রাসায়নিক আর প্লাস্টিকের গুদাম সরবে, এমন ঘোষণার ১৩ বছর পরও ঝুঁকিপূর্ণ উপকরণে ঠাসা পুরান ঢাকার বিভিন্ন ভবন, ‘বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ এখনও হয়নি।
Published : 23 Feb 2023, 12:02 AM
চার বছর আগে স্বামী হারানোর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ফাতেমা আক্তার এসেছিলেন পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়। চোখে জল নিয়ে প্রিয় মানুষের সঙ্গে কাটানো সময়টা স্মরণ করেন তিনি।
চার বছর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজার লাগোয়া এই ব্যস্ততম এলাকায় হঠাৎ বিস্ফোরণে যে ৭১ জন প্রাণ হারান, তার একজন ফাতেমার জীবনসঙ্গী মোহাম্মদ ফয়সাল। এরপর থেকে প্রতি বছর সেই দিনটিতে স্বজনদের নিয়ে তিনি আসেন চুড়িহাট্টায়, উদ্দেশ্য স্বামীর আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা।
সেই দুর্ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরানোর যে আলোচনা, তা তিমিরে থেকে যাওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ ঝরে পড়ল ফাতেমার কণ্ঠে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখনও ভালো করে খোঁজ নিলেই দেখা যাবে আগের মতোই বিভিন্ন বাড়িতে গোডাউন আছে, কারখানা আছে। একটু তদন্ত করলেই দেখা যাবে।
“ভাড়া বেশি পাওয়া যায়। এ জন্য বাড়িওয়ালারা নিচতলায় কেমিকেলের গোডাউন ভাড়া দিচ্ছে। শুনছিলাম ঢাকা থেকে নাকি এগুলা সরিয়ে নিবে, কিন্তু নেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখতেছি না।”
তারা আসেন ওয়াহেদ ম্যানশনে, দুঃসহ সেই স্মৃতি জাগে
রাসায়নিকের গুদাম আর কারখানা সরানোর আলোচনা অবশ্য চার বছর আগের না। সব মিলিয়ে সরকারের এই ঘোষণার ১৩ বছর হয়ে গেল।
২০১০ সালে পুরান ঢাকারই নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর সিদ্ধান্ত হয়, আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের পাশাপাশি সরে যাবে প্লাস্টিকের কারখানা, গুদাম।
সেই আগুনে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর সরকারের বক্তব্যে ছিল বেশ জোর। নেওয়া হয় একটি প্রকল্প। জানানো হয়, যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ করা হবে ঢাকার সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির এলাকাটি।
কিন্তু সেই ঘোষণাতেই সার। কবে সরবে এসব বিপজ্জনক উপাদান, সেই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব নেই কারও কাছেই, সবার বক্তব্যই ধারণাভিত্তিক।
এর মধ্যে এক দফা বদল হয়েছে প্রকল্পের জায়গা। কয়েক দফা বেড়েছে মেয়াদ। সবশেষ ২০২২ সালের জুনে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের কাজ শেষে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। তবে আবারও প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সাল করা হয়েছে।
‘আরও সময় লাগবে’
এই দুই বছর পরও প্লট বুঝে পাওয়া নিয়ে সন্দিহান ব্যবসায়ীরা। প্লট পাওয়ার পর কারখানা বসান, পুরান ঢাকা থেকে পুরনো কারখানা সরিয়ে নিতে আরও সময় লাগবে।
আর্মেনিয়ান স্ট্রিটের লাকি করপোরেশনের মালিক মতিউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের বেশিরভাগ গুদাম তারা নদীর অন্য পাড়ে আবদুল্লাহপুর এলাকায় সরিয়ে নিয়েছেন। বিক্রির পর সেখান থেকে মাল নিয়ে আসেন। মালের পরিমাণ বলে সরাসরি গুদাম থেকে সরবরাহ করেন।
“তারা মাটি ভরাট করবে, রাস্তা বানাবে, বিল্ডিং করতে হবে। এগুলা করতে লাগবে মিনিমাম আরও ১০ বছর,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল মোস্তফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনারা (বিসিক) তো কয়েকবারই সময় দিয়েছেন প্লট বুঝিয়ে দেবেন, কিন্তু দিতে পারছেন না। কয়দিন পরপরই বলেন ‘ছয় মাস পর দিচ্ছি’। এখন যে অবস্থা, তাতে মনে হয় না ২০২৫ সালের আগে প্লট বুঝে পাব।”
প্লট বুঝিয়ে দিলে ব্যবসায়ীদের সেখানে যেতে আপত্তি নেই বলে জানান তিনি। সেই সঙ্গে বলে রাখেন, প্লট বুঝে পেলেও ভবন নির্মাণ এবং অন্যান্য কাজ শেষ করতে আরও কিছু সময় লাগবে।
