বগি থেকে নামিয়ে আনার পর যাত্রীদের নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে দিতেও সাহায্য করেছেন স্থানীয়রা।
Published : 06 Jan 2024, 10:13 AM
বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার পর শিশুসন্তানকে বাঁচাতে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন দর্শনার আশরাফুল ইসলাম। আশপাশ থেকে যাত্রীদের উদ্ধারে ছুটে আসা এক তরুণ তার তিন বছরের সন্তানকে ‘ক্যাচ ধরে’ প্রাণে বাঁচান।
ট্রেনটিতে আগুন লাগার পর মাটি থেকে চার ফুটের মতো উচ্চতার ট্রেনের পাটাতন বেয়ে বা জানালা দিয়ে নামতে পারছিলেন না অনেকেই। অল্পবয়সী নারীরা লাফ দিয়ে বা কোনোরকমে নেমে আসলেও বয়স্ক নারী এবং শিশুরা যখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন, তাদের কাঁধে করে নামিয়ে এনেছেন উদ্ধারকারীরা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগির জানালা বাঁশ দিয়ে ভেঙে যাত্রীদের টেনে বের করেছেন অনেকে।
ভোট ঠেকাতে বিএনপির ডাকা হরতালের আগে শুক্রবার রাত নয়টার দিকে রাজধানীর গোপীবাগ কাঁচাবাজারের কাছে এসে থেমে যায় বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি। স্থানীয়রা দেখতে পান ট্রেনের কয়েক বগি থেকে ধোঁয়া উঠছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে যাত্রীদের আর্তচিৎকার।
সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন অগ্নিকুণ্ড থেকে যাত্রীদের উদ্ধারে। স্থানীয়রা যাত্রীদের কেবল উদ্ধার করেননি, বগি থেকে নামিয়ে আনার পর যাত্রীদের নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে দিতেও সাহায্য করেছেন; দুর্ঘটনাস্থল থেকে দূরে নিরাপদ জায়গায় এনে বসিয়েছেন, তাদের খাবার দাবার দিয়েছেন। সঙ্গে ব্যাগ-জিনিসপত্র খুঁজেও দিয়েছেন কেউ কেউ এবং ঢাকায় গন্তব্যে যেতেও সহযোগিতা করেছেন।
বেনাপোল থেকে দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি ঢাকায় আসছিল; এ ঘটনায় অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে, দগ্ধ হয়েছেন তিনজন।
আগুন লাগার পর ট্রেনের নিরাপত্তায় থাকা রেল পুলিশই চেইন টেনে ট্রেন বন্ধ করে দেয় বলে জানান ঘটনাস্থলে থাকা রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি দিদার আহমদ।
এই দুর্ঘটনায় স্থানীয় মানুষের সক্রিয় সহযোগিতার প্রশংসা করেছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “ট্রেনের নিরাপত্তায় পাঁচজন রেল পুলিশ ও দুজন আনসার সদস্য ছিলেন। ট্রেন থামানোর পরে ফায়ার ব্রিগেড আসতে আসতে একটা থেকে দুইটা এবং শেষ পর্যন্ত তিনটা বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
“এর মধ্যেই জনগণ আমাদের প্রচুর হেল্প করেছে। স্থানীয় মানুষজন উদ্ধারকাজ করেছে।”
উদ্ধারকাজের বর্ণনায় জাহাঙ্গীর আলম নামের একজন ওষুধের দোকানি বলেন, “মাটি থিকা লাইনটা অনেক উঁচা। তার উপরে ট্রেনের পাটাতন আরও উঁচা। লোকজন উপর থিকা লাফায়া পড়তাছিল। ইয়াংরা লাফাইতে পারলেও মহিলা, বয়স্ক, বাচ্চারা নামতে পারতাছিল না। পরে লোকজন ধইরা-মইরা নামাইছে। একটা পোলারা দেখলাম এক মহিলারে কান্ধে কইরা নামাইল।”
ট্রেনের বগি থেকে লাফিয়ে পড়ায় অনেকে আহতও হয়েছেন।
রীতা নামের এক যাত্রী বলেন, “বগি থেকে নীচে লাফ দেওয়ায় হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছি। এখন হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।”
স্থানীয় মনোয়ারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন আহতদের কয়েকজন। এই হাসপাতালের কর্মচারি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, ট্রেনের চার যাত্রীকে স্থানীয় কয়েকজন নিয়ে এসেছিলেন। তারা আগুনের ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই তারা হাসপাতাল ছাড়েন।
বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন: বোনের খোঁজে বোন, স্ত্রীকে খুঁজছেন স্বামী, শিশুর খোঁজে মাইকিং
