মন্ত্রণালয় বলছে, এই ঘোষণার ফলে বৈশ্বিকভাবে হুমকির সম্মুখীন গোলাপী ডলফিন, হাঙ্গর, রে মাছ, সামুদ্রিক কাছিম, সামুদ্রিক পাখি, প্রবাল, সামুদ্রিক ঘাস, শৈবালসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণ সহজ হবে।
Published : 09 Jun 2024, 02:04 AM
জীববৈচিত্র্য রক্ষা, মৎস্য সম্পদ আহরণ, সুনীল অর্থনীতি সমৃদ্ধ করাসহ বেশ কয়েকটি লক্ষ্য সামনে রেখে টেকনাফ সংলগ্ন নাফ মোহনার জলভাগের একটি এলাকাকে ‘নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা’ ঘোষণা করেছে সরকার।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এ সংক্রান্ত গেজেটে বলা হয়েছে, টেকনাফ সংলগ্ন সাগরের ৪৬ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় ৭৩৪ দশমিক ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা সংরক্ষণের আওতায় থাকবে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, “নাফ মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া ঘোষণার ফলে বৈশ্বিকভাবে হুমকির সম্মুখীন গোলাপী ডলফিন, হাঙ্গর, রে মাছ, সামুদ্রিক কাছিম, সামুদ্রিক পাখি, প্রবাল, সামুদ্রিক ঘাস, শৈবালসহ সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ও তাদের আবাসস্থল সংরক্ষণে সহায়ক হবে।
“পাশাপাশি সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের টেকসই আহরণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার মানোন্নয়ন; জাতীয় সুনীল অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা এবং সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনেও এই ঘোষণা কাজে আসবে।”
মন্ত্রণালয়ের ব্লু-ইকোনমি অনুবিভাগের যুগ্মসচিব আবু নঈম মুহাম্মদ আবদুছ ছবুরের সই করা গেজেটটি প্রকাশ করা হয় ২৮ মে।
গেজেটে সংরক্ষিত এলাকার সীমানা এভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে- দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত সামুদ্রিক মৎস্য জলসীমা ও তৎসংলগ্ন নাফ নদীর মোহনা। এর চৌহদ্দি হল- উত্তরে বঙ্গোপসাগর ও টেকনাফ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা), দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর এবং পূর্বে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী নাফ নদীর মধ্যরেখা ও টেকনাফ উপদ্বীপ।
আরও যত সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা
সচিব বেলাল হায়দর জানান, দেশে এখন সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা চারটি– ‘সেন্টমার্টিন মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া’, ‘নিঝুম দ্বীপ মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’ এবং ‘সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া’। এছাড়া কক্সবাজার পশ্চিমে একটি মেরিন রিজার্ভ রয়েছে।
২০২২ সালে সমুদ্র সম্পদের টেকসই আহরণের লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ‘সেন্ট মার্টিন মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সেন্ট মার্টিন সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ৭০ মিটার পর্যন্ত গভীরে ওই এলাকার সীমানা চিহ্নিত করা হয়।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে হুমকির মুখে থাকা প্রবাল, গোলাপী ডলফিন, হাঙ্গর, রে মাছ, সামুদ্রিক কাছিম, সামুদ্রিক পাখি, সামুদ্রিক ঘাস, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং এদের আবাসস্থল সংরক্ষণ; সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের টেকসই আহরণের মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার মানোন্নয়ন; ব্লু ইকোনমি সমৃদ্ধকরণ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-১৪) অর্জনের লক্ষ্যে এই সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনের ৫৯০ হেক্টর এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করে সরকার।
নিঝুম দ্বীপ সংরক্ষিত এলাকা, প্রায় ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে এ দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন সামুদ্রিক এলাকা।
আর ‘সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া’ হিসেবে ২০১৪ সালে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়।
কেন নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা?
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সচিব বেলাল হায়দর বলেন, নাফ নদীর মোহনা দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল যা ইন্দো-বার্মা বায়োডাইভারসিটি হটস্পটের অংশ।
“নাফ নদীর মোহনার জলজ পরিবেশ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য সম্পদের এক অনন্য প্রজনন ও নার্সারি গ্রাউন্ড হিসাবে বিবেচিত।”
তিনি বলেন, “বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২৭টি প্রজাতির মাছের পোনার বিচরণ ক্ষেত্র (নার্সারি গ্রাউন্ড) এটি। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে সম্পদের আহরণ ও দূষণের ফলে নাফ নদীর মোহনার জলজ পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। তাই নাফ নদীর মোহনার জলজ পরিবেশ সংরক্ষণ জরুরি হয়ে পড়ে।”
সচিব বলেন, বর্তমানে নাফ মোহনার অদূরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের চারপাশে প্রায় ১৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার ‘মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া’ ঘোষণা করা আছে। কিন্তু সেটা নাফ নদীর পুরো মোহনাকে সংরক্ষণ করে না, ফলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জীববৈচিত্র্যের অনন্য আধার নাফ মোহনাকে ‘মেরিন প্রটেকক্টেড এরিয়া’ ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
