রাজার অভিষেকের ব্যয় নিয়ে যুক্তরাজ্যেই প্রশ্ন

অভিষেকের আয়োজনকে অনেকেই মনে করছেন জনগণের করের অর্থের ‘বাজে অপচয়’।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2023, 07:22 PM
Updated : 7 May 2023, 07:22 PM

“চার্লস তো রাজা হয়েই ছিলেন, তাহলে এমন তামাশা করে এত অর্থ খরচের মানেটা কী?” প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ‘রিপাবলিক’ গ্রুপের প্রধান নির্বাহী গ্রাহাম স্মিথ, যে দলটি রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করে রাজপথে বিক্ষোভে নেমেছিলেন।

নিজেদের সে অবস্থান নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে স্মিথ ব্রিটিশ দৈনিক ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, “অর্থহীন এই আয়োজনের পেছনে কোটি কোটি পাউন্ড খরচ করা, আদতে লাখ লাখ যুক্তরাজ্যবাসীর মুখে চপেটাঘাতের মতো, যারা এখন জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন।”

যুক্তরাজ্যের রাজা হিসেবে শনিবার আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয় রাজা তৃতীয় চার্লসের। শপথ নিয়ে মাথায় রাজমুকুট তোলেন বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন রাজ পরিবারের এই সদস্য।

গত বছর সেপ্টেম্বরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে চার্লস উত্তরাধিকার হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজা হিসেবে পরিচিত হন। তবে রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা সে সময় হয়নি।

কয়েক মাসের বিস্তারিত প্রস্তুতি শেষে এখন ব্রিটেনের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হলেন তিনি। যে অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা অংশ নেন। অভিষেক অনুষ্ঠান ঘিরে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে কয়েক হাজার অতিথির পাশাপাশি আশপাশে সেন্ট্রাল লন্ডনের রাস্তাগুলোতে ছিল উচ্ছ্বসিত মানুষের ভিড়।

আধুনিক ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে রাজার ক্ষমতা অনেকটা নামকাওয়াস্তে হলে রাজপরিবারকে এখনও শ্রদ্ধার আসনে রাখেন যুক্তরাজ্যের অনেকে।

তবে সাম্প্রতিক জরিপগুলোতে দেখা যায়, রাজ পরিবার নিয়ে প্রবীণদের মতো মাতামাতিতে নবীনদের অতটা আগ্রহ নেই।

তারপরও রাজা চার্লসের এই জমকালো অভিষেক অনুষ্ঠান নিয়ে শুধু ব্রিটেন কিংবা যুক্তরাজ্যেই নয়, বিশ্বজুড়ে ছিল মানুষের আগ্রহ।

খরচ হল কত?

রাজা চার্লসের সিংহাসন আরোহনসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর এবার হিসাবের খাতা মেলানোর পালা। কিন্তু তা হওয়ার নয়।

বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট - খরচের হিসাব নিয়ে কেউই মুখ খুলতে রাজি না, জানিয়েছে ইনডিপেন্ডেন্ট।

তবে সংবাদ মাধ্যম অবশ্য তাতে দমবার পাত্র না। নানা সূত্র থেকে খরচের হিসাব বের করতে শুরু করেছে।

যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম বিবিসির বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসি বলছে, ৭০ বছর পর এবারের রাজ্যাভিষেকে যুক্তরাজ্যের করদাতাদের দেওয়া করের ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন বা ৫ থেকে ১০ কোটি পাউন্ড (৬ কোটি ৩০ লাখ থেকে সাড়ে ১২ কোটি ডলার) খরচ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মুদ্রায় রূপান্তর করলে এই অর্ধের অঙ্ক দাঁড়ায় ৬৩০ কোটি থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

রাজ্যাভিষেকের এই আনুষ্ঠানিকতার পেছনে একই ধরনের খরচের হিসাব দিয়েছে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র ইনডিপেন্ডেন্টও।

যদিও বলা হচ্ছে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেকের তুলনায় তার ছেলে রাজা চার্লসের রাজ্যাভিষেকের জাঁকজমকে যথেষ্ট লাগাম দেওয়া হয়।

সিএনবিসি লিখেছে, রাজা তৃতীয় চার্লস নিজেই নাকি রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠান সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন, যাতে তা ব্যয় সাশ্রয়ী হয়।

দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, ১৯৫৩ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেকের অনুষ্ঠানের জন্য ৯ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড খরচ করা হয়েছিল, যা ২০২৩ সালের হিসাবে ২ কোটি ৫ লাখ পাউন্ড। চার্লসের নানা রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেকে ১৯৩৭ সালে খরচ করা হয়েছিল ৪ কোটি ৫৪ হাজার পাউন্ড, যা বর্তমান বাজারের হিসাবে ২ কোটি ৪৮ লাখ পাউন্ডের সমান।

বলা হয়ে থাকে, রাজা ষষ্ঠ জর্জের রাজ্যাভিষেক গত ৩০০ বছরের মধ্যে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল। তারপরও এবারের রাজ্যাভিষেকের খরচের তুলনায় সম্ভবত তা পিছিয়েই থাকবে।

এই অর্থ এল কোথা থেকে?

বেশিরভাগ পাবলিক অনুষ্ঠানের মতো রাজ্যাভিষেকের এই অনুষ্ঠানের তহবিলও যুক্তরাজ্যের সরকারি কোষাগার থেকেই জোগান দেওয়া হয়। অর্থাৎ আদতে, যা আসলে ব্রিটিশ করদাতাদের অর্থ।

অবশ্য রাজ্যাভিষেকের এই অনুষ্ঠানের ব্যয়ের একটি অংশ বাকিংহাম রাজপ্রাসাদের নিজস্ব কোষাগার থেকেও জোগান দেওয়া হয়।

তবে ওই অর্থের পরিমাণ জানাতে পারেনি সিএনবিসি কিংবা ইনডিপেন্ডেন্ট। কারণ রাজপ্রাসাদ থেকে খরচের বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজা চার্লস বিপুল সম্পদের অধিকারী। তার সম্পদের অর্থ মূল্য পৌনে ২০০ কোটি পাউন্ডের বেশি বলে ধারণা করা হয়। আর এই সম্পদের জন্য রাজাকে কোনো কর দিতে হয় না। ফলে কর না দেওয়া ধনকুবেরের পেছনে করদাতাদের অর্থ ব্যয় নিয়ে ক্ষোভ উঠেছে।

যুক্তরাজ্যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির মধ্যে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে চলার এক পটভূমিতে এই ব্যয়বহুল রাজ্যাভিষেক নিয়ে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের বড় অংশই সন্তুষ্ট নয়।

বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে চিকিৎসক, শিক্ষক ও অন্যান্য সরকারি কর্মীদের ধর্মঘট ও আন্দোলন চলার মধ্যেই এই অভিষেকের আয়োজন চলে।

চার্লসের রাজ্যাভিষেক নিয়ে জরিপ প্রতিষ্ঠান ইউগভ’র সাম্প্রতিক এক জরিপের ফল বলছে, যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের ৫১ শতাংশই মনে করেন রাজ্যাভিষেকের খরচ সরকারি তহবিল থেকে না হওয়াই উচিৎ। আর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন, সরকারের উচিৎ এই তহবিল জোগান দেওয়া। ১৮ শতাংশ উত্তরদাতা অবশ্য সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন।

Also Read: শপথ নিয়ে রাজমুকুট পরলেন চার্লস

Also Read: ক্যামিলা এখন রানি

Also Read: রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক: যা কিছু জানার আছে

Also Read: ১৫ দেশের রাজা তৃতীয় চার্লস, কিন্তু কত দিন

এছাড়া এই রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে ৮ মে সোমবার যে বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়, তাতে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে আরও প্রায় ১৩৬ কোটি ডলারের সমপরিমাণ উৎপাদনশীলতার লোকসান হবে বলে হিসাব দিয়েছে সিএনবিসি।

ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, রাজ্যাভিষেকের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কোটি কোটি পাউন্ডের ব্যবসা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে মহামারীতে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত খুচরা ব্যবসা, পর্যটন ও হোটেল খাতে ব্যবসা বাড়বে।

একটি হিসাবের বরাতে সিএনবিসি বলছে, সাধারণত এ ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে খুচরা ব্যবসা খাতে দৈনিক ১৫ শতাংশ ব্যবসা বাড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের হসপিটালিটি খাতের ব্যবসায়িক সংগঠন ইউকে হসপিটালিটি জানিয়েছে, রাজার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানের ফলে ৩৫ কোটি পাউন্ডের মতো ব্যবসা আসতে পারে তাদের খাতে।

কেন ক্ষোভ?