ইমতিয়াজ নামের ভারতফেরত এক যাত্রী চিন্তিত ছিলেন তার হারিয়ে যাওয়া ব্যাগের জন্য। যে ব্যাগে তার পাসপোর্টসহ কাগজপত্র ও টাকা পয়সা ছিল।
বগি থেকে কীভাবে বের হলেন জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ইমতিয়াজ বলেন, “আমি ট্রেনের উপর থিকা ফাল দিয়া পড়ছি। তয় মহিলারা ভয় পাইতাছিল। লোকজন তাগোরে টাইনা-টুইনা নামাইছে।”
গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা আগুন লাগার পর উদ্ধার কাজে অংশ নেন। চোখের সামনে ট্রেনের জানালায় শরীরের একাংশ বাইরে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তিকে পুড়তে দেখেন তিনি।
তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করা হলেও লাভ হয়নি জানিয়ে মাসুদ রানা বলেন, “‘আমার বাসা রেললাইনের পূর্ব পাশে। ঘুমাইতে ছিলাম। ফোন দিয়ে একজন খবর দিছে আগুন লাগছে বেনাপোল এক্সপ্রেসে। খবর শুইন্যা বের হই। তখন দেখি ‘চ’ বগির এক লোক জানালায় আটকে ছিল। আমি তারে ধরে বের করতে চাইছিলাম।
“তার ঘাড়ের উপর জানালা নেমেছিল। জানালা ভেঙে তাকে বের করার চেষ্টা করছিল। তখন ওই ব্যক্তি বললেন, ‘আমার বাচ্চা ও বউ অলরেডি পুইড়া গেছে। আমারও ৯০ পারসেন্ট পুইড়া গেছে। আমি আর বের হয়েই বা কী করব। থাইকাই বা কী লাভ?”
ততক্ষণে বগিটির বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গিয়েছিল। আগুনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছিল উত্তাপ। এক সময় উদ্ধারের চেষ্টায় থাকা মানুষদেরকে সরে আসতে হয় নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে।
মাসুদ রানা বলেন, “গরমে ট্রেনের কিছুই ধরা যাচ্ছিল না। তারে টাইনা নামানোর চেষ্টা করছি, বের করতে পারি নাই।”
জানালায় আটকে থাকা অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করার একাধিক ভিডিও করেছেন পথচারীরা। সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিও আর ছবি নাড়া দিয়েছে অনেককে।
মাসুদ রানা বলেন, আগুন লাগা বগিগুলো (চ ও ছ) শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল।
“জানালাগুলো একেবারে সিলড ছিল, খোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। লোকজন বাঁশ নিয়ে এসে জানালা ভেঙে যাত্রীদের বের করছে। স্থানীয় মানুষ পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। আগুন এত বড় ছিল যে হাতে পানি দিয়ে তা নেভানো সম্ভব ছিল না।”
আগুন লাগার বেশ কয়েকমিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো কে এম দাস লেন হয়ে ঘটনাস্থলে আসে। সরু গলির কারণে গাড়িগুলোর ঢুকতে বেগ পেতে হয়।
আগুনে চারটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়ে রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অপারেটর মোখলেছুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সায়দাবাদ এলাকা অতিক্রমকালে বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘চ’ বগিতে প্রথমে আগুন দেখা যায়। এরপর পাওয়ার কার এবং আরো দুটি বগিতে আগুন ছড়িয়ে যায়।”
ট্রেনের দগ্ধ তিন যাত্রীকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন-চিকিৎসক কৌশিক বিশ্বাস, আসিফ মোহাম্মদ খান ও নাফিস আলম।
হাসপাতালে আসিফের বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান বলেন, ছেলের সঙ্গে ছিল তার পুত্রবধূও।
তিনি বলেন, “আগুন লাগার পর দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে আসিফ জানালা দিয়ে মাথা বের করেন। সে সময়ে লোকজন তাকে টেনে বের করতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি। মনে হয়, নাতাশা ট্রেনে রয়ে গেছে।”
গোপীবাগে যেখানে ট্রেনটি থেমেছে, সেখান থেকে কাছেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রসুলুল হক শাহীনের বাড়ি। ভোটের কারণে নেতা-কর্মীদের নিয়ে তিনি এলাকাতেই ছিলেন। আগুন লাগার খবর পেয়ে সবাইকে নিয়ে উদ্ধার কাজে অংশ নেন শাহীন।
