তারা আসেন ওয়াহেদ ম্যানশনে, দুঃসহ সেই স্মৃতি জাগে

চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশন ফিরেছে আগের রূপে; তবে নিহতদের পরিবারগুলোকে এখনও তাড়া করছে অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি।

কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2023, 04:56 PM
Updated : 20 Feb 2023, 04:56 PM

চুড়িহাট্টায় গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ভবনের মধ্যে ওয়াহেদ ম্যানশনের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই; তবু সবাই এক নামে চেনে এই ভবন; পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক বার তাকিয়ে দেখে।

এখন দেখলে বোঝার উপায় নেই; তবে চার বছর আগে এই ভবনে লাগা আগুনে নরককুণ্ডে রূপ নিয়েছিল পুরান ঢাকার ব্যস্ত এলাকা চকবাজারের চুড়িহাট্টা।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির সেই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ৭১ জন, আহত হন বহু মানুষ। ১৫ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভানোর পর চারতলা ওয়াহিদ ম্যানশন কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বেশ কিছু দিন।

Also Read: নরককুণ্ডের ক্ষেত্র যেন ‘তৈরি হয়েই ছিল’

Also Read: চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড: ক্যানেস্তারাগুলো কাজ করেছে ‘বোমার মত’

চার বছর পর ভবনের নতুন কাঠামো অগ্নিকাণ্ডের চিহ্ন মুছে দিয়েছে, তবে সেই স্মৃতি মন থেকে মুছে যায়নি অনেকের।

তাদেরই একজন হোসনে আরা, বাড়ি মানিকগঞ্জে, ঢাকায় থাকেন রায়েরবাগে। এই অগ্নিকাণ্ডে ছেলে রেজাউল করিমকে (২০) হারিয়েছেন তিনি।

সোমবার সকালে হারানো ছেলের শেষ চিহ্ন খুঁজে পেতে উপস্থিত হন ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছেলেকে হারিয়ে নগর ভবনে চাকরি পেয়েছি, কিন্তু তবুও মনে হয়, চাকরির চেয়ে ছেলেটাই দরকার ছিল।”

আরও কিছু বলতে চেয়েও আর পারলেন না হোসনে আরা। আবেগে ধরে আসে তার কণ্ঠ।

শ্রমিকের কাজ করতেন রেজাউল। তার আয়েই চলত সংসার। হোসনে আরার আরেক ছেলে আছেন। তবে রেজাউল মারা যাওয়ার সময় সে ছিল ছোট।

হাজেরা বেগম নামে এক নারীকেও পাওয়া যায় ওয়াহিদ ম্যানশনের সামনে। সেই অগ্নিকাণ্ডে রিকশাচালক স্বামী আনোয়ার হোসেনকে হারিয়েছেন তিনি।

হাজেরা বলেন, “চার সন্তান নিয়ে চলছি। বড় মেয়ে বীথিকে এখনও বিয়ে দিতে পারিনি। এটা নিয়ে চিন্তায় আছি।”

স্বামীর মৃত্যুর পর হোসেনা আরার মতো হাজেরাও নগর ভবনে চাকরি পেয়েছেন। তেমনি চাকরি পেয়েছেন নিহত ব্যবসায়ী ফয়সালের স্ত্রী ফাতেমা বেগম।

তবে নিহত দিনমজুর সিদ্দিকুল্লাহর ছেলে আহসান উল্লাহ বলেন, তার বাবা ওই অগ্নিকাণ্ডে নিহত হলেও তার চাকরি জোটেনি। কারণ তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন পরে।

লিটন ‘ভালো আছেন’

সেই রাতে আগুনে হুড়মুড় খেয়ে মুদি দোকান ফেলে দৌড়ে জীবন বাঁচিয়েছিলেন লিটন। সেই আতঙ্ক ভুলতে অনেক দিন লাগলেও এখন সেই পীড়া কমেছে বলে জানান তিনি।

লিটন এখনও মুদি দোকানই চালাচ্ছেন। সোমবার সকালে দোকানে গেলেই মুখভর্তি হাসি দিয়ে বললেন, “জানি, আজ আপনারা (সাংবাদিক) আসবেন।

“এখন ভালো আছি অনেক দিন (চার বছর) হল তো। তাই হয়ত এখন আর ঘুমে অত জ্বালাতন করে না।”

যেমন আছে বৃষ্টি ও দোলার পরিবার

ভয়াবহ সেই আগুন দুই বান্ধবী ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি ও রেহনুমা তারান্নুম দোলাকে কেড়ে নিয়ে মুছে দেয় দুই পরিবারের আনন্দ।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের চাইল্ড কেয়ার বিভাগের শিক্ষার্থী বৃষ্টির বাসা হাজি রহিম বক্স লেনে আর ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের আইনে পড়ুয়া দোলার বাসা শেখ সাহেব বাজার রোডে। দুই বাসাই চুড়িহাট্টার কাছে।

শিল্পকলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে রিকশায় করে চুড়িহাট্টা মোড় দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন বৃষ্টি আর দোলা। শৈশবে অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ার সময় দুজনের যে বন্ধুত্ব, আগুনে ঘটে তার সমাপ্তি।

