Published : 09 Aug 2023, 02:40 PM
মধ্যযুগে শস্য উৎপাদনে লাঙলের ব্যবহার শুরু হলেও দারিদ্র্য থেকে বের হতে পারেননি ইউরোপের কৃষক। এর মূল কারণ ছিল, সে সময় শাসকদের কারণে উৎপাদনের লাভ কৃষকদের হাতে যায়নি। এর বদলে ওই অর্থে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য গির্জা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের জীবনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি প্রবেশের ফলেও ওই একই ঘটনা ঘটতে পারে, যেখানে গুটিকয়েক মানুষ এর সুবিধা আয়ত্ব করতে পারলেও বাকিদের ক্ষেত্রে সেটা ঘটবে না।
“এআই প্রযুক্তির অনেক সম্ভাবনা আছে, তবে সেটি নেতিবাচক দিকেও যেতে পারে।” – বলেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘এমআইটি স্লোন স্কুল অফ ম্যানেজমেন্ট’-এর বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক সায়মন জনসন।
“আমরা ভাগ হয়ে যাওয়া রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে।”
এআই সমর্থকদের অনুমান বলছে, এই প্রযুক্তি উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি মানুষের জীবনমান উন্নত করবে।
জুনে পরামর্শক কোম্পানি ‘ম্যাককিনসে’ অনুমান প্রকাশ করে বলে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বার্ষিক ১৪ থেকে ২২ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত যোগ করতে পারে এই প্রযুক্তি। দেশটির অর্থনীতিতে সেটি একটি বড় সংখ্যা।
এমনকি রোবটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তি মানবতাকে বিভিন্ন বিরক্তিকর কাজ থেকে মুক্ত করার পাশাপাশি মানুষকে আগের চেয়ে বেশি সৃজনশীল হওয়ার ও অবসর জীবন কাটানোর সুযোগ দেবে, এমন আশার বাণীও শোনাচ্ছেন কেউ কেউ।
তবে দৈনন্দিন জীবনে এমন প্রযুক্তি কী ধরনের প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘মানুষের চাকরি কেড়ে নেওয়ার’ বিষয়টিও। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, জুলাইয়ে হলিউড অভিনেতাদের ডাকা ধর্মঘট। আর এমনটি ঘটেছে এআই ব্যবহার করলে তাদের আর প্রয়োজন পড়বে না, এমন শঙ্কার কারণে।
এই ধরনের শঙ্কা একেবারে ভিত্তিহীন নয়।
উৎপাদনশীলতায় কী লাভ?
ইতিহাস বলছে, বিভিন্ন প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অর্থনৈতিক প্রভাব সাধারণত অনিশ্চিত, অসম ও কখনও কখনও সরাসরি ক্ষতিকর।
এই বছর প্রকাশিত এক বইয়ে এক হাজার বছরের প্রযুক্তির ওপর জরিপ চালান জনসন ও তার সহযোগী এমআইটি অর্থনীতিবিদ ড্যারন অ্যাসেমোগ্লু। এতে উল্লেখ রয়েছে লাঙল থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিওভাবে চেকআউট করা ‘কিয়স্ক’-এর কথাও। আর এগুলো সাজানো হয়েছে ‘চাকরি তৈরি ও সম্পদ ভাগাভাগি’র মতো বিভিন্ন সাফল্যের মাপকাঠির ভিত্তিতে।
১৮ শতকে বস্ত্র শিল্প স্বয়ংক্রিয় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ‘স্পিনিং জেনি’ বা কাটনা। তবে পরে দেখা যায়, এতে কারিগরদের আগের চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হয়। এ ছাড়া, ১৯ শতকে ‘কটন জিন’ বা বীজ আর তুলা আলাদা করার যন্ত্রের জনপ্রিয়তার প্রভাব গিয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ‘দাসত্বের’ বিস্তার ঘটানোয়।
অন্যদিকে, ইন্টারনেট প্রযুক্তির আগমনের বিষয়টি কিছুটা জটিল। কারণ এটি অনেক নতুন চাকরি তৈরি করলেও এ থেকে অর্জিত বেশিরভাগ অর্থ গিয়েছে অল্প সংখ্যক উদ্যোক্তার পকেটে। আর এই খাতে উৎপাদনশীলতার গতিও অনেক দেশে কমে গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে রয়টার্স।
জুনে ফরাসি ব্যাংক ‘ন্যাটিক্সিস’-এর এক গবেষণাপত্রে উঠে আসে, ইন্টারনেটের মতো উন্নত প্রযুক্তিও অনেক খাতে প্রবেশ করতে পারেনি। আর এর থেকে তৈরি অধিকাংশ কাজে তেমন দক্ষতা লাগে না। উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, অনলাইন ডেলিভারি চেইন শপে কাজ করা ব্যক্তিদের কথা।
“এর শেষ সমাধান হল, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতার ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য প্রভাব অনুমানে সতর্ক থাকা।” --বলেছে ন্যাটিক্সিস।
বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এআইয়ের সম্ভাব্য সুবিধা সবাই সমানভাবে পাবে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
একদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নিয়ে বিনিয়োগের প্রতিযোগিতায় নামতে পারে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। ফলে, ক্রমাগত এই খাতের ওপর আরোপিত ‘নীতিমালা শিথিল’ করার ঝুঁকি রয়েছে। অন্যদিকে, এমন ঘটলে অনেক দরিদ্র দেশই প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে।
“এর জন্য আপনার কাছে সঠিক কাঠামো ও বিশাল কম্পিউটিং সক্ষমতা থাকতে হবে।” --বলেন প্যারিসভিত্তিক সংস্থা ‘অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)’র কর্মসংস্থান ও শ্রম বিষয়ক পরিচালক স্টেফানো স্কারপেত্তা।
“আমরা হিরোশিমার জি৭ সম্মেলনে এটা নিয়ে কথা বলছি। তবে আমাদের জি২০ এমনকি জাতিসংঘের কাছেও যেতে হবে।” --মে মাসে জেনারেটিভ এআই’র সম্ভাব্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা নিয়ে ‘জি৭’-এ আলোচনার বিষয়টি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন তিনি।
কর্মীর ক্ষমতায়ন
প্রযুক্তিতে বিভিন্ন উদ্ভাবন সহজে হলেও সেটি সবার জন্য কাজে লাগানো জটিল। আর এখানেই রাজনীতির বিষয়টি চলে আসে।
জনসনের মতে, ১৯ শতকে ইংল্যান্ডে এমন সময় ‘রেলওয়ে’ প্রযুক্তির আগমন ঘটে, যখন দেশটি গণতান্ত্রিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। আর এই উদ্ভাবনের সুবিধা পেয়েছিল সমাজের বেশ কয়েকটি শ্রেণি। হোক সেটা দ্রুতগতিতে তাজা খাবার পরিবহন অথবা অবসরে ভ্রমণ।
এমনকি বিশ শতাকেও একই ধরনের গণতান্ত্রিক সংস্কারে বিভিন্ন প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুবিধা পেয়েছে লাখ লাখ মানুষ। তবে জনসনের দাবি, গত চার দশক ধরে আগ্রাসী শেয়ারমালিকদের কারণে পুঁজিবাদ বদলাতে শুরু করেছে।
তার যুক্তি হল, বিভিন্ন সুপারশপে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের কারণে পণ্যের দাম কমেনি, ক্রেতার জীবনমান বদলে যায়নি এমনকি নতুন কাজও তৈরি হয়নি। এতে কেবল শ্রমিকের খরচ কমেছে ও লাভের মাত্রা বেড়েছে।
৮০’র দশকের আগে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের যেমন প্রভাব দেখা যেত, তা এখন কেবলই অতীত। আর শ্রমিকের অধিকারের পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানেও সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এআই। এর উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, এআইয়ের ওপর ভিত্তি করে কর্মী নিয়োগ ও ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া।
যুক্তরাজ্যের ‘ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেস’-এর কর্মসংস্থান অধিকারনীতি বিষয়ক কর্মকর্তা ম্যারি টাওয়ার্স শ্রমিক ইউনিয়নের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এর মাধ্যমে তারা ‘সংবিধিবদ্ধ পরামর্শের অধিকার পাওয়ার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি সংযোজন নিয়ে দর কষাকষি করার ক্ষমতা’ পাবেন।
শ্রমিক ইউনিয়নের বিষয়টিকে ‘এআই কীভাবে মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে নতুন আকার দিতে সহায়ক হবে’ তা যাচাইয়ের বেশ কয়েকটি উপায়ের একটি হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করছে রয়টার্স। পাশাপাশি, বিভিন্ন এআই নির্মাতা কোম্পানির মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা অ্যান্টিট্রাস্ট নীতিমালা ও কর্মশক্তিকে পুনরায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
জুলাইয়ে পাঁচ হাজার তিনশ কর্মীর ওপর ওইসিডি’র চালানো এক জরিপে উঠে আসে, এআই’র মাধ্যমে কাজে সন্তুষ্টি, স্বাস্থ্য ও আর্থিক সুরক্ষার মতো বিষয়াদি নিশ্চিত করা গেলেও এতে প্রাইভেসি, কর্মক্ষেত্রে পক্ষপাত ও অতিরিক্ত কাজের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো ঝুঁকি থেকে যায়।
“এআই কী বৈষম্য বাড়াবে বা আগের চেয়ে বেশি ন্যায্য অধিকার দেবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।” --বলেন জনসন।