বড় ধরনের কোনো কিছু না ঘটলে রোববার শপথ নেওয়া নাসির উদ্দীন কমিশনের অধীনেই হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
Published : 24 Nov 2024, 01:27 AM
পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর প্রবল গণ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ভোটে আসতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নের আপাতত জবাব না থাকার মধ্যে সংস্কার ও প্রত্যাশার জন আকাঙ্খার মধ্যে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে নতুন নির্বাচন কমিশন।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাড়ে তিন মাসের মাথায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পেতে যাওয়া সাবেক আমলা এ এস এম মো. নাসির উদ্দীন আত্মবিশ্বাসী যে তিনি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারবেন, যেখানে মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে তার পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন।
তবে তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ দেখছেন একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক; আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয় কি না, আছে সেই প্রশ্নও।
আওয়ামী লীগ ও তার জোটের শরিক দলগুলো এ মুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব না পেলেও তাদের একটি বড় সমর্থকগোষ্ঠী ভোটের বাইরে থাকবে কি না, সেই প্রশ্নেও নানা মত আছে সরকার ও তার অংশীদারে।
এর মধ্যে রোববার প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়ে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে পাঁচ সদস্যের নতুন কমিশন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে, সেই প্রশ্নের জবাব না থাকলেও বড় ধরনের কোনো কিছু না ঘটলে এ কমিশনের অধীনেই হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এমনটি হলে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর এটিই হবে প্রথম নির্বাচন, যখন কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় নেই।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এরই মধ্যে স্পষ্ট করেছেন, তিনি বা তার সরকারের কেউ ভোটে অংশ নেবেন না। ফলে এ কমিশনের ওপর রাজনৈতিক চাপ কম থাকবে বলে মনে করছেন অনেকে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গঠিত কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ৫ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করে।
সবশেষ এ বছরের ৭ জানুয়ারি তাদের অধীনেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে গত জানুয়ারিতে সেই নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এর আট মাসের মাথায় গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়।
দেড় মাস ধরে শূন্য থাকার পর এ এস এম মো. নাসির উদ্দীন নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেবেন; যাদের অধীনে হবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন।
‘কম কথা, বেশি কাজ’ চায় বিএনপি
‘নির্বাচনি ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে’- বলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে যে বক্তব্য রেখেছেন, নতুন নির্বাচন কমিশনে গঠন সেটির একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
তিনি বলেন, “আমরা নতুন নির্বাচন কমিশনের উপরে আস্থা রাখতে চাচ্ছি। আমাদের অনুরোধ থাকবে-কথা কম বলে বেশি কাজ দিয়ে সেটা চেষ্টা করা উচিত শুরু থেকেই।
“একটু কম কথা, একটু বেশি কাজ। তাহলে আশান্বিত হব-যেটুকু বলেছে বাস্তবে দেখা যাবে।”
জামায়াতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, “আমরা আশা করি এই ইসি কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এবং একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং ভয়ভীতিহীন নির্বাচন করবে।”
তবে জামায়াত এখনও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের পর নির্বাচন চায়, দৃশ্যত তারা সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চায়, যা সংসদে তাদের বেশ কয়েকজনের উপস্থিতি নিশ্চিত করবে। কারণ এ পদ্ধতিতে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই দলের তত শতাংশ আসন থাকবে।
১৯৯৬ সালে জামায়াত কোনো ধরনের জোট বা সমঝোতা ছাড়া ভোটে অংশ নিয়েছে, তখন তারা সাড়ে ৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনটি আসন পেয়েছিল। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি থাকলে তাদের আসন হতে পারত ২৫টি।
নির্বাচন কোন পন্থায় হবে, সেটি নির্ধারণের এখতিয়ার অবশ্য নির্বাচন কমিশনের হাতে নেই। সেটি দেখবে সরকার, যারা নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে, তাদের প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।
প্রত্যাশা ভালো নির্বাচনের
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রত্যাশা করব, তারা (নির্বাচন কমিশন) যেন একটা ভালো নির্বাচন বলতে যেটা বোঝায়, নির্বাচনে দাঁড়ানো, ভোট দেওয়া, ভোটে দাঁড়ানোর সমঅধিকার নিশ্চিত করা, এমন একটি ভালো নির্বাচন উপহার দেবে।
“তারা এমন একটি নির্বাচন বা নির্বাচনের সময় এমন উদাহরণ সৃষ্টি করবে, যাতে করে ভবিষ্যতে নির্বাচন আর নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো প্রশ্ন সামনে আসবে না।”
দলীয় সরকার থাকলে অনেক সময় নির্বাচন কমিশন ভালো ভূমিকা রাখতে পারে না মত দিয়ে তিনি বলেন, “এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার আছে, তার উপরও নানা গ্রুপের প্রভাব শোনা যায়। সকল প্রভাবমুক্ত হয়ে তারা যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে, এই চ্যালেঞ্জ তারা যথাযথভাবে পালন করবে, সেটিই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে। কতটুকু করতে পারলেন না পারলেন সেটি সময় বলে দেবে।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে আর কেউ যাতে ভোটাধিকার কেড়ে নিতে না পারে; এই দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করবেন।
“জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় নির্বাচন কমিশন যাতে একটা ভরসার জায়গা হয়ে উঠতে পারে, এই মর্যাদায় তারা নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে যাবে।”
কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ কী?-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “প্রশাসন পুনর্গঠন এবং একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ, ভোটার তালিকা স্বচ্ছভাবে তৈরি করা। সেই সঙ্গে নির্বাচনে যাতে কোনোভাবে কেউ প্রশাসনিক কারসাজি কিংবা পেশিশক্তি বা টাকার খেলা করতে না পারে, জনগণ যাতে অবাধে তার প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ পায়।”
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খাঁন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চাই এই নির্বাচন কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবে, যে নির্বাচন হবে আন্তর্জাতিক মানের।
“এটা এমন একটি নির্বাচন, যেটি আসলে আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও একটি মানদণ্ড হিসেবেই সব সময় বিবেচিত হবে।”
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নিবন্ধন বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাহমিদুল আলম বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই তাদের বিবেচনা করা হবে।
“গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন এবং বিগত ১০ বছরের স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নির্বাচনের নামে যে তামাশা হয়েছে, তার পুনারাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। যেহেতু বিগত ১০ বছর আমরা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাম, তাই ভবিষ্যতে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলো যেন সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য হয় সেই প্রত্যাশা থাকবে তাদের কাছ থেকে।“
অতীতের মত ভবিষ্যতেও যেন তারা সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয় সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখার তাগিদ দেন তিনি।
বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকুরিরত ইসমাইল মৃধা বলেন, “নির্বাচন কমিশন গঠন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কমিশন হওয়াতে মানুষের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়া কিছুটা এগিয়ে গেল। তবে তাদের উচিৎ সময় নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি করা যেন মানুষের আর কখনও এমন নির্বাচন দেখতে না হয়, যে নির্বাচনের কোনো মানে হয় না। এখানেও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অনেক।”
‘বড় চ্যালেঞ্জ’
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ-জানিপপ চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন ভোটার তালিকা নতুন করে তৈরি করা একটা বড় কাজ। নীতিমালা তৈরির ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ।
“আর সবার কাছে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ।”
বহু বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “সব দল এবং ভোটারকে নির্বাচনে টেনে আনা তাদের জন্য কঠিন হবে। কারণ আগের মত কমিশন গঠন করা হয়েছে, এখানে সব পেশার প্রতিনিধিত্ব নেই।”
‘আক্ষেপ’
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের করা আইনেই নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে-এমন আক্ষেপ জোনায়েদ সাকির।
“এই পদ্ধতি দিয়ে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশন ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি হতে পারবে না। আমাদের এই আইন বদলাতে হবে।
“নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষমতা একটা সাংবিধানিক কমিশনের কাছে দিতে হবে। যেখানে সরকারি দল, বিরোধী দল এবং বিচার বিভাগের কেউ থাকবে না,” যোগ করেন তিনি।
সার্চ কমিটি যে ১০ জনের নাম সুপারিশ করেছিল তার মধ্যে পাঁচজনের নাম কেন প্রকাশ করা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “শেখ হাসিনা যে নির্বাচন কমিশনগুলো গঠন করেছিল সব এই আদলে। একেবারেই সংস্কার করতে পারে নাই। একজন গবেষক, পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক থাকতে পারত এখানে।
“নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, সেই কমিশন রিপোর্ট দেওয়ার আগেই কেন নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হল? তারা যে সুপারিশগুলো দেবে, সেখানে নির্বাচন কমিশন কেমন হবে সে সুপারিশও থাকতে পারত।“
নতুন সিইসি প্রত্যয়ী
নিয়োগ পাওয়ার পরই সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দীন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে তিনি বলেন, “এত প্রাণহানি, এত লোক পঙ্গু হল, আহত হল; তাদের রক্তের সাথে তো আমরা বেঈমানী করতে পারব না।
“আমার কমিশনের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে যাতে মানুষের চাওয়া, অধিকারটা ফিরিয়ে দিতে পারি। আমরা এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি, যেখানে মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে তার পছন্দমত লোকটাকে ভোট দিতে পারে। সেটা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার, আমি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করব সেটা নিশ্চিত করার।”
রোববার শপথ
নবনিযুক্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনার শপথ নেবেন রোববার।
দুপুর দেড়টায় সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ তাদের শপথ পাঠ করাবেন।
নাসির উদ্দীন কমিশনার হিসেবে পেয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাসুদ, সাবেক যুগ্ম সচিব বেগম তহমিদা আহমদ এবং অবসরারপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহকে।
আরও পড়ুন
শহীদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারব না: নতুন সিইসি
কাউকে নির্বাচনে 'আনতে চাই' বলিনি: আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে ফখরুল
নির্বাচনি সংস্কার হয়ে গেলে রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন: প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না থাকায় হতাশ বিএনপি
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার: সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদন