তুরিত দুধ কেনা ও খাওয়ায় ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বাজারে থাকা এসব কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ চারটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে পরীক্ষা করানোর পর সেই প্রতিবেদন রোববার হাই কোর্টে জমা পড়লে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়।

রাষ্ট্রায়াত্ত কোম্পানি মিল্কভিটাসহ ওই ১৪টি প্রতিষ্ঠানই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছিল।

হাই কোর্টের এই আদেশের ফলে এই ৫ সপ্তাহ দেশে বৈধভাবে পাস্তুরিত দুধ বিক্রির কোনো সুযোগ থাকল না।

এন্টিবায়োটিক, সীসাসহ ক্ষতিকারক উপাদান থাকায় বিএসটিআই অনুমোদিত ওই ১৪ কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন কেন আইনগত কর্তৃত্ববর্হিভূত ও সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না এবং এসব দুধ পরিশুদ্ধ করে বাজারজাত করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেছে আদালত।

১৪টি কোম্পানিসহ বিবাদিদের দুই সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া বিএসটিআই নতুন করে পাস্তুরিত দুধের মানদণ্ড নির্ধারণে কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে হলফনামা আকরে জানাতে বলা হয়েছে।

আদালতে বিএসটিআইয়ের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সরকার এম আর হাসান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী অনীক আর হক ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পক্ষে আইনজীবী মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম শুনানি করেন।

১৪ কোম্পানির দুধ

# আফতাব মিল্ক অ্যন্ড মিল্ক প্রডাক্ট লিমিটেডের আফতাব

# আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের ফার্মফ্রেশ মিল্ক

# আমেরিকান ডেইরি লিমিটেডের মো

# বাংলাদেশ মিল্ক প্রডিউসারস কো অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের মিল্ক ভিটা

# বারো আউলিয়া ডেইরি মিল্ক অ্যন্ড ফুডস লিমিটেডের ডেইরি ফ্রেশ

# ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রজেন্টের আড়ং ডেইরি

# ড্যানিশ ডেইরি ফার্ম লিমিটেডের আয়রান

# ইছামতি ডেইরি অ্যান্ড ফুড প্রডাক্টের পিউরা

# ইগলু ডেইরি লিমিটেডের ইগলু

# প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের প্রাণ মিল্ক

# উত্তরবঙ্গ ডেইরির মিল্ক ফ্রেশ

# শিলাইদহ ডেইরির আল্ট্রা

# পূর্ব বাংলা ডেইরি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের আরওয়া

# তানিয়া ডেইরি এন্ড ফুড প্রোডাক্টস সেইফ

একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাই কোর্টের এই বেঞ্চ গত ১৪ জুলাই বাজারে থাকা বিএসটিআই অনুমোদিত সব কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষার নির্দেশ দেয়।

এসব কোম্পানির দুধে এন্টিবায়োটিক, ডিটারজেন্ট, ফরমালিন, ব্যাকটেরিয়া ও ফরমালিন আছে কিনা তা পরীক্ষা করে চারটি গবেষণাগারকে এক সপ্তাহের মধ্যে আলাদাভাবে প্রতিবেদন দিতে বলে আদালত।

জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি (এনএফএসএল), আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি), বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল (বিসিএসআইআর) ও বাংলাদেশ প্রাণীসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) ফুড সেফিটি ল্যাবরেটরিতে বাজারের এসব দুধ স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করতে বলা হয়।

সেই সঙ্গে দুধে এন্টিবায়োটিক বা ডিটারজেন্ট আছে কিনা তা পরীক্ষার সক্ষমতা অর্জন করতে বিএসটিআইয়ের ল্যাবরেটরির কত সময় ও অবকাঠামো প্রয়োজন সে বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা আদালতে জমা দিতে বলা হয়।

সে অনুযায়ী ১৪টি কোম্পানির দুধের নমুনা সংগ্রহ ব্যাকটেরিয়া, কলিফর্ম, স্টেফাইলোকক্কাস, টেট্রাবল অ্যাসিডিটি, ফরমালিন, ডিটারজেন্ট ও অ্যান্টিবায়োটিক রেসিডিউ পরীক্ষা করে গত ২৩ জুলাই আদালতে দাখিল করে বিএসটিআই।

রোববার চারটি ল্যাবরেটরির সেসব পরীক্ষা প্রতিবেদনের পাশাপাশি পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি পরীক্ষা প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করা হয়। বিএসটিআইয়ের পক্ষে আইনজীবী সরকার এম আর হাসান চারটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।

