“এবার ভিড় নাই কারণ সমাবেশ চলছে, রাস্তায় গাড়ি-টাড়ি কম। মানুষ বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে,” বলেন একজন অভিভাবক।
Published : 28 Jul 2023, 06:33 PM
এসএসসিতে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া নজিফা ইফফাত জানাল, ফলাফল ঘোষণার দিন তার মা স্কুলে আসতে না পারলেও, তার সাফল্যের ‘সব কৃতিত্ব’ মায়ের।
এরপর ফলাফল উদযাপনে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী।
স্কুলের ধাপ পেরিয়ে, উচ্চশিক্ষার পথে একধাপ এগিয়ে যাওয়ার এমন আনন্দ শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা গেছে শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন স্কুলে।
স্কুলের মাঠে দলে দলে ড্রাম বাজিয়ে, গ্রুপ সেলফি তুলে, নেচে-গেয়ে ‘বাঁধভাঙা’ আনন্দ উদযাপন দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। তাদের সঙ্গে শামিল হয়েছে অভিভাবকরাও।
বেইলি রোডে ভিকারুননিসার মূল ফটকের সামনে ফলাফল প্রত্যাশী শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের ভিড় দেখা যায় সকাল থেকে। স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই বাসায় বসে অনলাইনেই ফলাফল জেনেছে। তবুও দুই রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ঘিরে অভিভাবকদের উদ্বেগ আর রোদ বা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে স্কুলে এসেছে কেবল বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে প্রাপ্তির আনন্দ ভাগ করে নিতে।
বেলা ১২টার দিকে স্কুলের ভেতরের পরিবেশ বদলে যায়, কড়া রোদের মধ্যে ড্রামের তালে চলে নাচ। একটি এমএফএস কোম্পানির তৈরি করে দেওয়া ফটো বুথগুলোর সামনে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে অবিরাম ছবি তুলতে থাকে শিক্ষার্থীরা।
তারা ছবি তোলে বাবা-মা এবং স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গেও। অনেকে আবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে ব্যস্ত।
নাজিফা ইফফাত বিডিনিউজকে বলে, “আলহামদুল্লাহ আমি সব সাবজেক্টে এ প্লাস পেয়েছি। এর জন্য পুরো ক্রেডিট আমার আম্মুর। যদিও সমাবেশের জন্য আম্মু আজ আসেনি, বাবার সাথে এসেছি আমি।”
ভিকারুননিসার শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান দিয়া এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে।
বড় বোনকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে আসা দিয়া বলে, “আমি বাসায় বসেই রেজাল্ট পেয়েছি। তারপর যখন শুনলাম যে আমার প্রায় সব বন্ধুরা স্কুলে আসবে, তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। মা যদিও নিষেধ করেছিল, এর মাঝে (রাজনৈতিক সমাবেশ) বের হতে।”
এতবছর প্রতিদিন রামপুরা থেকে বেইলি রোডে রিকশায় আসতে হয়েছে জানিয়ে দিয়া বললো,” গত ১০ বছর আমি অনেক কষ্ট করেছি। আল্লাহ আমায় আমার কষ্টের প্রতিদান দিয়েছে।”
তবে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের তিন সংগঠনের সমাবেশের কারণে তুলনামূকভাবে অনেক কম শিক্ষার্থী ও অভিভাবক স্কুলে এসেছেন বলে জানালেন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থী দিয়ার বোন নুসরাত জাহান রিয়া।
তিনি বলেন, “এটা তো কোনো ভিড়ই না। অন্যান্য বছর আরও ভিড় থাকে। এবার ভিড় নাই কারণ সমাবেশ চলছে, রাস্তায় গাড়ি-টাড়ি কম। মানুষ বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। আপনি দেখবেন, আজকে শুধু তারাই আসছে, যাদের বাসা স্কুলের আশেপাশে।”
বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পাওয়া নাজিয়া নূর তাজা জানালো, ভালো ফলাফলের বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল সে।
“আমি জানতাম যে আমি ভালো করব। কারণ আমার সব পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তারপরও একটা টেনশন তো থাকেই। ফাইনালি আজকে যখন রেজাল্টটা দেখলাম, টেনশন ফ্রি হলাম।”
শিক্ষার্থী অন্তরা বোসের সঙ্গে কথা হলে সে জানাল, বুয়েটে তার লক্ষ্য। এজন্য আরও মনোযোগী হবে এইচএসসিতে।
“আমি গোল্ডেন পেয়েছি, আমার মার্কসও ভালো এসেছে। আমার স্বপ্ন আমি বুয়েটে পড়ব। এইচএসসিতে আরও ভালো করা আমার মূল লক্ষ্য এখন।”
অন্তরার মা রূমা বোস বললেন, “ওর পড়াশুনা বা রেজাল্ট নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয়নি আসলে। কারণ আমদের বলার আগে ও নিজেই নিজের পড়াটা পড়ত।”
বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাসফিয়া মজুমদারের মা মাকসুদা আক্তার জানালেন, এখন ভালো কলেজ নিয়েই তার চিন্তা।
“বাবা-মা হিসেবে আমরা তো মেয়ের রেজাল্টে খুবই খুশি। এখন আবার কলেজে ভালো করলেই হয়।”
তবে মেয়ে মুশফিকা রহমান লুবানার পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে একটু মন খারাপ বাবা মশিউর রহমান লিটনের। কারণ মুশফিকা জিপিএ ফাইভ পেলেও দুটো বিষয়ে তার এ গ্রেড এসেছে।
লিটন বলেন, “আমরা খুশি, কিন্তু ও আরেকটু পড়লেই গোল্ডেনটা এসে যেত। আমি নিজে দেখেছি, ওর পড়াশুনায় কিছুটা ঘাটতি ছিল।”
তবে নিজের এই ফলাফলে বেশ সন্তুষ্ট লুবানা। সে বললো, “আমাদের কমার্সের রেজাল্ট এমনিতেই খারাপ হয়েছে একটু এবার। সেজন্য আমারও দুটো সাবজেক্টে মিস হয়েছে। কিন্তু এটা কোনো বিষয় না। আমি রেজাল্ট নিয়ে টেন্সড না। বাবার মনটা একটু খারাপ।“
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চলতি বছরে তার প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসিতে অংশ নেয় দুই হাজার ৯৮ জন শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে বিজ্ঞানে এক হাজার ৯১৭; মানবিক থেকে ৩২; এবং ব্যবসায় শিক্ষা থেকে ১৩৭ জন শিক্ষার্থীসহ তিন বিভাগ থেকে পাস করেছেন মোট দুই হাজার ৮৬ জন।
অধ্যক্ষ জানান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা থেকে শতভাগ পাস করলেও বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১২ জন অকৃতকার্য হয়েছে।
এই ৩ বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট এক হাজার ৬৫৯ জন। এর মধ্যে বিজ্ঞানে জিপিএ-৫ পেয়েছে এক হাজার ৬০৯ জন; মানবিকে ৬ জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৮৮ জন জিপিএ-৫ পেয়েছ।
গতবারের তুলনায় ফলাফল একটু ‘খারাপ’ হয়েছে জানিয়ে কেকা চৌধুরী বলেন, “এবারের রেজাল্ট ভালো হয়েছে। কিন্তু যদি গতবছরের সাথে তুলনা করি, একটু খারাপ তাহলে। এর কারণ হল, এই ব্যাচটা করোনার সময়ের ব্যাচ।
“ওদের নাইনে অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। আবার তখন বলা হল ৪ টা সাবজেক্টের ওপর পরীক্ষা নিতে। কিন্তু বোর্ড আবার সব সাবজেক্টের ওপর পরীক্ষা হয়েছে। এইসব বিভিন্ন কারণ ওরা সবমিলিয়ে ৬ থেকে ৭ মাস কম ক্লাস পেয়েছে।”
আগামীতে ভালো ফলের প্রত্যাশা রেখে বলেন, “সামনের বছর থেকে আর এই সমস্যাটা হবে না। কারণ করোনার ইফেক্টটা ওদের ওপর দিয়ে চলে গেছে। আর আমাদের শিক্ষকরা যেভাবে ট্রেনিং নিচ্ছে, মেয়েদেরকে পড়াচ্ছে, আমাদের স্কুলের রেজাল্ট সবসময় ভালো হবেই।”
আনন্দ উৎসবে ভিকারুননিসা মেতে থাকলেও এদিন কাছের সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ছিল ‘নীরব’।
