রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন লন্ডনে রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে।
Published : 06 May 2023, 05:51 PM
ধর্মীয় আচার এবং ব্রিটিশ কেতা মেনে শনিবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে অভ্যাগত ও রাজপারিষদদের সামনে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের মাথায় উঠেছে রাজমুকুট।
এক হাজার বছর ধরে ব্রিটেনে রাজ্যাভিষেকের জাঁকজমকপূর্ণ এই অনুষ্ঠান আয়োজন হয়ে আসছে এবং গত সাত দশকের মধ্যে একজন ব্রিটিশের জীবনে এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান।
জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্রিটেনের রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী হিসেবে কাটিয়ে দিয়েছেন চার্লস। রাজমুকুটের জন্য তিনি দীর্ঘ ৭০ বছর অপেক্ষা করেছেন। এতটা দীর্ঘসময় আর কোনো যুবরাজকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ৭৪ বছর বয়সের চার্লসই ব্রিটিশ সিংহাসনে বসা সবচেয়ে বয়স্ক রাজা।
গত সেপ্টেম্বরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা যাওয়ার পর রাজা হন তার বড় ছেলে চার্লস।
বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০০ জন নেতা রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানে সরাসরি যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ লন্ডনে বসে এবং বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ টেলিভিশনে সরাসরি অভিষেক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে অভিষেক অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে অ্যাংলিকান গির্জার ধর্মীয় নেতা ক্যান্টাবুরির আর্চবিশপ রাজা চার্লসের মাথায় ৩৬০ বছরের পুরাতন ‘সেন্ট এডওয়ার্ডস ক্রাউন’ পরিয়ে দেন। চার্লস সেসময় চতুর্দশ শতাব্দীর রাজসিংহাসনে বসে ছিলেন।
সেই ১০৬৬ সালে রাজা চার্লসের প্রথম পূর্বসূরি উইলিয়াম দ্য কনকরার সময় থেকে ঐতিহাসিক এবং গৌরবময় এ ঘটনাটি ঘটে চলেছে।
রাজা চার্লসকে রাজমুকুট পরানোর পর তার স্ত্রী কুইন অব কনসর্ট ক্যামিলাকে মুকুট পরানো হয়। ক্যামিলা রাজা চার্লসের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার সঙ্গে চার্লসের বিচ্ছেদ হয় এবং সেই ঘরের দুই সন্তান প্রিন্স অব ওয়েলস উইলিয়াম এবং ডিউক অব সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি। প্রিন্স উইলিয়াম ব্রিটিশ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়া এবং একইসময়ে পরপর কোভিড-১৯ মহামারী ও ইউক্রেইন যুদ্ধের কারনে পুরো বিশ্বের মত যুক্তরাজ্যকেও একেবারে নতুন এক ধরণের বিরূপ বৈশ্বিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আস্থাহীনতার কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে সেখান থেকেও বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হচ্ছে দেশটিকে।
???????????? ???????????????????????????????? ???????? ???????????? ????????????????
— The Royal Family (@RoyalFamily) May 6, 2023
The Archbishop of Canterbury places St Edward’s Crown on The King’s anointed head. The clergy, congregation and choir all cry ‘God Save The King’.#Coronation pic.twitter.com/kGrV3W0bky
এই পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দিন ধরেই বলি বলি করেও অস্পষ্ট হয়ে থাকা একটি দাবি এখন বেশ স্পষ্ট হয়েই ধরা দিচ্ছে। অনেকেই দাবি তুলছেন, রাজতন্ত্র আর কত দিন। তারা এখন যুক্তরাজ্যে প্রজাতন্ত্র চান।
শনিবার রাজা চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানের দিনও প্রজাতন্ত্রের দাবিতে লন্ডনে বিক্ষোভ হয়েছে। লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তারও করেছেন।
রাজতন্ত্রবিরোধী এসব ব্যক্তিরা ‘নট মাই কিং’ প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামেন, সেগুলো জব্দ করে নিয়ে যায় পুলিশ।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ‘নট মাই কিং’ লেখা হলুদ টিশার্ট পরে সমর্থকেরা বিক্ষোভে নামেন। সেইসঙ্গে ওই লেখাযুক্ত হলুদ প্ল্যাকার্ড পুলিশ কর্মকর্তারা জব্দ করে নিয়ে যান।
অন্যদিকে, রাজতন্ত্রের পক্ষের লোকজন বলছেন, ব্রিটিশ রাজপরিবার সবসময়ই আন্তর্জাতিক মনযোগের কেন্দ্রে থেকেছে, যা যুক্তরাজ্যের কূটনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং বিশ্বমঞ্চে থাকার উপায়।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এ বিষয়ে বলেন, ‘‘এই শোভাযাত্রা, এই সাড়ম্বর দৃশ্য, জমকালো সব অনুষ্ঠান এবং রাস্তার পার্টি- আর কোন দেশ এমন জমকালো আয়োজন প্রদর্শন করতে পারে না।”