“‘নাফ সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা’ ঘোষণার মাধ্যমে নাফ মোহনা এবং সংলগ্ন সামুদ্রিক এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র, অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ পোনা মাছের বিচরণক্ষেত্র এবং সামগ্রিক জলজ জীববৈচিত্র সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শুধু মৎস্য সম্পদই নয়, এ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র নানা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এই বাস্তুতন্ত্রজুড়ে প্রয়েছে প্রচুর প্ল্যাঙ্কটন, মলাস্ক, ম্যানগ্রোভ, প্রবাল, সামুদ্রিক ঘাস এবং সামুদ্রিক শৈবালের নানা প্রজাতি।”
‘ভালো উদ্যোগ, তবে ঢালাও ঘোষণা সুফল আনবে না’
সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার বিষয়টিকে স্বাগত জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ঢালাও ঘোষণা না দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, “কাগজে কলমে সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকার উদ্যোগ আছে। এটা ভালো উদ্যোগ হলেও বর্তমান বাস্তবতায় তেমন আশাবাদী নই। পর্যাপ্ত রিসোর্স না দিলে, ইমপ্লিমেন্ট না করলে তো কাজে আসবে না।”
তিনি বলেন, এর আগে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড, সেন্টমার্টিন ও নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হলেও কোনো ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন সেভাবে হচ্ছে না।
“শুধু ঘোষণা করলে হবে না। এখানে যে নিয়ম কানুন- কিছুদিন মাছ ধরা যাবে না, বিশেষ করে কয়েক লাখ মৎস্যজীবী, তাদের জন্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে এভাবে ঢালাওভাবে ঘোষণা করে ফলাফল পাওয়া যাবে না।”
নিঝুম দ্বীপের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ শিক্ষক বলেন, সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হলেও মৎস্যজীবীরা এ নিয়ে একেবারেই সচেতন নন।
“সরকার বা উন্নয়ন সংস্থা থেকে খুবই অপ্রতুল কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একেবারে ছোট ছোট পাইলট আকারে করা হচ্ছে। তাতে ফলাফল আসছে না। আইনের প্রয়োগের অভাব রয়েছে। অবৈধ জালগুলো যে ব্যবহার হচ্ছে, যে সময় মাছ ধরার কথা নয়, সে সময় মাছ ধরা হচ্ছে।”
তবে গত কয়েক বছরে ইলিশের উৎপাদন বাড়ার কথা জানিয়ে মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলেন, “ইলিশে একটু বেটার। কারণ, ইলিশের সময় একটা মাস খুব সিরিয়াসলি করা হয়। এসময় মৎস্য, নৌ, সমিতিসহ সবাই এগিয়ে আসে। বাকিগুলোয় কিন্তু কাজ হচ্ছে না।”
>> নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকাটি প্রায় ৩ সহস্রাধিক বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত।
>> নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন জলাঞ্চল জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হটস্পট, যা ডলফিন, পরপয়েস, হাঙ্গর, শাপলাপাতা মাছ ও সামুদ্রিক কচ্ছপদের সুরক্ষা দেবে।
সঙ্কট কোথায়, মন্ত্রণালয় কী বলছে
অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম বলেন, এসব সংরক্ষিত সমুদ্র এলাকার ওপর নির্ভরশীল যে মৎস্যজীবীরা রয়েছেন, তাদের পর্যাপ্ত সম্পদ দিতে হবে। মৎস্যজীবীদের সচেতন করতে হবে। নানা ধরনের ‘ফিশিং ব্যান’ রয়েছে। তাতে মৎস্যজীবীরা বিভ্রান্ত হয়ে যায়। কোন মাসে কীসের নিষেধাজ্ঞা– সেসব বিষয়ে তারা একেবারেই সজাগ নন। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীও পুরোপুরি সচেতন নন।
“কেবল ঘোষণা করলেই হবে না, সবাইকে সচেতন করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের জন্য বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন কিছু উদ্যোগ রয়েছে, ১-২% লোককে কভার করা হয়, খুবই অপ্রতুল সহায়তা দেওয়া হয়। কুমড়ার বীজ, লাউয়ের বীজ-এসব দিয়ে হবে না। এমন সহায়তা দিতে হবে যাতে তাদের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সেখান থেকে আসে। তা না হলে এটা কাজে দেবে না।”
তিনি বলেন, সাধারণ সংরক্ষিত এলাকায় কখনও মাছ ধরা যায় না। দেশের বাস্তবতায় হয়ত কয়েক মাস মাছ ধরতে দেয় বা বড় ফাঁসের জাল ব্যবহার করতে দেয়। সে ব্যাপারেও স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। আবার যে কয় মাস ধরা যাবে না, সে সময় জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে সুফল পাওয়া যাবে না।
“এখানে সরকারের বিনিয়োগ খুবই কম, সুনজর কম- এটা একটা বড় সমস্যা,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, “সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা থেকে সুফল পেতে হলে সব ধরনের অংশীজনকে নিয়ে এগোতে হবে, সহযোগিতা লাগবে। জেলা প্রশাসন, মৎস্যজীবী, উপকূলবর্তী এলাকার লোকজন সবাইকে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।”
এ নিয়ে প্রাথমিকভাবে সচেতনতা তৈরি করার পাশাপাশি সবাই যাতে এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
তবে বর্তমান বাস্তবতায় ‘কিছু সমস্যা’ রয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, “বাস্তবায়নের জন্য মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হচ্ছে। পুরোপুরি সুফল পেতে একটু সময় লাগবে। যারা অংশীজন রয়েছে, তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয় রয়েছে। আমরা চেষ্টা করব দ্রুত এসব সমস্যা সমাধান করে বাস্তবায়ন করার জন্য।”
পুরনো খবর
সেন্ট মার্টিন ঘিরে ১৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা 'সংরক্ষিত' ঘোষণা
সেন্টমার্টিনে প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে মাছ