শাহীন জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার পর তার বাড়ির সামনে ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য যে কোর্ট কাটা হয়েছিল, সেখানে যাত্রীদের সেবা করা হয়।
“আমার লোকজন যাত্রী পানি ও খাবারদাবার দেয়। পরে বাড়িতে যেতে সহায়তা করা হয় আটকে পড়া যাত্রীদের।”
রাত সাড়ে ১০টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায় অনেক যাত্রীর ভিড়।
তাদের একজন আতিয়ার রহমান বলেন, “‘ছ’ বগিতে আমারা এক পরিবারের ছয়জন ছিলাম। হঠাৎ সামনে থেকে আগুন আগুন চীৎকার আসে। এসময় ট্রেনটিও দাঁড়িয়ে যায়। সবাই মিলে ট্রেন থেকে নামি।”
অনেকেই জানান, তাড়াহুড়ায় ব্যাগ নিয়ে নামা সম্ভব হয়নি। আবার অনেকে ব্যাগ নিয়ে নামলেও ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু উদ্ধারকারীরা এই ব্যাগ খুঁজে দিয়েছেন। কিছু ব্যাগও কুড়িয়ে এনে সেখানে জড়ো করেছেন স্থানীয় লোকজন, যাদের মালিকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না।
চিৎকার, কান্না, বেঁচে ফেরার আনন্দ কিংবা আতঙ্কে যাত্রীরা। তারা পরিচিত-অপরিচিত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন; কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন স্রষ্টাকে।
ওই সময়ে হ্যান্ডমাইকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী টুকু বারবার ঘোষণা করছিলেন, শিশুসহ এলিনা নামে এক নারী নিখোঁজ রয়েছেন। এলিনা যদি এ ঘোষণা শুনতে পান তাহলে যেন তিনি এই ব্যাডমিন্টন কোর্টের সামনে আসেন।
সেখানেই বোনের খোঁজে উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাঘুরি করছিলেন তনিমা নামের ওই নারী।
তিনি বলেন, তার বোন এলিনা ইয়ামিনের সঙ্গে তার পাঁচ মাসের শিশু আরফান হোসনেও ছিল। আগুন লেগে ট্রেন থামার পর থেকে আর তাদের খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তাদের বাড়ি রাজবাড়ি।
এরমধ্যেই গোলাপবাগ মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা আসছিল তিন বছরের শিশু আব্দুল্লাহকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বাবা মো. বাদশাহ শিশুটিকে খুঁজছেন। কেউ পেয়ে থাকলে যেন মসজিদে শিশুটিকে নিয়ে আসেন।
সেখানে দেখা হয় ‘ছ’ বগির যাত্রী আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। নিজের সন্তান আর স্ত্রীকে আঁকড়ে ধরে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন বারবার।
আশরাফুল বলেছেন, কুষ্টিয়ার দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেন তিনি। আগামী ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল তার। তবে এই যাত্রা আর হচ্ছে না। কারণ আগুনে তাঁর পাসপোর্ট, টিকিট ও লাগেজ পুড়ে গেছে। কিছুই বাঁচাতে পারেননি। তার তিন বছরের সন্তানকে বাঁচাতে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় এক উদ্ধারকারী শিশুটিকে ‘ক্যাচ ধরে’ প্রাণে বাঁচায়।
বিদেশ যাত্রা বাতিল হলেও পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছেন, এটাই সান্ত্বনা আশরাফুলের।
আশরাফুল বলেন, “হঠাৎ এক পুলিশ বলছে ‘চেইন টানেন, চেইন টানেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হইছে’ ওই পুলিশ বলল, ‘ভাই আগুন লাগছে। বলতে বলতে আমি ঘুরে আর কিছুই দেখতে পারছিনা, ধোঁয়া আর ধোঁয়া-এতো কালো ধোঁয়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
“আমার ছোট বাইচ্চাডাকে জানালা দিয়ে কোনোরকম ফেলে দিয়েছিলাম। নিচে এক লোক ‘ক্যাচ’ ধরার মতো ধইরে ফেলায় বেঁচে গিয়েছে। পরে আমার স্ত্রী ও আরেক ছেলে অনেক কষ্ট করে বের হইয়েছে। আমি জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আগুনে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।”
পরে স্থানীয়রা আশরাফুলের পরিবারকে তুলে এনে এই ব্যাডমিন্টন কোর্টে বসায়, পানি খেতে দেন।
সেজন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আশরাফুল বলেন, “এই মানুষগুলান ছুইটা না এলে আইজকে আরও বড় সর্বনাশ হইত।”