প্রধানমন্ত্রী সুনাক তার দেশে রাজ্যাভিষেক নিয়ে যতই গর্ব করুন না কেনো, এবার কিন্তু অভিষেক অনুষ্ঠানের জাঁকজমকতায় খানিকটা লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। তার একটা কারণ হয়তো দেশ ও বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি, আর কিছুটা হয়তো স্বয়ং রাজা চার্লসের ইচ্ছায়।
১৯৫৩ সালে চার্লসের মা প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠান আরো অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ ছিল।
যুবরাজ থাকার সময় একজন সক্রিয় পরিবেশবাদী হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন চার্লস। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে পরিবেশ রক্ষায় তিনি বরাবর সরব থেকেছেন। যদিও রাজা হওয়ার পর তিনি চুপ মেরে গেছেন। হয়তো রাজা হিসেবে নানা নিয়মের বেড়াজালে আটকে গেছেন তিনি। তবে তার ইচ্ছাতেই অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজনে কোনো আতশবাজির খেলা নেই।
যেভাবে হলো অভিষেক অনুষ্ঠান
শনিবার সকালে রাজা এবং রানি কালো রঙের ডায়মন্ড স্টেট জুবিলি কোচে করে বাকিংহাম প্যালেস থেকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রওয়ানা করেন। তাদের সঙ্গে ছিল চকচকে ব্রেস্টপ্লেট ও প্লামড হেলমেট পরা অশ্বারোহী বাহিনী।
উজ্জ্বল লাল রঙের ইউনিফর্ম এবং কালো বেয়ারস্কিন টুপি পরা কয়েকশ সেনা দ্য গ্র্যান্ড বুলেভার্ড থেকে বাকিংহাম প্যালেসের পথে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এদিন হাজার হাজার মানুষ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভিড় জমিয়ে ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছেন।
অনুষ্ঠান আয়োজন নির্বিঘ্ন করতে এদিন ১১ হাজারের বেশি নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয়েছিল।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যা হলো
অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে অ্যাবির ভেতর ফুল ও পতাকা দিয়ে সাজানো হয়। রাজনীতিক এবং কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পাশপাশি নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানের কর্মী এবং বিভিন্ন অঙ্গনের তারকারা অ্যাবিতে নিজ আসনে বসে ছিলেন।
নিয়মানুযায়ী শুধু ইংল্যান্ডের ক্যান্টরবুরির আর্চবিশপই ব্রিটেনের রাজা বা রানির অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার অধিকার রাখেন। সে অনুযায়ী বর্তমান আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি এ আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনা করেন।
ধর্মীয় এই আচার-অনুষ্ঠান কয়েকটি ধাপে বিভক্ত, যার মধ্যে ছিল স্বীকৃতি, শপথ, পবিত্র তেলে সিক্ত করা, সিংহাসনে আরোহন, রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়া ও সংবর্ধনা বা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন।
চার্লসের অভিষেক অনুষ্ঠানেও হ্যান্ডেল এর রাজ্যাভিষেক সঙ্গীত ‘জাডোক দ্য প্রিস্ট’ গওয়া হয়। ১৭২৭ সাল থেকে প্রত্যেক ব্রিটিশ রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে এই গানটি গাওয়া হয়েছে।
এদিন কয়েকটি নতুন গানও গাওয়া হয়। যার মধ্যে অ্যান্ড্রু লয়েড ওয়েবারের রচিত একটি গানও ছিল।
রাজা চার্লসের নাতি প্রিন্স জর্জ এবং ক্যামিলার নাতিরা এদিন ‘পেজ’ (বালকভৃত্য) এর ভূমিকায় ছিলেন। তবে রাজপরিবারের দুই বিতর্তিক পুত্র প্রিন্স হ্যারি ও প্রিন্স অ্যান্ড্রু অভিষেক অনুষ্ঠানে কোনো আনুষ্ঠানিক ভূমিকায় ছিলেন না।
তারা দুইজনই রাজপরিবারের কর্মকর্তাদের পেছনে তৃতীয় সারিতে বসেছিলেন।
রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালনের শপথ গ্রহণের সময় চার্লস বেশ গম্ভীর মুখে ছিলেন। শপথের পর ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ রাজার শরীরে পবিত্র তেল লেপন করেন।
এরপর প্রতীকী রাজদণ্ড প্রদর্শন করা হয় এবং আর্চবিশপ রাজা চার্লসের মাথায় সেন্ট এডওয়ার্ডের মুকুট পরিয়ে দেন। উপস্থিত সবাই ‘ঈশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন’ বলে চিৎকার করে ওঠেন।
অভিষেক অনুষ্ঠানের পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা শেষে চার্লস এবং ক্যামিলা বাকিংহাম প্যালেসে ফিরে যান।
রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান স্বচক্ষে দেখতে ভোররাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে লন্ডনে আসেন ৬৩ বছরের শিক্ষক অ্যান্ডি মিচেল।
তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘‘যখন আপনি দেখবেন সবাই সেজগুজে কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, সেটা আসলেই দুর্দান্ত। এটা আপনাকে গর্বিত করবে।
‘‘কিন্তু আমার বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে, তরুণরা এসবে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং ভবিষতে এটা আর এরকম থাকবে না।”