বিশ্বকাপের আঙিনায় রোববার শেষবারের মতো দেখা যাবে ফুটবলের জাদুকর লিওনেল মেসিকে।
Published : 18 Dec 2022, 10:02 AM
আজ মেসি খেলবেন বলে…..। পরের লাইনে কত কিছুই তো বসিয়ে দেওয়া যায়! কোনো চিত্রকর হাতে তুলে নেবেন না রং-তুলি, বরং চোখ মেলে তাকিয়ে থাকবেন লুসাইলের ক্যানাভাসের দিকে, মেসির ছবি আঁকা দেখতে। কোনো শিল্পীর হাতে উঠবে না সেতার-গিটার, বল পায়ে মেসির তোলা সুরের ঝংকার শুনতে কান পেতে থাকবেন তারা। জাদুকর তার জাদুর কাঠি লুকিয়ে রাখবেন বাক্সে, মেসির বাঁ পায়ের জাদু মগ্ধতার দৃষ্টি নিয়ে দেখবেন বলে।
এগুলো হয়তো কেবলই কল্পনা। তবে এমন কল্পনা তখনই করা হয় যখন প্রেক্ষাপট তেমন থাকে। কখনও রোসারিও গলিতে, ডন এপার ক্লাসে, বার্সেলোনার আঙিনায়, প্যারিসের পথে পথে মেসি জাদু দেখিয়ে চলেছেন। ফুটবলপ্রেমীরা প্রাণভরে তা উপভোগ করেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। বিশ্বকাপের আঙিনায় রোববার তার পা পড়বে শেষবারের মতো।
কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে শেষবারের মতো আলো ছড়ানোর দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে নামবেন মেসি। মহারণের কিক অফের বাঁশি বাজতে সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের চোখ আটকে যাবে তার দিকে। রোসারিও ছোট্ট কুটিরে বসে টিভিতে চোখ রাখবেন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া, পাদপ্রদীপের আলো থেকে অনেক দূরে থাকা সিনিয়র এপারিসিও, যিনি ‘ডন এপা’ নামে পরিচিত, মেসির প্রথম কোচ।
ক্ষীণ হয়ে আসা দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে থাকবেন টিভির পর্দায়। মনের পর্দায় ভেসে উঠবে প্রিয় শিষ্যের ছেলেবেলার হাজারো স্মৃতি। দাদির হাত ধরে এই এপারিসিওর দুয়ারে গিয়েছিলেন মেসি। সেসময় ১৯৮৬ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের নিয়ে দল গড়ছিলেন তিনি। মেসির জন্ম ১৯৮৭ সালে। একে তো বয়স কম, তার উপর ছোটখাট গড়ন। গায়ের জামাটা ঝুলে নেমে গেছে হাঁটু অবদি। এপারিসিও সাহস করে উঠতে পারেন না, এতটুকুন ছেলেকে দলে ভেড়াবেন কি করে, সামলাবেনই বা কি করে!
দাদির অনেক অনুরোধে-উপরোধে রাজি হলেন এপারিসিও। ছোট্ট মেসিকে খেলতে বললেন লাইনের কাছাকাছি, তিনিও লাইনের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। পিচ্চি ছেলেটা যদি বড়দের ঘা-গুঁতোয় আঘাত পায়, কিংবা ভয়ে কেঁদে ওঠে, তাহলে যেন দ্রুত বুকে টেনে নিতে পারেন, এই ভাবনায়। সেই বিকেলে এপারিসিও ঠিকই মেসিকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন, তবে অপার বিস্ময়ে, পরম স্নেহে।
স্থানীয় ওই কোচ কিছুদিন মেসিকে দেখলেন নয়ন ভরে। বুঝে নিলেন এই ক্ষুদে জাদুকরকে তার কিছু শেখানোর নেই। পরামর্শ দিলেন আরও ভালো কোচের সন্ধান করতে, আরও বড় আঙিনায় নিয়ে যেতে। রোসারিও মেঠোপথ ছেড়ে বিশ্বের বুকে মেসির পথচলার সেই শুরু। চলছে তো চলছেই। বিশ্বকাপের বিশাল আঙিনায় সেই ছোটাছুটি এবার থামার অপেক্ষা।
বিষাদের রাগিনী মেসি নিজেই বাজিয়েছেন ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর। চার বছর পরের বিশ্বকাপে তাকে আর দেখা যাবে না, লুসাইলে সব নির্যাসটুকু নিংড়ে দিতে নামব-বলেছেন তিনি। সেই থেকে শুরু ভক্তদের অপেক্ষা, কখন মেসি নামবেন, বাঁ পায়ের জাদুতে মুগ্ধতা ছড়াবেন, বিশ্বকাপের শেষটাও কি রাঙাবেন, তা নিয়ে।
ক্লাব ফুটবলে বড়-ছোট মিলিয়ে ৪১টি শিরোপা জিতেছেন মেসি। এর সিংহভাগই বার্সেলোনার জার্সিতে। আর্জেন্টিনায় জন্ম বলে শৈল্পিকতার ছোঁয়া তার পায়ে এমনিতেই ছিল, ‘লা মেসাইয়া’র একাডেমির নিবিড় পরিচর্যায় তা পায় পূর্ণতা। সেই ঝলকই তিনি ক্লান্তিহীনভাবে মেলে ধরেছেন ফুটবলের সবুজে, গোল করেছেন ভুরিভুরি, রেকর্ড গড়েছেন অসংখ্য, সাতবার জিতেছেন বর্ষসেরার মুকুট। দলীয়, ব্যক্তিগত মিলিয়ে তার অর্জনের শোকেস সাফল্যের স্মারকে ভরা।
আর্জেন্টিনার হয়ে অলিম্পিকসের ফুটবলে ইভেন্টের সোনা জিতেছেন। কোপা আমেরিকার শিরোপাও জিতেছেন তিনি, কিন্তু তবুও অপূর্ণ মেসি। আলবিসেলেস্তেদের চোখে যে অলিম্পকের সোনা ‘ছোট ট্রফি।’ লাতিন আমেরিকার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট কোপা আমেরিকা জয় ‘বড় ট্রফি’ হলেও ঠিক যেন বড় নয় তাদের কাছে। বিশ্বকাপই আলবিসেলেস্তেদের মূল চাওয়া।
১৯৮৬ সালের পর থেকে যে হাহাকার বুকে নিয়ে মেসির দিকে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো তাকিয়ে আছে তারা। এটা না পেলে বাকি সব প্রাপ্তির গল্প আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে কাপর্ণ্য করবে না আর্জেন্টাইনরা। এই সত্যিটা অজানা নয় মেসিরও। ক্লাব ফুটবলের সাফল্য তাকে ‘অন্যগ্রহের ফুটবলার’, ‘জাদুকর’-এমন অনেক উপমা দিয়েছে বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পুরোপুরি পরিয়ে দেয়নি আজও।
ব্রাজিল বিশ্বকাপ তা পরিয়ে দিতে পারত, কিন্তু দেয়নি। সেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিতলেন মেসি, কিন্তু বিশ্বজয়ী হতে পারলেন না মারাকানার ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যাওয়ায়। আট বছর আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে নামবেন তিনি।
এবং যখন মেসি নামবেন, কিক অফের বাঁশি বাজবে, তখন হয়ত এই ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বিশ্ব ক্ষণিকের জন্য হলেও বদলে যাবে। হয়তো লুসাইলের ফাইনালে চোখ রাখবেন ২০২০ সালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানো দিয়েগো মারাদোনা। এই শিল্পীর হাত ধরে আর্জেন্টিনা সবশেষ বিশ্বকাপ জয়ের ছবিটা এঁকেছিল। জীবদ্দশায় আর্জেন্টিনাকে আর বিশ্বকাপ জয়ের উচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে দেখা হয়নি তার। কোচ হিসেবে নিজে ২০১০ সালে চেষ্টা করেও পারেননি। অন্যলোকে বসে এই অপূর্ণতাগুলো পূরণে মেসির দিকে তিনিও কী তাকিয়ে থাকবেন না?