বর্তমানে যুক্তরাজ্যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ২০১৯ সালের শেষাংশের সীমার তুলনায় দশমিক ৬ শতাংশ নিচে আছে এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাত অর্থনীতির দেশের জোট জি-৭ এর সদস্যদের মধ্যে একমাত্র যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিই কোভিড মহামারীর পর এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।

এছাড়া ইউক্রেইনে যুদ্ধ চলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ আরোপ এবং ইউক্রেইনের যুদ্ধের খরচ চালাতে গিয়ে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি চাপে পড়েছে, যার কারণে সেদেশে সার্বিক বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার মার্চে বেড়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছায়।

গত ৪৫ বছরের ইতিহাসে এই সময়েই যুক্তরাজ্যে খাদ্য ও পানীয়ের দাম সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে। তার মধ্যেই অভিষেকে বিপুল অর্থ খরচ দেখে বিরক্ত ব্রিটিশদের অনেকে।

রাজ্যাভিষেকে করদাতাদের অর্থ খরচে নারাজ ব্রিটেনের রাজতন্ত্রবিরোধীরা। এদের একটি দল রিপাবলিক যেমন বিক্ষোভ দেখিয়েছে অভিষেকের দিন, তাদের সমর্থন করছেন অনেকে।

যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র গার্ডিয়ানের গবেষণা বলছে, রাজা তৃতীয় চার্লসের ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ১৮০ কোটি পাউন্ড, অর্থাৎ তিনি একজন ‘বিলিওনেয়ার’।

এই প্রেক্ষাপটে লিডস ইস্টের লেবার এমপি রিচার্ড বারগন হাউজ অব কমন্সে রাজ্যাভিষেকে সরকারি কোষাগারের অর্থ খরচ করা নিয়ে একটি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন।

রিচার্ড বারগন দ্য ইনডিপেন্ডেন্টকে বলেন, “বিভিন্ন সূত্রের হিসাবে রাজার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন পাউন্ড, এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া উৎস থেকে এই অর্থ আয় হয় বলে তিনি কর দেওয়া থেকেও ছাড় পেয়ে যান। সুতরাং, এটা সহজেই অনুমেয় কেন নাগরিকদের একটি বড় অংশ এই রাজ্যাভিষেকের খরচ নিয়ে খুশি নন।”

চ্যান্সেলর অব দ্য ডাচি অব ল্যানচেস্টার (রাজা খাজাঞ্চি) অলিভার ডাওডেন জানিয়েছেন, সরকার এবং রাজার এটা বিবেচনায় আছে যে করদাতাদের অর্থের যাতে সঠিক ব্যবহার হয় এবং অযাচিত বা বিলাসবহুল খরচ যাতে এড়ানো যায়।

তবে তাতেও সন্তষ্ট নন বারগনের মতো আরেক এমপি রনি ক্রাউন। স্কটল্যান্ডের স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির এই নেতা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ার দিকটি তুলে ধরে বলেন, “আমার আসনে প্রতি চারজনের একজন, যাদের মধ্যে শিশুরাও আছে, দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। মানুষ লোনা ধরা বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে, তারা বিদ্যুৎ বিল দিতে করতে পারছে না। কোভিড আর ব্রেক্সিটের ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না।”

তবে এর জবাবে হার্টসমেয়ারের এমপি অলিভার ডাওডেন বলেন, সরকার সবসময়ই রাজ্যাভিষেকের খরচ বহন করে আসছে এবং রাজ্যাভিষেক যাতে যথাযথভাবে হয় তা নিশ্চিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি দাবি করেন, “আমার আসনের চিত্রটি হয়ত আপনার (রনি ক্রাউন) আসনের চেয়ে ভিন্ন। মানুষ আশা করে যে রাজা অভিষেকটি যাতে যথাযথভাবে অনুষ্ঠিত হয়।”

তবে তারপরও রাজতন্ত্রবিরোধী রিপাবলিক গ্রুপের বক্তব্য হচ্ছে- এটা অর্থের ‘নির্লজ্জ অপচয়’।