Also Read: চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে নিখোঁজ বৃষ্টি-দোলা

চার বছর পর খবর নিতে গেলে বৃষ্টির মা শামসুন্নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেটা ভোলার নয়, তা ভুলতে পারছি না। বারবার মেয়ের স্মৃতি ফিরে আসে, তাড়া দেয়, মনকে এলোমেলো করে দেয়।”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটু সময় নিয়ে বলেন, “কষ্ট ভুলতে বাসাও বদল করছি, কিন্তু হচ্ছে না।”

দোলার মা সুফিয়া রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, দোলার ছোট বোন মালিয়া মেহবীন নুসা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স পেয়েছে গত বছর।

“দোলা বেঁচে থাকলে কত খুশি হত। জানি না, মেয়ে আমার সেই জগত থেকে দেখতে পাচ্ছে কি না?”

রানা ও রাজুর ভাইয়ের আক্ষেপ

সেই রাতে আগুনে পুড়ে যান দুই ভাই মাসুদ রানা (৩৮) ও মাহবুবুর রহমান রাজু (৩৪)। তাদের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি। তবে ছোটবেলা থেকে থাকেন ছুড়িহাট্টায়। ওয়াহেদ ম্যানসনে দুই ভাই ‘এম আর টেলিকম সেন্টার’ নামের দোকান চালাতেন।

রানা ও রাজুর ছোট ভাই মেরাজ বলেন, “চেয়েছিলাম ওয়াহেদ ম্যানশনে একটি দোকান নিয়েই দুই ভাইয়ের স্মৃতি ধরে রাখব। কিন্তু পারিনি। অনেক টাকা ভাড়া ও পজেশন চান। তাই এখন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি।”

পারিবারিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বৃদ্ধ বাবা (সাহেব উল্লাহ)কে নিয়ে কোনো মতে বেঁচে আছি। আর কারও জীবনে যেন আমাদের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা না হয়।”

ভবন আবার জমজমাট, মামলায় বরফ গতি

আগুনে নিহত চুড়িহাট্টার ওয়াছি উদ্দিন মাহিদের (২২) ভাই আশিক উদ্দিন সৈনিক নিহত ৭১ জনের মধ্যে ৩০ জন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুড়িহাট্টা আগ্নিকাণ্ডে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সংস্থা করছেন।

তাদের সাতটি দাবির মধ্যে রয়েছে- ভবন মালিককে গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে, মালিক ও গুদাম মালিককে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের একজন সদস্যকে সরকারি চাকরি, ক্ষতিপূরণ ও দোকান বরাদ্দ দিতে হবে, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম সরাতে হবে, নকল প্রসাধনী গুদাম সিলগালা করতে হবে,

ঘনবসতি এলাকার চৌরাস্তার মোড়ে একটি ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপন করতে হবে।

আগুনে পুড়ে যাওয়া ওয়াহেদ ম্যানশনে সংস্কার কাজ করা হয়েছে। ভবনের নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় গড়ে উঠেছে ব্যাংক, টেলিকম, বেকারি, কম্পিউটারের দোকান। রীতিমতো কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে ভবনটি। তৃতীয় তলায় এখনও কাজ চলছে। চতূর্থ তলায় প্রয়াত ওয়াহেদের দুই সন্তান বসবাস করছেন বলে এলাকাবাসী জানান।

রানা ও রাজুর ভাই মেরাজ বলেন, ২০২১ সালে ভবনটি সংস্কার করে ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে মালিকপক্ষ। তারপর থেকেই এই ভবন আগের রূপে ফিরে এসেছে।

ভুট্টু নামে একজন মাছ দোকানি ভবনটির নিচে প্রতিদিন সকালে মাছ নিয়ে বাসেন। দিনের অন্য সময় এই এলাকায়ই থাকেন। বিকালে ভবনের নিচে রাস্তায় অনেক দিনমজুর জড়ো হয়। অগ্নিকাণ্ডের আগেও দিনমজুর একত্র হয়ে আড্ডা দিত ভবনটির সামনের চৌরাস্তায়।

আবুল বাশার নামে স্থানীয় একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এতবড় একটি ঘটনা ঘটল, এত মানুষ মারা গেল, অথচ আসামিরা সবাই বাইরে!”

অগ্নিকাণ্ডে নিহত মো. জুম্মনের ছেলে মো. আসিফ সে সময় একটি মামলা করেন। তিন বছর তদন্তের পর ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইউম। তবে বিচার এখনও শেষ হয়নি।

চকবাজার থানার ওসি কাইউম বলেন, ভবনের মালিকের দুই ছেলে হাসান ও সোহেল, রাসায়নিক গুদামের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল ইকবাল, ব্যবস্থাপক মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াব আতির, মো. নাবিল ও কাশিফ উদ্দিনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছেন।

আসামিরা কোথায়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা আদালত বলতে পারবে। তবে তাদের নামে এখন থানায় কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই।”

Also Read: চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড: ৭১ মৃত্যুর জন্য ৮ জনের দায় পেয়েছে পুলিশ