যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন বাতিলের আদেশ নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচলে অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় থাকা হাজারো ভারতীয় অভিবাসী বাবা-মা।
Published : 11 Feb 2025, 08:46 PM
ভারতীয় দম্পতি নেহা সাতপুতে ও অক্ষয় পাইস এইচ-১বি দক্ষ কর্মী ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৌশলী হিসাবে কাজ করেন। তারা তাদের প্রথম সন্তান জন্মের অপেক্ষায় আছেন।
তাদের আশা ছিল, তাদের অনাগত সন্তান আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়ার পরই জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন বাতিলের নির্বাহী আদেশ তাদের স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
ট্রাম্পের আদেশ অনুযায়ী, অস্থায়ী ভিসায় থাকা বিদেশি কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া সন্তানরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব পাবেন না।
এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় অভিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যদিও ট্রাম্পের আদেশ কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্ম নিলেই সেদেশের নাগরিক হওয়ার নিয়ম বহাল থাকবে।
ট্রাম্পের আদেশটি আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারিতে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে সেটি আপাতত থমকে আছে। আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আদেশটি কার্যকর হতে পারবে না। তবে উচ্চ আদালতে এমন যে কোনও আদেশের ওপর থাকা স্থগিতাদেশ খারিজও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
এই আইনি মারপ্যাচে ট্রাম্পের আদেশটি কার্যকর হওয়া না হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার দোলাচলে পড়েছেন নেহা-অক্ষয় দম্পতির মতো অনাগত সন্তানের অপেক্ষায় থাকা আরও হাজার হাজার ভারতীয় অভিবাসী বাবা-মা।
অক্ষয় বলেন, “আমাদের ওপর এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। যদি আদেশটি কার্যকর হয়, আমরা জানি না তারপর কী হবে। এটি অচেনা ভূখন্ড।” এই দম্পতির সবচেয়ে বড় প্রশ্ন: তাদের সন্তান কোন দেশের নাগরিকত্ব পাবে?
“তাদের এই উদ্বেগ যথার্থ”, বলেছেন, নিউ-ইয়র্কের অভিবাসন বিষয়ক অ্যাটর্নি সাইরাস মেথা। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনানুযায়ী, সেদেশে জন্মগ্রহণকারী কাউকে অনভিবাসীর (নন-ইমিগ্র্যান্ট) মর্যাদা দেওয়ার কোনও বিধান নেই।
অক্ষয়-নেহা দম্পতির সন্তান জন্মের সময় দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকায় তারা আগেভাগেই সন্তান জন্ম দেওয়া নিয়ে তাদের চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছিল, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৪০ তম সপ্তাহে সন্তানের জন্ম দেওয়া যেতে পারে।
তবে এই দম্পতি অপেক্ষা করার পথই বেছে নিয়েছেন। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তানের নিরাপদ জন্মই চান তারা। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বহু পরিবারই সিজারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম আগেভাগেই দিতে চাইছেন এমন খবর এসেছে গণমাধ্যমে।
চিকিৎসকরা অবশ্য এ বিষয়ে নিরুৎসাহিতই করছেন। ওহাইওয় ‘আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ানস অব ইন্ডিয়ান অরিজিন’ (এএপিআই)-এর সভাপতি ডাঃ সাতীশ কাতুলা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা আইন খুব কঠোর। কেবলমাত্র সন্তানের নাগরিকত্বের জন্য সময়ের আগেই অস্ত্রোপচার করা উচিত নয়। আমাদের চিকিৎসকরা নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ। তারা প্রয়োজন ছাড়া সিজার করবেন না।”
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়া খুবই কাঙ্খিত একটি বিষয়। বিশেষ করে যারা এইচ-১বি দক্ষকর্মী ভিসাধারী তাদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়রা দ্বিতীয় বৃহত্তম অভিবাসী গোষ্ঠী।
অভিবাসন নীতি বিশ্লেষক স্নেহা পুরি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ট্রাম্পের জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব আইন আদেশে ভারতীয়রা অনেক বেশি বিপাকে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ লাখের বেশি ভারতীয় অনভিবাসী ভিসায় আছে।
“ট্রাম্পের আদেশ কার্যকর হলে তাদের অনাগত সন্তানরা কেউই আর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে না”, বিবিসি-কে বলেন পুরি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সন্তান জন্মের অপেক্ষায় থাকা অসংখ্য বাবা-মা ট্রাম্পের আদেশের প্রভাব কি হতে পারে এবং এরপর কী হতে চলেছে তা নিয়ে অনলাইনে উদ্বেগ জানাচ্ছেন।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে আইনসম্মতভাবে বাস করা স্থায়ী অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে না।
তবে মার্কিন অভিবাসন ব্যবস্থায় স্থায়ী অভিবাসনের জন্য ভারতের নাগরিকদের গ্রিন কার্ড পাওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদি। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, কোনও একটি দেশের মানুষকে দেওয়া গ্রিন কার্ডের সংখ্যা মোট গ্রিন কার্ডের সংখ্যার ৭ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
ভারতীয়রা প্রতি বছর ৭২ শতাংশ এইচ-১বি ভিসা পেয়ে থাকেন। কেটো ইনস্টিটিউট’ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে, গ্রিন কার্ডের জন্য অপেক্ষমাণ ৬২ শতাংশই ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। যারা কর্মসংস্থান-ভিত্তিক গ্রিন কার্ড পাচ্ছেন, তাদের আবেদন ২০১২ সালে করা হয়েছিল। নতুন যারা আবেদন করবেন তাদের সারা জীবনই অপেক্ষায় থাকতে হবে। ৪ লাখ ভারতীয় হয়ত গ্রিনকার্ড পাওয়ার আগেই মারা যাবেন।
গ্রিন কার্ড নিয়ে এই অচলবস্থার পাশাপাশি ট্রাম্পের আদেশে ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রী এবং কাজের ভিসা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাদের উদ্বেগে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তারা এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ঝুঁকিপূর্ণ বৈধ অবস্থান নিয়ে উদ্বেগে আছেন। তার ওপর এখন তাদের যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া সন্তানের নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সন্তানসম্ভবা নেহা বলেন, “সন্তানের জন্মের সময় এগিয়ে আসতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকত্ব নিয়ে অনিশ্চয়তা নতুন উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” ওদিকে, তার স্বামী অক্ষয় বলেন, “আমাদের বৈধতা আছে, আমরা কর দেওয়া অভিবাসী। আমাদের সন্তান এদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার রাখে। এটাই তো আইন, নয় কী?”