চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড: ৭১ মৃত্যুর জন্য ৮ জনের দায় পেয়েছে পুলিশ

চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তিন বছর তদন্ত চালিয়ে আটজনের দায় পেয়েছে পুলিশ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Feb 2022, 07:12 PM
Updated : 20 Feb 2022, 08:03 PM

এই আটজনের মধ্যে ওয়াহিদ ম্যানশনের মালিকদের পাশাপাশি রয়েছেন ওই ভবনের গুদামের ভাড়াটিয়ারা। প্রসাধনী সামগ্রীর ওই গুদামে থাকা দাহ্য পদার্থই ভবনটিকে অগ্নিকুণ্ড করে তুলেছিল পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন অনেকে।

চার তলা ভবন ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে সেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। পরে তা ছড়িয়ে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আশপাশের পাঁচটি ভবন।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা ভবনগুলোতে থাকা রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক ও পারফিউমের দোকান-গুদাম থাকায় মুহূর্তেই গোটা এলাকা পরিণত হয় অগ্নিকুণ্ডে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে ছাই হয়ে যান। আগুনের প্রচণ্ডতায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় দোকান-পাট, রিকশা-গাড়ি।

ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১৪ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ৬৭ জনের পোড়া লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ জনে।

অগ্নিকাণ্ডে নিহত মো. জুম্মনের ছেলে মো. আসিফ একটি মামলা করেন। তিন বছর তদন্তের পর গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আটজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন চকবাজার থানার ওসি আবদুল কাইয়ুম।

অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়- হাসান সুলতান, হোসেন সুলতান সোহেল, ইমতিয়াজ আহমেদ, মোজাম্মেল ইকবাল, মোজাফফর উদ্দিন, জাওয়াদ আতিক, মোহাম্মদ নাবিল ও মোহাম্মদ কাশিফকে।

এদের মধ্যে দুই ভাই হাসান সুলতান ও হোসেন সুলতান হলেন ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক। ১০ কাঠা জমিতে নির্মিত ভবনটির দোতলার পুরোটা জুড়েই ছিল গুদাম। অন্যান্য তলায় ছিল বিভিন্ন দোকান।

বিভীষিকাময় অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী নন্দ কুমার দত্ত রোডের পুড়ে যাওয়া চারতলা বাড়ি। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

বাকি আসমিরা সবাই পার্ল ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে মালিক-কর্মকর্তা-কর্মচারী। পার্লের গুদাম থেকেই আগুন ছড়িয়েছিল।

আসামিদের মধ্যে ইমতিয়াজ পার্ল ইন্টারন্যাশনালের মালিক, ইকবাল পরিচালক এবং মোজাফফর ব্যবস্থাপক। জাওয়াদ আতিক, নাবিল ও কাশিফ পার্ল ইন্টারন্যাশনালের কর্মী।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, দুই ভাই হাসান ও হোসেন অবৈধ জেনেও আবাসিক ভবনে রাসায়নিকের গুদাম ভাড়া দিয়েছিলেন ‘পার্ল ইন্টারন্যাশনাল’কে। আর ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মীরা জান-মালের ক্ষতি হতে পেরে জেনেও দাহ্য পদার্থের মজুত, সংমিশ্রণের কাজ করতেন। তাদের অবহেলার কারণেই এত মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটেছে।

বাড়িওয়ালা হাসান সুলতান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, পার্ল ইন্টারন্যাশনাল ভাড়া নেওয়ার সময় জানিয়েছিল তারা বিভিন্ন প্রকার পারফিউম, বডি লোশন, অলিভ ওয়েল, বেবি পাউডার, বেবি লোশন, কটন বাড, ডায়াপার ইত্যাদির ব্যবসা করে। প্রতিষ্ঠানের ‘বিহারি’ মালিক গুদামে তেমন একটা আসতেন না। ‘বিহারি’ দুই ভাই নাবিল ও কাশিফ ওই কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ করতেন।

তবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে, সেলসম্যান হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও নাবিল ও কাশিফ দুই ভাই ওই কোম্পানির অংশীদার বলে সাক্ষীদের কাছ থেকে জানা গেছে।

অভিযোগপত্রে মোট ১৪১ জনকে সাক্ষী করেছে পুলিশ।

এই অভিযোগপত্র আদালত আমলে নেওয়ার পর অভিযোগ গঠন হলে তবেই আসামিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হবে।

অগ্নিকাণ্ডের পর পুলিশ আসামিদের আটজনকেই গ্রেপ্তার করেছিল। তবে তাদের কয়েকজন জামিনে ছাড়া পেয়ে যান পরে।

অভিযোগপত্র দাখিলকারী কর্মকর্তা ওসি কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে বলেন, “আমরা তদন্তে পাওয়া আমাদের অনুসন্ধান দাখিল করেছি। সব আসামিই এখন আদালতের এখতিয়ারে।”

আসামিরা এখন কজন বন্দি আছেন- জানতে চাইলে তিনি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি।

“কেউ কেউ জামিন নিয়ে থাকতে পারেন,” বলেন তিনি।

বিভীষিকাময় অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী নন্দ কুমার দত্ত রোডের পুড়ে যাওয়া চারতলা বাড়ি। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

পার্লের ৩টি গুদাম ছিল ভবনে

ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় পার্ল ইন্টারন্যাশনালের তিনটি গুদাম ছিল। প্রতিষ্ঠানটি নানা রকম প্রসাধনীর ব্যবসা করে।

ভবনের দ্বিতীয় তলার একপাশে পার্ল ইন্টারন্যাশনালে নিজস্ব গুদাম ছিল। আরেক পাশে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মোজাফ্ফর গুদাম হিসেবে ভাড়া নিয়ে স্কচটেপ ও এনার্জি বাল্বের ব্যবসা করতেন। ভবনের তৃতীয় তলার এক পাশে ছিল পার্লের গুদাম ছিল। চতুর্থ তলার একপাশেও পার্লের গুদাম ছিল।

অভিযোগপত্রে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ওই ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় বিপুল পরিমাণ বডি স্প্রে, অ্যারোসল, গ্যাস লাইটারের ফুয়েল মজুদ করা ছিল।

বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের আলোকে পার্ল ইন্টারন্যাশনালের গুদামকেই অগ্নিকাণ্ডের উৎসস্থল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে পুলিশের অভিযোগপত্রে।

এতে বলা হয়, দোতলায় পলিব্যাগ সিল মেশিনের কাজের সময় সৃষ্ট তাপে বা যে কোনোভাবে ইলেকট্রিক স্পার্ক ওই বিস্ফোরক মিশ্রণের সংস্পর্শে এলে দোতলায় বিস্ফোরণ ঘটে এবং সব দেয়াল ভেঙে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নিকাণ্ডের পর প্রথমে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকে দায়ী করা হচ্ছিল, পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে আসলে তা ঠিক নয়।

বুয়েটের কেমি কৌশল বিভাগের একটি প্রতিনিধি টিম মঙ্গলবার পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পরিদর্শন করে। বলা হচ্ছে, রাসায়নিক গুদামের কারণে এই আগুন ভয়াবহতা পেয়েছিল।

অতিদাহ্য সুগন্ধী

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওই ঘটনার পর পুলিশ চার ধরনের ৪৯টি আলামত সংগ্রহ করে। আলামতের মধ্যে ২৬টি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনীর টিউব, বোতল ও ক্যান। এসব আলামত পরীক্ষার জন্য সিআইডির পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল। তাতে সুগন্ধিগুলো থেকে আট রকমের উচ্চ মাত্রার দাহ্য বস্তুর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

