রাংটিয়া শালবন নিয়ে মুনাফা, বাণিজ্য কিংবা দখলের কোনো রাজনীতি না হোক। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি এবং জীবনজীবিকা বিকাশে এই বনের পরিবেশগত অবদান অপরিসীম। কোনোভাবেই এই বনের ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি আমরা মানব না।
Published : 11 Mar 2025, 06:41 PM
ভাবা যায়, সাত দিন ধরে পুড়েছে রাংটিয়া শালবন। এলোপাতাড়ি এবং নির্মমভাবে। রাষ্ট্র তবু দায়িত্বহীন ও নিশ্চুপ। এটা কোনো কথা, কর্তৃত্ববাদী রেজিম নেই, কোনো ভাগবাটোয়ারা নেই। তাহলে কে বা কারা রাংটিয়া শালবন পুড়িয়ে দেয়ার বাহাদুরি করলো? মুনাফা আর দখলের প্রবল বাসনা ফেনাতে গিয়ে প্রাচীন এক ঝরাপাতার বনকে কারা ধর্ষণ করলো? শুধু রাংটিয়া নয়, এই মার্চের প্রথম সপ্তাহেই দিনাজপুরের সিংড়া শালবনেও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে শতাধিক গাছ।
বাংলাদেশের মিডিয়া যে কোনো ঘটনার খবর পরিবেশন বা ট্রিটমেন্টের ক্ষেত্রে নানা ছল ও রাজনীতি করে। মিডিয়া হাউজের বাণিজ্য ও রাজনীতি সেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ঘটনার বয়ান ও বিবরণে প্রায় সকল মিডিয়ার উপস্থাপন মোটাদাগে ‘একইরকমের’। রাংটিয়া শালবনের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডকে মিডিয়া বলছে, ‘পরিকল্পিত আগুন’। জুলাই অভ্যুত্থানের পরে দেশের এক অতি বিরল বাস্তুতন্ত্রের অধিকারী প্রাচীন নাজুক শালবনকে আগুন দিয়ে অঙ্গার করার ‘পরিকল্পনা’ কারা করে?
বাংলাদেশে প্রধানত তিন ধরণের শালবন বাস্তুতন্ত্র আছে। উত্তরাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত শালবনগুলো বৃহৎ নদীপ্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। শাল বা গজারি এসব বনের নির্দেশক প্রজাতি হলেও দেশের তিনপ্রান্তে বিস্তৃত শালবনের উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির ভিন্নতা আছে। বনের সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পর্কও বৈচিত্র্যময়। মধুপুর ও ভাওয়াল শালবন সর্বাধিক পরিচিত এবং এসব বনে বনআলুর বৈচিত্র্য বেশি। ঠাকুরগাঁওয়ের ঠুমনিয়া, দিনাজপুরের সিংড়া, লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা শালবনে লম্বাটে উঁচু উঁইঢিবি দেখা যায়। এছাড়া জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণার সীমান্তে মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের শালবনগুলো এশীয় হাতির অন্যতম বিচরণস্থল। পূর্বাঞ্চলের শালবনের ভেতর রাংটিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মেঘালয় পাহাড়ের প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বাস্তুতন্ত্রের কাছাকাছি এর অবস্থান। যেখানে বালফাকরামের মতো বিরল বনও রয়েছে। শেরপুরের ঝিনাইগাতীর কাংশা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী হালচাটি, গান্ধীগাঁও, গাজিনি, নকশি, দরবেশটিলাসহ বহু এলাকার কয়েক কিলোমিটার শালবন পুড়ে গেছে। রাংটিয়া বনের ওপর এমন নৃশংসতা সমকালে হয়নি। যদিও এই বনকে নানাভাবে দখল, হত্যা ও লুন্ঠনের ধারাবাহিকা দীর্ঘদিন ধরেই ছিল।
শালবন কেটে রাষ্ট্র অবকাশকেন্দ্র ও পিকনিক স্পট করেছে, আগ্রাসী গাছের বাগান করেছে। রাংটিয়া শালবনের আদিবাসিন্দা কোচ, হাজং ও মান্দিদের নানাভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বাইরে থেকে আসা বাঙালিরা নানাভাবে এই অরণ্য অঞ্চলে নিজেদের বসতিকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা করছে। পাহাড় ও ঝোরা (ছড়া) লন্ডভন্ড করে পাথর ও চীনামাটি উত্তোলনের কারণে এই সীমান্তবর্তী বন আজ মুমূর্ষু। আর এই রক্তাক্ত বনকে কেবল লুণ্ঠন আর দখলের জন্যই আজ অন্যায়ভাবে আগুন দেয়া হয়েছে। বনবিভাগ, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা রাষ্ট্র নির্বিকার। মিডিয়া এখনো রাংটিয়া বন পোড়ানো প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের নাম প্রকাশ করেনি। অথচ বাংলাদেশের সাংবাদিকেরাই কত দুরূহ জটিল আয়নাঘর খুঁজে বের করেছেন। অথচ সুন্দরবন থেকে লাউয়াছড়া কিংবা রাংটিয়া; দেশের প্রাকৃতিক বনে কারা আগুন দেয় এটি কেউ খুঁজে বের করতে পারে না কেন?
