কমনওয়েলথের এর বেশিরভাগ দেশেই এখন প্রজাতন্ত্রের পথে হাঁটা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক মূর্তমান হয়ে উঠেছে।
Published : 05 May 2023, 04:59 PM
যুক্তরাজ্যের রাজা হিসেবে তৃতীয় চার্লসের অভিষেক হতে চলেছে লন্ডনে ৬ মে। এর মধ্য দিয়ে প্রয়াত মা দ্বিতীয় এলিজাবেথের উত্তরসূরি হিসেবে ব্রিটিশ সিংহাসনে বসার পর চার্লস কেবল যুক্তরাজ্যই নয়, বরং আনুষ্ঠানিকভাবে কমনওয়েলথভুক্ত আরও ১৪টি দেশের রাজা হবেন।
এই দেশগুলো হচ্ছে- অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাহামাস, বেলিজ, কানাডা, গ্রেনাডা, জ্যামাইকা, নিউজিল্যান্ড, পাপুয়া নিউগিনি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাদাইনস, টুভালু।
কিন্তু কত দিন চার্লস এসব দেশের রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান থাকতে পারবেন সেটি একটি প্রশ্ন। কারণ কমনওয়েলথের এর বেশিরভাগ দেশেই এখন প্রজাতন্ত্রের পথে হাঁটা উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক মূর্তমান হয়ে উঠেছে। যদিও দেশভেদে এর তারতম্য আছে।
চার্লস এখনও যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সেগুলোর কিছু দেশের আবহ বর্ণনা করে সেসব দেশে যে কোনও সময় রাজতন্ত্রকে বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখেছে বিবিসি।
কিটস অ্যান্ড নেভিস:
আটলান্টিক মহাসাগর ও ক্যারিবীয় সাগরের মাঝের দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস। এই ক্যারিবীয় অঞ্চলেই প্রথম ব্রিটিশ উপনিবেশের গোড়া পত্তন হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরও বিতর্ক রয়ে গেছে, দেশটি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ব্রিটিশ রাজার অধীনতা থেকে বেরিয়ে প্রজাতন্ত্রের পথে হাঁটবে কিনা।
দেশটিতে বেশিরভাগ মানুষই তাদের অভিমত প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়। তবে যারা মত প্রকাশ করে তারাও দ্বিধান্বিত।
শার্লিন মার্টিন নামের এক অধিবাসী বলেন, তিনি আরও তথ্য জানতে চান। তবে রাজা তৃতীয় চার্লসের এই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থাকার সুবিধাটা কি সেটি তার প্রশ্ন। এই নারীর কথায়, “ইংল্যান্ডের চেয়ে চীনা এবং তাওয়ানিরা আমাদেরকে বেশি দেখাশুনা করে। কাজেই রাজা থাকার দরকার কি আমি জানি না।”
আরেক অধিবাসী একটি পানশালার ম্যানেজার জুলিয়ান মরটন বলেন, “প্রজাতন্ত্র হওয়া ভাল। এতে বিশ্ববাসী বুঝতে পারবে, আমরা আমাদের নিজেদের বিষয়গুলো নিজেরাই সামলাতে পারি।”
জুলিয়ানের বন্ধু ক্রিস্টোফার রবার্টসও এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তবে তার কথায়, করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠার এই সময়ে প্রজাতন্ত্রের পথে হাঁটা জরুরি কোনও অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। বিষয়টি নিয়ে লোকজনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। পথে-ঘাটে কথাবার্তা হচ্ছে। সুতরাং, পরিবর্তন আনতে কিছু সময় নেওয়াই যেতে পারে।
বারবাডোসকে একসময় বলা হত ‘লিটল ইংল্যান্ড’। কিন্তু বারবাডোস ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে প্রজাতন্ত্র হয়ে যায় ২০২১ সালে। তৎকালীন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে আনুষ্ঠানিক সরকার প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে প্রজাতন্ত্রের ঘোষণা দিয়েছিল দেশটি।
এরপর থেকে অন্য দেশগুলোও বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখতে শুরু করে। তবে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে ব্রিটিশ রাজাকে সরাতে হলে দ্বীপদেশ কিটস অ্যান্ড নেভিসসহ সব ক্যারিবীয় দেশেই গণভোট আয়োজন করতে হবে।
কেবল বেলিজই কোনও গণভোট ছাড়া পার্লামেন্টের মাধ্যমে চাইলে এ উদ্যোগ নিতে পারে। গণভোটে কেমন ভোট পড়লে প্রস্তাব পাস হবে সে নিয়ম একেক দেশে একেকরকম।
যেমন: সেন্ট লুসিয়া, বাহামাস, জ্যামাইকা, সেন্ট কিটস এবং নেভিসে গণভোটে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটেই প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু- অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, গ্রেনাডা, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাদাইনসে বিষয়টি এত সহজ নয়। কারণ, এসব দেশে গণভোটে প্রস্তাব পাস হতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন পড়বে।
এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সবসময় সহজ হয় না। ২০০৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাদাইনসে এমন একটি গণভোট আয়োজন করা হয়েছিল। সেই গণভোটে ৪৫ শতাংশ ভোটার তৎকালীন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তাদের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দেখতে চাননি- এ ভোটের ফল ছিল প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনেক কম।
তাই প্রজাতন্ত্রের পথে হাঁটার প্রশ্নটি দৃশ্যত একটি সহজ বিষয় বলে মনে হলেও ক্যারিবীয় দেশগুলোর নিজ নিজ এমন সব ব্যবস্থার কারণে বিষয়টি আসলে তত সহজ নয়।
অস্ট্রেলিয়া:
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সড়কে হাঁটলে সেখানে চার্লসের রাজ্যাভিষেকের কোনও আমেজ চোখে পড়বে না। অনেকে আবার জানেই না রাজ্যাভিষেকটা কী। চার্লসের অভিষেক নিয়ে ৭৩ বছর বয়সী গ্রাহাম বলেন, “আমি এ নিয়ে চিন্তাও করি না, এটি অপ্রাসঙ্গিক।”
দেশটিতে রাজা চার্লস তার মা প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো অতটা জনপ্রিয় নন। আর চার্লসের অভিষেক এমন একটি সময়ে হচ্ছে যখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলন কয়েক দশকের মধ্যে তুঙ্গে রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ আগেই বলেছিলেন, রাজতন্ত্র থেকে একদিন বেরিয়ে আসবে অস্ট্রেলিয়া। এটি অনিবার্যভাবেই হবে।
এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো দেশটিতে একজন কনিষ্ঠ মন্ত্রীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিউজিলান্ডেও চিত্রটি একইরকম।নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস হিপকিনস মনে করেন, একদিন তার দেশও রাজতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসবে।
রাজতন্ত্র অস্ট্রেলিয়ায় পুরোপুরিই এক প্রতীকী বিষয়। তাছাড়া, দেশটি যুক্তরাজ্যের ছায়ার বাইরে দীর্ঘদিন থেকেই নিজস্ব পরিচয় গড়ে তুলেছে। অনেকে আবার অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী এবং টরেস স্ট্রেইট আইল্যান্ডের মানুষের ওপর ঔপনিবেশিকতার স্থায়ী প্রভাবকে রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাওয়ার একটি কারণ বলে উল্লেখ করছেন।
১৭ বছর বয়সী এক অধিবাসী এসটেল পিটারসন বলেন, “আমার এখন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে এখন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উপনিবেশ-বিরোধী।” “এখানে একজন ইংরেজ রাজা থাকা কেবলই বেমানান”, বলেন পিটারসনের বন্ধু মনিকা।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার প্রজাতন্ত্র হওয়া এখনও অনেক দূরের পথ। কারণ, দেশটির সরকার সংবিধানে আদিবাসী জনগণকে ঠাঁই দিতে এই প্রথম গণভোট করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
তাছাড়া, অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের ভোটে নির্বাচন করা হবে নাকি পার্লামেন্টের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হবে তা নিয়ে দেশটির নাগরিকদের মধ্যে এখনও বিভক্তি আছে। আর আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সাম্প্রতিক কয়েকটি জনমত জরিপে প্রজাতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন এখনও অনেক কম দেখা গেছে।
কানাডা:
কানাডাতেও রাজা চার্লস তার মা প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মতো অতটা জনপ্রিয় নন। বিভিন্ন জনমত জরিপেও দেখা গেছে দেশটিতে রাজতন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য মানুষের আগ্রহ দিন দিনই বাড়ছে।
এপ্রিলে অ্যাঙ্গুস রেইড এর সর্বসাম্প্রতিক একটি জরিপের প্রকাশিত ফলে দেখা গেছে, বেশির ভাগ কানাডীয়- অর্ধেকের কিছু বেশি- চায় না অস্ট্রেলিয়া প্রজন্মর পর প্রজন্ম ধরে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র চালু রাখুক।
জরিপে অংশ নেওয়া প্রতি ৫ জনে দুইজনই বলেছেন, চার্লসের রাজ্যাভিষেক নিয়ে তাদের কোনও মাথাব্যাথ নেই।
চার্লস গতবছর যুক্তরাজ্যের রাজা হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ায় রাজতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা নিয়ে বিতর্কই কেবল আরও বেড়েছে।