সেই অভিযোগপত্রে আগুনের বিস্তারের কারণ হিসেবে অতি দাহ্য ওই রাসায়নিককে দায়ী করা হয়েছে, যা পাওয়া গেছে ১০ রকমের (ব্রান্ডের) সুগন্ধির ক্যানিস্টার ও বোতল থেকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন,আগুন লাগার পর ওয়াহিদ ম্যানশনে সশব্দে ক্যানগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছিল। বিস্ফোরিত জ্বলন্ত ক্যান উড়ে এসে রাস্তাতেও পড়ে।

সুগন্ধী তৈরিতে ব্যবহৃত অতি দাহ্য রাসায়নিকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইথাইল অ্যালকোহল, বিউটেন, আইসো বিউটেন, প্রোপেইন, বুটোক্সি ইথানল, গ্লাইকল ইথার, ডাইইথাইল থালেট ও প্রোপিলিন। 

সাধারণত লাইটারের গ্যাস হিসেবে ব্যবহৃত বিউটেন অতি উচ্চ মাত্রার দাহ্য হিসেবে বিবেচিত। আইসো বিউটেন ব্যবহৃত হয় জ্বালানি তেল, রেফ্রিজেটরের শীতক হিসেবে, অ্যারোসল স্প্রের উপাদান হিসেবে। এলপিজি, এলএনজিসহ নানা গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হয় প্রোপেইন গ্যাস। বুটোক্সি ইথানল ব্যবহার করা হয় রং (পেইন্ট) ও থিনারে। গ্লাইকল ইথার ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরনের পরিষ্কারক রাসায়নি (ক্লিনিং কম্পাউন্ড), তরল সাবানসহ নানা ধরনের প্রসাধন তৈরিতে। ডাইইথাইল থালেট প্লাস্টিক, কীটনাশকসহ নানা উপকরণ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। প্রোপিলিন ইনজেকশন তৈরির প্লাস্টিক মোল্ডসহ নানা রাসায়নিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এগুলো সব রাসায়নিক নানাভাবে সুগন্ধি তৈরিতে ব্যবহার হয়। এগুলোর নানা মাত্রার মিশ্রণে সুগন্ধির রং ও গন্ধের তারতম্য  আনা হয়।

চকবাজার হচ্ছে বাংলাদেশের প্রসাধন শিল্পের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার। স্নো, ক্রিম, পাউডার থেকে শুরু করে নামী-দামী ব্রান্ডের পারফিউম ও প্রসাধনী পাওয়া যায় এখানে। তবে চকবাজারে নকল প্রসাধনী তৈরি ও বিক্রির কুখ্যাতিও রয়েছে।

চকবাজারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন এরকম নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখানকার অনেক ব্যবসায়ী চীন থেকে সস্তায় নামী-দামী ব্রান্ডের বোতল বা ক্যান বানিয়ে আনেন। এরপর সেগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি রাসায়নিক ভরেন। ওয়াহেদ ম্যানশনেও মূলত এমন সুগন্ধি তৈরি হত।

তবে সেখানে নকল পণ্য তৈরি হত কি না, পুলিশের অভিযোগপত্রে তার কোনো উল্লেখ নেই।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা সরানো না হলে আবারও একই ঘটনা ঘটার শঙ্কা থেকেই যায়।

“সেই নিমতলীর আগুনের পর থেকেই পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও সমস্ত কারখানাগুলো সরিয়ে নিতে সরকারকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এখনো সেটার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখছি, পুরান ঢাকার বাড়ি মালিকেরাও লোভে পড়ে বসতবাড়িতে এরকম কারখানা বা গুদাম ভাড়া দিচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, যে ঘরটি কোন পরিবারকে ভাড়া দিলে মাসে ৫০০০ টাকা পাওয়া যায় সেই ঘরটি কোন গুদাম বা কারখানাকে ভাড়া দিলে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া পাওয়া যায়। অনেক বাড়ি মালিক লোভের এই হাতছানি উপেক্ষা করতে পারেন না। এই কারখানা ও গুদামগুলো সরিয়ে নিতে সরকারকে শক্ত হতে হবে। পুরান ঢাকার পরিস্থিতি না বদলালে আমাদের আবারও এরকম প্রাণহানি দেখতে হতে পারে।”