ফ্রান্সের বিপক্ষে মহারণ সামনে রেখে নেওয়া প্রস্তুতিতে আর্জেন্টিনাকে প্রাণবন্তই দেখা গেছে।
Published : 18 Dec 2022, 09:18 AM
একটু দেরিতে অনুশীলনে নামলেন লিওনেল মেসি। নেমেই সতীর্থদের নিয়ে চললেন মাঝমাঠের দিকে। যেখানে অপেক্ষায় কোচ লিওনেল স্কালোনি। একটু ভিন্ন দৃশ্য যেন! আগের দেখায় প্রস্তুতি তিনি সাধারণত তাকে দেখা গেছে সতীর্থদের পেছনে হাঁটতে, এদিন মেসি সবার আগে। ঠিক নেতার মতো।
কাতার বিশ্বকাপের শিরোপা লড়াইয়ে রোববার লুসাইল স্টেডিয়ামে মুকুট ধরে রাখার অভিযানে আসা ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে ৩৬ বছর ধরে বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে সাফল্য খরায় ভোগা আর্জেন্টিনা। এ ম্যাচে আলবিসেলেস্তে সমর্থকরা তাকিয়ে আছে মেসির দিকে।
আর আর্জেন্টাইন মহাতারকা তাকিয়ে আছেন ট্রফির দিকে। কদিন আগে ঘোষণা দিয়েছেন, বিশ্বকাপের আঙিনায় এবারই শেষ। লুসাইলের ফাইনালে ৩৫ বছর বয়সী এই মহাতারকা নামবেন শেষবারের মতো জাদুকরী ফুটবলের পসরা মেলতে। যোগ্য নেতার মতো আর্জেন্টিনাকে পথ দেখাতে। যে কাজটি তিনি এবার করে চলেছেন বছরের পর বছর ধরে, এবার পালা শেষ হাসিতে চারধার মুখরিত করার।
শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে অবশ্য দারুণ হাসিখুশি দেখা গেল মেসি-মার্তিনেসদের। পোল্যান্ড ম্যাচে ফিরে পাওয়া ঊরুর চোট কাটিয়ে অনুশীলনে নামলেন আনহেল দি মারিয়া। বল নিয়ে জাগলিং শুরু করলেন, রানিং, স্ট্রেচিংয়ে গা গরম করে নিলেন। আর্জেন্টাইন সমর্থকদের দুঃশ্চিন্তা যেন কিছুটা হলেও কাটল।
চোটের কারণে ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে খেলতে পারেননি দি মারিয়া। এবার সুযোগ যে হাতছাড়া করতে চান না, তা ফুটে ওঠে ৩৪ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারের নিবিড় প্রস্তুতিতে। অবশ্য ফ্রান্স ম্যাচে স্কালোনি তাকে শুরু থেকে খেলাবেন কিনা, তা নিয়ে একটু দোটানা আছে, কিন্তু দি মারিয়া ফেরায় কোচের মুখে ঠিকই ফিরেছে স্বস্তি।
ফাইনালের আগে অস্বস্তির কাঁটাগুলো একটু একটু করে সরে যাচ্ছে স্কালোনির ভাবনার আকাশ থেকে। কার্ডের খাড়ায় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে খেলতে না পারা মার্কোস আকুনিয়া ফাইনালের প্রস্তুতি নিলেন আঁটঘাট বেঁধে। সেরা একাদশ নিয়ে অবশ্য আড়াল ভাঙেননি স্কালোনি। শুধু বলেছেন, এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছেন সবকিছু।
ট্রেনিংয়ে স্কালোনিকে যেন একটু গম্ভীর দেখা গেল। মেসি-দিবালা-পারেদেসদের পাসিং অনুশীলন একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন তিনি। কখনও চিন্তিত মুখে, কখনও দুই হাত পেছনে মুষ্টিবদ্ধ করে গভীর মগ্নতায় আপন ছকে ডুবে থাকেন তিনি। পথের শেষে এসে ছোটখাট ভুলের যে চড়া মাশুল দিতে হতে পারে, তা যে ভালো করেই জানা আছে ৪৪ বছর বয়সী এই কোচের।
অদূরে এমিলিয়ানো মার্তিনেস, হেরোনিমো রুলি ও ফ্রাঙ্কো আরমানি-এই তিন গোলরক্ষক কাটান ব্যস্ত সময়। তিন জনের মধ্যে ব্যস্ততা বেশি মার্তিনেসের। ফাইনালে উঠে আসার পথচলায়, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে টাইব্রেকারে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত। কিলিয়ান এমবাপে, অলিভিয়ে জিরুদ, উসমান দেম্বেলে-এই ত্রিফলা আক্রমণভাগের শ্যেণ দৃষ্টি থেকে আর্জেন্টিনার গোলমুখ আগলে রাখার মহাভার থাকবে তার কাঁধে।
দায়িত্বের প্রশ্নে কারো কাঁধই আসলে খালি নেই। তবে সে ভার নিয়ে মেসি-মার্তিনেস, এমনকি তেমন সুযোগ না পাওয়া পাওলো দিবালাও ঘাম ঝরান হাসিমুখে। অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর মাঠের চারপাশ তাই মুখরিত হয় রদ্রিগো দে পল-হুলিয়ান আলভারেসদের তালির শব্দে। ঠিক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা, তা শোনা না গেলেও তাদের হাসির রোল ঠিকই ভেসে আসে অপেক্ষমাণ গণমাধ্যমকর্মীদের পেতে থাকা কানে। দেখা মেলে নির্ভার এক আর্জেন্টিনা দলের।
সত্যিই কি নির্ভার মেসি-দি মারিয়ারা? কোপা আমেরিকার ২৮ বছরের খরা তারা ঘুঁচিয়েছেন গেল বছর। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। বরং লাতিন ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ফিরে পাওয়ার আনন্দে আলবিসেলেস্তে সমর্থকদের প্রত্যাশার পারদ এখন আরও উঁচুতে। আর্জেন্টিনার অলিগলিতে তাই চলছে শিরোপা উৎসবের প্রস্তুতি।
শুধু কী আর্জেন্টিনায়? এই মরুভূমিতে কিংবা সূদুর ঢাকাসহ বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আর্জেন্টিনার সমর্থকরাও ক্ষণ গুণছেন প্রিয় তারকার হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখার। মুখিয়ে আছেন মেসিও। কাতার বিশ্বকাপে শুরুর পথচলায় সৌদি আরবের কাছে হেরে টালমাটাল হয়ে যাওয়া আর্জেন্টিনা দিশা ফিরে পেয়েছে ৩৫ বয়সী এই ‘তরুণ’-এর হাত ধরে।
অধিনায়কের বাঁ পায়ের জাদুতে একে একে সব বাধা পেরিয়ে এখন পূর্ণতায় ভেসে যাওয়ার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা। জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় মেসি আরেকবার সে দুয়ার খুলে দিলেই হয়! তিনিও যে তা খুব করে চাইছেন, প্রস্তুতি শুরুর ওই দৃশ্যতে যেন ফুটে ওঠে প্রবলভাবে। প্রস্তুতির মিছিলে সবার সামনে এসে যেন বার্তা দিলেন লুসাইলের ফাইনালে নেতার মতোই আরও একবার নিংড়ে দিতে চান সর্বোচ্চটুকু।