রুশ জাহাজ ভিড়তে না দেওয়ার কারণে ঢাকা-মস্কো সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলে বাংলাদেশ মনে করছে।
Published : 23 Feb 2023, 07:48 PM
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা রাশিয়ার ৬৯ জাহাজকে বাংলাদেশে ভিড়তে না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর মস্কোতে রাষ্ট্রদূত কামরুলকে তলবের ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বিষয় হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেছেন, “জাহাজ সম্পর্কিত এই সমস্যাটি কিন্তু তৈরি হয়েছিল আরও ৬ সপ্তাহ আগে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রদূতকে আলোচনার জন্য ডাকা হয়েছে কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে।
“সুতরাং আমরা মনে করি যে, আমাদের দুদেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।”
বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এ কথা বলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বাংলাদেশের পক্ষে রাশিয়ার ভূমিকার কথা তুলে ধরে সেহেলী সাবরীন বলেন, “আমরা কোভিড পরবর্তী সময়ে, এই রাশিয়া-ইউক্রেইনের যে অস্থিতিশীল অবস্থা, সেই সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা, তখনও আমাদের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপেও কিন্তু বাংলাদেশ-রাশিয়া একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
“এবং আমাদের বোঝাপড়াটা এতটা ভালো যে আমরা মনে করি না যে জাহাজের একটি বিষয় নিয়ে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সে ক্ষেত্রে কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে।”
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে আসা রুশ জাহাজ ‘উরসা মেজর’ অনুমতি না পাওয়ায় পণ্য খালাস না করেই ভারতীয় জলসীমা থেকে ফিরে যায় গত জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্যেই রাশিয়ার যেসব জাহাজ মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে, সেসব নৌযানের বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশে গত ১৬ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার।
ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গত মঙ্গলবার মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করা হয় বলে খবর দেয় দেশটির সংবাদসংস্থা তাস। তার দুদিন বাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্য এল।
রাষ্ট্রদূতকে তলবের বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “নিষেধাজ্ঞাভুক্ত রাশিয়ার ৭টি কোম্পানির ৬৯টি মাদার ভেসেলকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার সরকারি নির্দেশনার প্রেক্ষিতে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুদেনকো আন্দ্রে ইউরেভিচ গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান।
“এ সময় রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানান। এছাড়াও তিনি এ ঘটনায় রাশিয়ার উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পৌঁছে দেবার জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন।”
আলোচনাকালে রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসান করোনাভাইরাস মহামারী ও রাশিয়া-ইউক্রেইন বিরোধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার কথা তুলে ধরেছেন উল্লেখ করে সেহেলী সাবরীন বলেন, “পাশাপাশি তিনি রাশিয়ার ৬৯টি মাদার ভেসেলকে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার সরকারি নির্দেশনার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানও তুলে ধরেন।”
রাশিয়ার জাহাজে নিষেধাজ্ঞা: মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব
মস্কোতে রাষ্ট্রদূতকে তলব: প্রতিক্রিয়া জানাতে সময় নিচ্ছে ঢাকা
মস্কোতে ঢাকার শীর্ষ কূটনীতিককে ডাকার পর বুধবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, তলবের সময় কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, রাষ্ট্রদূতের কাছে তার বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। কী আলোচনা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করবে ঢাকা।
রাষ্ট্রদূতের প্রতিবেদন এসেছে কি না এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া কী- এমন প্রশ্নে মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেন, “ওই রিপোর্টে তিনি যা যা লিখেছেন, সেই সম্পর্কে আমাদের মন্ত্রণালয় এখন কাজ করছে এবং সে সম্পর্কে বিশ্লেষণও করা হচ্ছে এবং পরবর্তীতে আমরা কী পদক্ষেপ নিব বা কী করব, সেটা পরবর্তীতে আপনাদেরকে জানানো হবে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কি না- এ প্রশ্নে মুখপাত্র বলেন, “নৌ পরিহন মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৬ জানুয়ারি তারিখে একটি অফিস অর্ডার, যেটা আমাদের কাছেও আছে, ওখানে ৬৯টি হাহাজের উল্লেখ করা হয়েছে।