মোস্তফা বলেন, “জমি রেডি হওয়ার পরে ভবন তৈরির উপযোগী থাকলে ভবন নির্মাণের কাজ করব। কে কী রকম ভবন করবে, তার ওপর নির্ভর করবে। তারা (বিসিক) যদি ২০২৫ সালে জমি বুঝিয়ে দেয়, সেখানে স্ট্রাকচার করতে তো এক বছর সময় লাগবেই।
“আর শুধু মাটি ভরাট করলেই তো হবে না। সেখানে ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) করতে হবে। বিদ্যুৎ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাসহ বিশাল একটা কর্মযজ্ঞ আছে। আমার মনে হয় না খুব সহজেই তারা এগুলো শেষ করতে পারবে।”
‘গতিহীন’ প্রশাসন
নিমতলী দুর্ঘটনার নয় বছর বাদে চুড়িহাট্টায় বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পর আবার শুরু হয় রাসায়নিকের কারখানা, গুদাম সরানোর তোড়জোড়।
২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ৩১০ একর জমিতে ‘বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক স্থাপন (সংশোধিত)’ প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। ওই বছরের ১২ জুন শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। জানান হয়, ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ টাকার এ প্রকল্পের আওতায় তৈরি হবে ১ হাজার ৮৪৩ প্লট।
গত বছরের জুনে প্রকল্প শেষ করতে না পারায় এর মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয় বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন ‘বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রকল্প’ পরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ২০২৪ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ করার সময় বেঁধে দিয়েছে।
কেন দেরি হল?- এই প্রশ্নে হাফিজুর দায় দেন বালু ভরাটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে। তিনি বলেন, “জমি অধিগ্রহণ শেষে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন বিসিককে জমি বুঝিয়ে দেয়। বালু ভরাটের জন্য ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল মাটি ভরাট কাজের জন্য নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ডকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ২৮ এপ্রিল থেকে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।”
যে সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা, সেই ২০২২ সালের জুনের মধ্যে মাটি ভরাটের কাজ হয় কেবল ৬০ শতাংশ।
“২০২১ সালে আমরা ভূমি উন্নয়ন শুরু করে এক বছরে তা শেষ করা কঠিন। মাঝখানে আবার প্রকল্পের টাকা ছিল না। গত জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে কাজও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রাস্তা, ড্রেন, কালভার্ট, ইটিপি, সীমানা দেয়াল নির্মাণ করা যায়নি। তবে চলতি মাস পর্যন্ত মাটি ভরাট হয়েছে ৮০ শতাংশ। আমরা আশা করছি, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে প্লট বুঝিয়ে দিতে পারব,” বলেন বিসিক কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের প্রকল্প পরিচালক।
প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় ১ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা থেকে কমে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। খরচ কমার নেপথ্যে নতুন এক সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার না করে অঞ্চলভেদে এই ইটিপি করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। জমি অধিগ্রহণেও টাকা কিছু কম খরচ হয়েছে।
১৩ বছরে যা যা হল
২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পরের বছর আন্তঃমন্ত্রণালয় একটি কমিটি ঢাকার কেরানীগঞ্জের সোনাকান্দা মৌজায় ২০ একর জমি চিহ্নিত করে। সেখানে ১৭ তলার কয়েকটি ভবন তৈরি করে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিতে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপিও করে।
