প্রথম কবে থেকে ঘোড়া গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে বেড়ে ওঠে ও মানুষের বিভিন্ন কাজে এর ব্যবহার শুরু হয় এর সঠিক সময়রেখা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বারবার বিতর্ক তৈরি করেছে।
Published : 20 Jun 2024, 02:00 PM
যত ধরনের ঘোড়া এখন দেখা যায়, রেসের ঘোড়া থেকে শান্ত টাট্টু- এদের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে ফিরে যেতে হয় এখন থেকে চার হাজার দুইশ বছর আগে। আর সে অঞ্চলটি হচ্ছে পশ্চিম রাশিয়ার স্তেপ তৃণভূমি।
তবে, প্রথম কবে থেকে ঘোড়া গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে বেড়ে ওঠে ও মানুষের বিভিন্ন কাজে এর ব্যবহার শুরু হয় এর সঠিক সময়রেখা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বারবার বিতর্ক তৈরি করেছে।
এ বিষয়টির দিকেই নজর দিয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণা। সমীক্ষা অনুসারে, গৃহপালিত প্রাণী হিসেবে ঘোড়ার অনেক বেশি ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয় প্রায় চার হাজার দুইশো বছর আগে।
এ সময়কালটি মানব ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অনেক বেশি পরিবর্তনকে চিহ্নিত করেছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে নোরিজ। কারণ, এসব ঘোড়া ইউরেশিয়া (ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশ একসঙ্গে) জুড়ে ছড়িয়ে থাকা লোকদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বাণিজ্যে বিপ্লব ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যেও মেলবন্ধন ঘটায়, যা আগে কখনও সম্ভব হয়নি।
ফ্রান্সের গবেষণাকেন্দ্র ‘সেন্টার অফ অ্যানথ্রোপোবায়োলজি অ্যান্ড জিনোমিক্স অফ টুলুজ’-এর লুডোভিক অরল্যান্ডোর নেতৃত্বে পরিচালিত এ গবেষণায় বিশ্বের ১১৩টি প্রতিষ্ঠানের ১৩৩ জন গবেষক অংশ নিয়েছেন।
গবেষকরা ইউরেশিয়ার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাইট থেকে ঘোড়ার দেহাবশেষ সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি ঘোড়া গৃহপালিত হওয়ার ফলে এদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন জিনগত পরিবর্তন বোঝার জন্য রেডিওকার্বন ডেটিং ও প্রাচীন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং ব্যবহার করেছেন।
এ গবেষণার প্রধান লেখক ও বার্সেলোনার ‘ইনস্টিটিউট ডি বায়োলজিয়া ইভোলুটিভা’র বিজ্ঞানী পাবলো লিব্রাডো বলেন, “এক দশক আগে আমাদের কাছে কেবল কয়েকটি প্রাচীন ঘোড়ার জিনোম ছিল। এখন আমাদের কাছে শত শত ঘোড়ার জিনোম রয়েছে।”
এ গবেষণায় ইউরোপের মূল অঞ্চল এবং কার্পাথিয়ান ও ট্রানসিলভানিয়ান অঞ্চলের উপর নজর দেন গবেষকরা। কারণ, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ঘোড়ায় চড়া ও স্তেপ তৃণভূমি থেকে ঘোড়ার অভিগমনের বিষয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল এ অঞ্চল।
প্রাথমিক ঘোড়া পালনের তিনটি মূল কারণ খুঁজে দেখেছেন গবেষকরা। প্রথমে গবেষকরা ট্র্যাক করেন, কখন আধুনিক ঘোড়ার পূর্বপুরুষরা এদের মূল জন্মভূমি থেকে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গবেষকরা এদের প্রজনন ও আকারে বড় ঘোড়া তৈরির প্রাথমিক বিভিন্ন লক্ষণ চিহ্নিত করতে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে ঘোড়ার সংখ্যার নানা পরিবর্তন পরীক্ষা করেন।
এসব পরীক্ষা করতে গিয়েই ঘোড়ার প্রজননকালের মধ্যে অনেক বেশি সময়ের পার্থক্য খুঁজে পান গবেষকরা। যার মানে হচ্ছে, প্রাথমিক দিকের ঘোড়া পালনকারীরা সম্ভবত ঘোড়ার প্রজননের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতেন।
ঘোড়ার প্রজননের হার বদলানোর দরকার পড়ল কেন? গবেষকরা বলছেন, এসব সে সময় মহাদেশজুড়ে বিচরণ করা লোকদের ঘোড়ার চাহিদা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সে সময়ে ভ্রমণ ও যোগাযোগের জন্য দ্রুততম মাধ্যম ছিল ঘোড়া। আর এ বিষয়টি আমূল বদলে যায় যান্ত্রিক ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর। সেটি এখন থেকে মাত্রই দুইশ বছর আগের বিষয়।
তবে চার হাজার দুইশ বছর আগে যোগাযোগে বিপ্লব ঘটনোরও বেশ অনেকটা পড়ে হয়েছে ঘোড়ার জেনেটিক ম্যাপের পরিবর্তন। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, প্রাথমিকভাবে ঘোড়ায় চড়ার বিষয়টি ওই সময় বসবাসকারীদের অভিগমনকে প্রভাবিত করেনি।
লুডোভিক অরল্যান্ডো ব্যাখ্যা করেছেন, শুরুর দিকের ঘোড়া পালনকারীরা ঘোড়ার প্রজনন বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি প্রজন্ম থেকে আরেকটি প্রজন্মে সময়ের পার্থক্য প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলেন। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ঘটা এ পরিবর্তনে ঘোড়ার উৎপাদনের হার দ্বিগুণ করা সম্ভব হয়েছিল।
কোনো প্রাণীর প্রজন্মের দৈর্ঘ্য পরিমাপে প্রাচীন জিনোমের সাহায্য নিতে হয়। এই গবেষণায় একে আরও উন্নত করে অন্যান্য প্রজাতির গৃহপালিত প্রাণীর প্রজননের নিদর্শন পরীক্ষা করতে, এমনকি মানুষের পূর্বপুরুষদের প্রজন্মের ব্যবধানও বুঝতে ব্যবহার করেছেন গবেষকরা।
এ গবেষণায় মধ্য এশিয়ার বোতাই অঞ্চল থেকে ঘোড়ার একটি স্বতন্ত্র বংশের মধ্যে থাকা ঘোড়াদের প্রজন্মের সংক্ষিপ্ত ব্যবধানও পাওয়া গেছে। এইসব ঘোড়াকে দুধ খাওয়ানো ও কোনো কিছু জোগাড় করে আনার জন্য ব্যবহার করা হত। তবে অন্যান্য ঘোড়ার মতো এদের জেনেটিক গঠন ছোট একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করে, ইউরেশিয়া জুড়ে এরা ছড়িয়ে পড়েনি।
এ গবেষণা থেকে ঘোড়াকে পোষ মানানোর দুটি আলাদা ধরন মিলেছে। প্রথমটি, প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের, যার লক্ষ্য ছিল মধ্য এশিয়ার মানুষের জন্য মাংস ও দুধের মতো খাবার সরবরাহ করা। আর দ্বিতীয়টি, প্রায় চার হাজার দুইশো বছর আগে, যা বর্তমানের পরিচিত গৃহপালিত বিভিন্ন ঘোড়ার দিকে আমাদের চালিত করে ও দ্রুত গতিশীলতা দিয়ে মানব ইতিহাসকে পাল্টে দিয়েছে।