আর পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষা প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের আইনজীবী মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম।

পরে পরমাণু শক্তি কমিশন, বিসিএসআইআর ও এনএফএসএলের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেয়।

আদেশের পর রিটকারী পক্ষের আইনজীবী অনীক আর হক সাংবাদিকদের বলেন, “বিএসটিআই অনুমোদিত ১৪টি ব্র্যান্ডের দুধের মধ্যে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। যদিও আমাদের কৃষি খাদ্য, মৎস্য খাদ্য আইনে গবাদি পশু বা যে কোনো পশুতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কিন্তু এসব দুধে এন্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে।”

সেই সঙ্গে বিসিএসআইআর ও আণবিক শক্তি কমিশনের রিপোর্টে দুধে মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতু (হেভি মেটাল) বিশেষ করে সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।  

আদালত স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ কেন দিয়েছে জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, “শুনানির এক পর্যায়ে আদালতের মনে হয়েছে, আজকে এখনই আদেশ দেওয়া উচিৎ। তাছাড়া অন্তর্বর্তী আদেশ চাইলে তো আমাদের লিখিত আবেদন করতে হবে। তো আদালত সেই সময় অপেক্ষা না করেই আদেশটি দিয়েছেন।”

আগামী ২৫ অগাস্ট বিষয়টি পরবর্তী আদেশের জন্য রাখা হয়েছে বলে জানান এই আইনজীবী।

বিএসটিআইয়ের আইনজীবী সরকার এমআর হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে আজ থেকেই আমরা বাজার মনিটরিং শুরু করব। তাছাড়া আমি আশা করব, আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে বাজারে থাকা এসব দুধ কোম্পানিগুলো তুলে নেবে। সর্বোপরি আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আদালত যে আদেশ দিয়েছেন সে আদেশটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।”

বিসিএসআইআরের পরীক্ষায় বলা হয়, বিএসটিআইয়ের সরবরাহ করা ১৪টি পাস্তুরিত দুধের নমুনার মধ্যে আড়ং ডেইরি, প্রাণ মিল্ক এবং মিল্ক ফ্রেশের নমুনা মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষায় গ্রহণযোগ্য হয়েছে। 

তবে বিডিএস স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সরবরাহ করা এসব নমুনার মধ্যে মিল্কভিটা, আরওয়া ও সেইফ ব্র্যান্ডের দুধে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে। আড়ং ডেইরি, প্রাণ মিল্ক ও মিল্ক ফ্রেশ বাদে বাকিগুলোতে স্টেফাইলোকক্কাস পাওয়া গেছে।

স্টেফাইলোকক্কাস নিয়ে পরীক্ষার সুপারিশে বলা হয়েছে, এর কোনো বিডিএস মাত্রা নাই। ফলে স্টেফাইলোকক্কাস দূষণ রোধ করতে পাস্তুরিত করার প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভারে মানতে হবে।  

এনএফএসএলের পরীক্ষায় ১৪টি নমুনার সবকটিতেই অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, দুটিতে টেট্রাসাইক্লিন এন্টিবায়োটিক পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আর পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষায় ১০টি নমুনায় গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি সীসার উপস্থিতি থাকার কথা বলা হয়েছে।

বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়েরিয়াল ডিজিস রিসার্চ, বাংলাদেশ’র (আইসিডিডিআর,বি) গবেষণা নিয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

ওই গবেষণায় বলা হয়, বাজারে থাকা ৭৫ শতাংশ পাস্তুরিত দুধেই ভেজাল রয়েছে; যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি। ওই প্রতিবেদন যুক্ত করে হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ।

এরপর আদালত বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের নিয়ে কমিটি গঠন করে বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধ পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সচিব এবং বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেয়।

ওই নির্দেশের পর গত ২৫ জুন বিএসটিআইয়ের আইনজীবী আদালতে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। সেদিন আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদনের ওপর কোনো শুনানি না হলেও বিএসটিআই আইনজীবী গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন।

তিনি সাংবাদ মাধ্যমকে বলেন, চৌদ্দটি কম্পানির পাস্তরিত দুধে আশঙ্কাজনক বা ক্ষতিকর কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। তার ওই বক্তব্য উদ্বৃত করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করলে তা আদালতের নজরে আসে।

ওই দিনই এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বাজারে থাকা সাতটি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধের নমুনা পরীক্ষা করে সেগুলোতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়ার কথা জানান।