বাংলাদেশে ক্যান্সার, হৃদরোগ, দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগ মহামারি অনুপাতে বাড়লেও জীবনযাপন থেকে সৃষ্ট এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রস্তুতি নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
Published : 21 Oct 2019, 12:44 PM
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) রোববার অসংক্রামক রোগ (এনডিসি) নিয়ে রোববার এক সম্মেলনে তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
বিএসএমএমইউ, আইসিডিডিআরবি ও ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি গঠিত ‘ক্লিনিক্যাল রিসার্চ প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’ আয়োজিত সম্মেলন উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য সচিব মো. আসাদুল ইসলাম।
দেশের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য গবেষকদের জন্য শক্তিশালী প্লাটফর্ম গড়ে তোলার পাশাপাশি গবেষণা সহযোগিতা জোরদার করতেই এই সম্মেলনের আয়োজন।
২০১০ সালে বাংলাদেশে ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগে, যা ছয় বছরে এই বেড়ে ৬৬ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিইএইচও) তথ্য।
২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে ২৫ ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রতি চারজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে; প্রতি ১০ জনে একজন আক্রান্ত ডায়াবেটিসে।
সম্মেলন চলাকালে ডব্লিইএইচও বিশেষজ্ঞ ডা. মোস্তাফা জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “সমস্যা যে দিন দিন বাড়ছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যেই এটি মহামারির আকার নিয়েছে।”
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থ জীবনযাপনে সচেতন করার পাশাপাশি প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও চিকিৎসার মধ্যে দিয়ে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার ২০৩০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
লিখিত এক বক্তব্যে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, “১৯৯০ সালে প্রতি ১০টি মৃত্যুর সাতটিই ছিল সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে, প্রতি ১০টি মৃত্যুর সাতটিই ঘটছে এখন অসংক্রামক রোগে।”
সম্মেলনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই এ ধরণের রোগের দ্রুত বিস্তার ঘটছে; অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের তরুণরাই আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। এতে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিসহ জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলোও পড়ছে ঝুঁকির মুখে।
অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার মোকাবেলায় প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন ডব্লিউএইচও বিশেষজ্ঞ ডা. জামান।
তিনি বলেন, তামাক, জাংক ফুড ও কোমল পানীয়ের মতো ঝুঁকি সৃষ্টিকারী উপাদান নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
“আমরা ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি, অন্যদিকে জাপানের তামাক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনিয়োগের দরজাও খোলা রেখেছি। এখানে তাদের ঢুকতে দেওয়াটা ঠিক হবে না।”
জাংক ফুড ও কোমল পানীয়ের অবাধ বিজ্ঞাপন নিয়ে আপত্তি তুলে তিনি বলেন, “একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটারকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ওই সফট ড্রিংকসের কারণেই তিনি এ অবস্থানে এসেছেন- এগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট হলেও কেউ চ্যালেঞ্জ করছে না।”
দেশীয় আইন ও নীতিমালা দিয়ে এসব বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা ‘থামানো’ দরকার বলে মনে করেন তিনি।
“চিনির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অথচ সরকার সব সময়ই চিনির মূল্য কম রাখছে।”
ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে ‘চলমান যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে চিনিযুক্ত সব ধরনের কোমল পানীয়ের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে সিঙ্গাপুর।
বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জামান বলেন, “যদি অসংক্রামক রোগে দুই-তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়, তবে স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে বিনিয়োগও দুই-তৃতীয়াংশ করতে হবে।
“বাস্তবতা হল, এই খাতে বাজেট বরাদ্দ ৫ শতাংশেরও কম- এটা হিপোক্রেসি।”
ডায়বেটিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে জোরালো রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। বেশিরভাগ রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এজন্য জীবনযাপনের ধরণ বদলানোর পাশাপাশি পরিবেশ উন্নয়নে জোর দিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকায় মানুষ হাঁটবে কোথায়? কোনো উপায় আছে? একদম নেই।
“আমরা স্কুল-কলেজ খোলার অনুমোদন দিচ্ছি; কিন্তু শিক্ষার্থীরা খেলবে কোথায়? অনুমতি দেওয়ার আগে এটা কি আমরা আগে ভেবে দেখেছি?”
ফাস্ট ফুডের দোকানগুলো স্কুলের আশেপাশেই হচ্ছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন অধ্যাপক আজাদ।
তিনি বলেন, জনসমাগমস্থলে ধূমপান নিষিদ্ধ করা শুরুর দিকের দেশগুলোর বাংলাদেশ অন্যতম হলেও তার প্রয়োগ নেই। স্কুলগুলোর কাছাকাছি ফাস্ট ফুডের দোকান অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও বাংলাদেশে স্কুলগুলোই ফাস্ট ফুড দোকানের প্রধান লক্ষ্য।
অসংক্রামক রোগ ‘বিস্ফোরণের’ পর্যায়ে আছে উল্লেখ করে ‘দ্রুত কাজ করতে হবে’ বলে তাগিদ দেন আজাদ খান।
অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে কোনো রকম প্রস্তুতি সরকারের নেই বলে ২০১৭ সালের বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।