সেখানে দেখা হল ‘এ প্লাস’ পাওয়া আফিফা আফরিনের সঙ্গে। বোনের সঙ্গে স্কুলে আসা আফরিন বললো, “আমার বাসা পাশেই। ভাবলাম স্কুলে এলে বন্ধুদের কাউকে না কাউকে পাব। কিন্তু এসে তো দেখছি কেউ নাই। সম্ভবত সমাবেশের জন্য।
“আর ওদেরকে যে কল করে ডাকব বা যোগাযোগ করব, সেটাও করতে পারছি না এখন। কারণ ইন্টারনেট কাজ করছে না। মোবাইলে কল দিলেও কল ড্রপ হয়ে যাচ্ছে বারবার। তাই বাসায় যাচ্ছি এখন।”
ফলাফলের দিন এমন ‘সুনশান’ দশার জন্য স্কুলের প্রহরী স্বপন চন্দ্র মিত্র রাজনৈতিক সমাবেশকে দায়ী করে বললেন, “সকাল থেকে ১৫-২০ জন আসছে। আসলে ওই সমাবেশের জন্য আসতে পারতেছে না কেউ। বা, বাবা-মায়েরাও মনে হয় সাহস পাইতেছে না।”
তবে উত্তরায়, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের পরিবেশ ছিল ভিকারুননিসার মতোই উৎসবমুখর। ফলাফল প্রকাশের পর এই স্কুলের মাঠেও ড্রাম বাজানোর দৃশ্য দেখা যায়। যে ড্রামের তালে নাচে-গানে আনন্দ ফলাফল উদযাপন করেছে শিক্ষার্থীরা।
বাসায় বসে ফলাফল পেয়েও বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে অভিভাবকদেরকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে এসেছেন এই কলেজের শিক্ষার্থী সারা মেহজাবীন, তাবসুনা আজিম ও অরনি সাহাসহ আরও অনেকে।
সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া এই স্কুলের শিক্ষার্থী অরণীর ভাষ্য, ভালো ফলাফলে তাদের অভিভাবকদের অবদান সবচেয়ে বেশি, তালিকায় এর পরে আছে শিক্ষকেরা।
তিনি বলেন, “আমাদের ভালো লাগছে, খুবই ভালো লাগছে। তবে আমাদের ভালো ফলাফলের জন্য আমাদের প্যারেন্টসের অবদান সবচেয়ে বেশি। আমাদের টিচারদের অবদানও অনেক, কারণ ওনারা আমাদেরকে এত ভালো্ভাবে পড়িয়েছেন!”
তাবসুনা আজিম বলে, “আমরা আরও বেশি খুশি এই কারণে যে আমরা ফ্রেন্ডরা একসাথে ভালো করছি। সেজন্য আজ সবাই এখানে একসাথে মজা করতে পারছি।”
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আরেক শিক্ষার্থী সিয়াম বলে, “এই রেজাল্টের জন্য অনেক কষ্ট করছি। বাসা থেকে অনেক বকাবকি, একটা ফ্রাস্ট্রেশনের মধ্যে ছিলাম। আর এখন গোল্ডেন এ প্লাস। ভালো লাগছে আমার।”
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের পাসের হার ‘শতভাগ’। কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম বাহাউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, তাদের ফলাফল ‘সবচেয়ে ভালো’।
“এ বছরের পরীক্ষা গত বছরের চাইতে ভিন্ন ছিল। কারণ এবার শিক্ষার্থীরা সব কয়টি বিষয়ের উপরই পরীক্ষা দিয়েছে। অর্থাৎ কোভিডের আগে যে রকম পরীক্ষা ছিল এবারও সেই রকম পরীক্ষা হয়েছে। সেই বিচারে আমাদের ফলাফল সবচেয়ে ভালো হয়েছে।”
শতভাগ পাসের পেছনের কথা তুলে ধরে এই অধ্যক্ষ বলেন, “এই ফলাফলের জন্য অনেকগুলো পক্ষেরই শক্তি কাজ করেছে। সকলের সমন্বয় ছিল বলে আমরা এবারও সেরা ফলাফল অর্জন করতে পেরেছি। এর মধ্যে আমাদের সুদক্ষ পরিচালনা পর্ষদ, দক্ষ এবং পরিশ্রমী শিক্ষক, দক্ষ প্রশাসন, অভিভাবৃন্দ ও শিক্ষার্থীরা। এদের প্রত্যেকের নিরলস পরিশ্রম ছিল। যেই পরিশ্রমের বিজয়ে প্রকাশ আজ আমরা করছি। এখন আমাদের শিক্ষার্থীদের এই ফলাফল ধরে রাখতে হবে। তবেই তারা সমানে আরো অনেক বড় অর্জন আমাদের উপহার হিসেবে দিতে পারবে।”
এ বছর রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে ৮৬৭ জন্য ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করেছে সবাই। তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৮২১ জন।