তার সাত বছর পর ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর ‘বিসিক কেমিকেল পল্লী, ঢাকা’ প্রকল্প সায় পায় একনেকে। বলা হয়, ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় বিসিকের এই প্রকল্পের আওতায় কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ ব্রাহ্মণকীর্ত্তা মৌজায় ৫০ একর জমিতে হবে ৯৩৬টি প্লট হবে।
পরের বছর চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর প্রকল্পে সংযোজন আসে। সিদ্ধান্ত হয়, আগের জায়গায় নয়, এই পল্লী হবে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে। এর আয়তন বাড়ান হয় ছয় গুণ।
৩১০ একর জমিতে ‘বিসিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মুন্সিগঞ্জ (প্রথম সংশোধিত)’ প্রকল্প প্রস্তাব ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায় বিসিক।
সেটি সিরাজদিখানের কামারখান্দা, চিত্রকোট ও গোয়ালখালী মৌজা মিলিয়ে হওয়ার কথা।
নিমতলী, চুড়িহাট্টায় কী হয়েছিল
২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টার দিকে পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাসায়নিকের একটি গুদামে আগুন ধরে যায়।
ভবনটি ছিল ছয়তলার। নিচতলায় সে সময় দুই বোন রুনা ও রত্না এবং পাশের বাড়িতে আসমা নামে এক মেয়ের বিয়ের আয়োজন চলছিল। নিচতলায় চলছিল রান্না।
এই রান্নার জায়গার পাশেই ছিল রাসায়নিকের গুদামটি। সেখানে থাকা রাসায়নিকভর্তি প্লাস্টিক ড্রামগুলো গলে যায়। এরপর রাসায়নিকের কারণে ছড়ায় আগুন। বিকট শব্দে ঘটতে থাকে বিস্ফোরণ। রাসায়নিকগুলো তপ্ত লাভার মতো ছড়িয়ে পড়ে পুরো এলাকায়।
নিচতলায় থাকা পরিবারের ১১ জনের মৃত্যু হয় তাৎক্ষণিক। সামনের ৫৫ নম্বর বাড়ির ৬ জন এবং বিয়ের বাড়ি লাগোয়া বাড়ির আরও ছয়জনের মৃত্যু হয়। শেষমেশ মৃতের সংখ্যাটি সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় ১২৫ জনে।
বিয়ের সাজের জন্য পার্লারে থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে যান তিন কনে। শোক শেষে তাদেরকে ‘নিজের কন্যা’ উল্লেখ করে গণভবনে নিয়ে বিয়ের আয়োজন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বামীদের দেন চাকরি।
এর নয় বছর পর চুরিহাট্টায় ফের মৃত্যুর বিভীষিকা। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সেখানে ওয়াহেদ ম্যানশন নামে চার তলা ভবনে লাগে আগুন। পরে বোমার মতো বিস্ফোরণে তা ছড়িয়ে পড়ে চার পাশে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের পাঁচটি ভবন।
গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভবনগুলোতে থাকা রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক ও পারফিউমের দোকান-গুদাম থাকায় মুহূর্তেই গোটা এলাকা পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে ছাই হয়ে যান। আগুনের প্রচণ্ডতায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় দোকান-পাট, রিকশা-গাড়ি।
নরককুণ্ডের ক্ষেত্র যেন ‘তৈরি হয়েই ছিল’
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড: ক্যানেস্তারাগুলো কাজ করেছে ‘বোমার মত’
ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ৬৭ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে।
দুর্ঘটনায় চুড়িহাট্টা এলাকায় অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপে রূপ নেয় আশপাশের সব সড়ক।
এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মো. জুম্মনের ছেলে মো. আসিফ সে সময় একটি মামলা করেন। তিন বছর তদন্তের পর ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইউম। তবে বিচার এখনও শেষ হয়নি।
ঢাকার অষ্টম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আগামী ১৪ মার্চ সাক্ষ্য গ্রহণের কথা আছে।
আসামিরা কোথায়- এই প্রশ্নে ওসি কাইউম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেটা আদালত বলতে পারবে। তবে তাদের নামে এখন থানায় কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই।”