“সেক্ষেত্রে আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ওই চিঠিটা পেয়েছি… যেহেতু নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এটার লিস্ট সবাই জানে, নিষেধাজ্ঞা ৬৯টি জাহাজে দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা বা কিছু না, আমরা ১৬ জানুয়ারি নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে পেয়েছি যে, এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় থাকা রুশ জাহাজ বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ
রুশ জাহাজ ফিরিয়ে দেওয়া বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূলে হয়নি: মস্কো
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশ কেন মানছে- এ প্রশ্নে সেহেলী সাবরীন বলেন, “আপনারা জানেন, বাংলাদেশ হচ্ছে বাণিজ্যনির্ভর একটি দেশ। আমরা কিন্তু বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব দেশের সাথে সম্পর্ক বিদ্যমান রাখছি এবং আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের সবার সাথে একটি সুসম্পর্ক বজায় রেখে আমাদের জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য আমরা কাজ করছি।
“সেক্ষেত্রে আপনারা জানেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের বাণিজ্য অনেক বেশি, আমাদের ৮০% এক্সপোর্ট আছে।”
নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা উরসা মেজর জাহাজের মালামাল অন্য দেশেও খালাস করতে না পারার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “যে জাহাজটি থেকে মালামাল আসতে পারেনি, সেটি কিন্তু শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই না। আপনারা জেনে থাকবেন যে এটা বাংলাদেশের বন্দরে অবতরণ করতে না পেরে কিন্তু তাদের গতিপথ পরিবর্তন করে অন্য অনেক দেশে তারা অবতরণ করতে চেয়েছিল।
“সেক্ষেত্রেও কিন্তু উনারা পারেননি। কাজে এটা শুধু আমাদের ক্ষেত্রেই না যে, আমরা এই নিষেধাজ্ঞা কেন মানছি বা কেন করছি, অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও কিন্তু এক্ষেত্রে একটি নির্দেশনা বা একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।”
র্যাবের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে আগাম সতর্কতা হিসাবে ৬৯টি জাহাজের উপর নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপ কি না- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “আপনি খুবই একটা পলিসিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন, আমি আমার হায়ার অথরিটির সঙ্গে কথা বলে তারপর আপনাকে জানাতে পারব।”
উরসা মেজর জাহাজ থেকে মালামাল খালাস হওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, “এটা আমিও একটি পত্রিকার খবর পড়লাম যে, মালামালগুলো খালাস করা হয়েছে। এখন মালামাল খালাসের ব্যাপারটা যে মন্ত্রণালয় দেখে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তারা ভালো বলতে পারবে, কীভাবে মালামাল খালাস হয়েছে।
“আমরা আজকেই পেপারে দেখলাম। তো, আমরা ওই সম্পর্কে জানি, তারপর পরবর্তীতে আপনাদেরকে জানাতে পারব।”
মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে বলে মনে করেন কি না-এ প্রশ্নে মুখপাত্র সেহেলী বলেন, “আমরা যে পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করি, বঙ্গবন্ধু প্রণীত সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সাথে বৈরিতা নয়। আমরা বিশ্বাস করি যে, এক বন্ধু রাষ্ট্র আরেক বন্ধু রাষ্ট্রকে বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মতামত বা ভাব প্রকাশ করতে পারে।
“সেক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই আমাদের যে- জনগণের স্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ, সেটা বিবেচনায় রেখেই আমাদের পদক্ষেপগুলো নিই।”
জাতিসংঘে রাশিয়াবিরোধী ভোট, বাংলাদেশের অবস্থান কী
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার থেকে আরেকটি জরুরি বিশেষ অধিবেশনে বসেছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ।
ইউক্রেইন থেকে তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্তভাবে রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহার আহ্বান জানিয়ে অধিবেশনে একটি প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি হবে বৃহস্পতিবার।
ইউক্রেইন ও তার ৬০টির বেশি মিত্র দেশের উদ্যোগে উত্থাপিত এই প্রস্তাবে বাংলাদেশের ভোট কী হবে, জানত চাওয়া হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে।
জবাবে সেহেলী বলেন, “আমরা কেবল আন্তর্জাতিক হিউম্যানিটারিয়ান আইনের ব্যত্যয় না ঘটলে, সেখানে কোনো রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো কিছু করা হলে- আমরা সাধারণত সেখানে অংশ নিই না।
“এবং কান্ট্রি স্পেসিফিক রেজুল্যুশন যখন নেওয়া হয়, সেসব ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত বিরত থাকি আমরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী (এ কে আব্দুল মোমেন) নিউ ইয়র্কে আছেন। তিনি সেখানে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং অন্যান্য যে দেশগুলো আছে, তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশা রাখছি।”
বাংলাদেশকে মাঝে রেখে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি চলছেই