পঁচিশ বার আগুনে পুড়ল সুন্দরবন। কয়েকবার লাউয়াছড়া। ভাওয়াল-মধুপুর-পাথারিয়া-রাজকান্দি ঝলসে গেল। মার্কিন কোম্পানির আগুনে-অত্যাচারে স্মরণকালের ভয়াবহ ইকোসাইড হলো মাগুরছড়ায়। একটি অগ্নিকাণ্ডের পদ্ধতিগত তদন্ত হয়নি। ক্ষতিপূরণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। এভাবে একের পর এক প্রাকৃতিক বন আগুন দিয়ে ঝলসে দেয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র নীরব। নাগরিক প্রতিক্রিয়া নেই।রাজনৈতিক দলগুলোরও কেউ জোরালোভাবে দাঁড়ায়নি। বহু ঘটনার ভিড়ে আগুনে পোড়া বন এক-আধটু ছোট্ট সংবাদ হয়ে তারপর অতলে হারিয়ে যায়। রাংটিয়া শালবনের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডে নির্বিকার বসে থাকবার কোনো জো নেই। রাষ্ট্র ও সরকারকে এর দায় নিতে হবে। জবাব দিতে হবে। কোনোভাবেই কোনো কর্তৃপক্ষ পাশ কাটিয়ে এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে পারবে না। আমরা আশা করব দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠিত হবে এবং পাশাপাশি আগ্রহী নাগরিকপক্ষকে নিয়ে রাষ্ট্র দ্রুত একটি সরেজমিন পরিদর্শনের ব্যবস্থা করবে। স্থানীয় বননির্ভর জনগোষ্ঠীসহ নাগরিক সমাজ এবং সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে নিয়ে রাংটিয়াসহ প্রাকৃতিক বনে অগ্নিকাণ্ড রোধে একটি জাতীয় রূপরেখা, নীতি ও নানামেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। রাংটিয়া শালবনের ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণে প্রতিবেশ ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বনতলসহ বনের প্রতিটি স্তর এবং অণুজীবসহ সকল উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যকে মূল্যায়ন করতে হবে। মাটি-পানিসহ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিকে উল্লেখ করতে হবে। বুনো জেনেটিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর ক্ষয়ক্ষতিকেও সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃতিসহ হিসাবে আনতে হবে। ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে আসন্ন বর্ষা মৌসুমের জন্য জনগোষ্ঠীনির্ভর বন ব্যবস্থাপনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে। রাংটিয়াসহ প্রাকৃতিক বনের সকল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করে তাদের আইন ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। একইসাথে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসকারীদেরকে সামাজিক ও পরিবেশগতভাবে বয়কট করার নাগরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখাও জরুরি।
দশ মূলের বন রাংটিয়া
নানা রকমের শণ ঘাস রাংটিয়া শালবনের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ি ঝরনার ধারে জন্মায় কাইশ্যা শণ, টান জায়গায় জন্মে উলু শণ। উলু শণ দিয়ে ঝাড় বানায়। চর জায়গায় হয় বিন্যা ছুবা। পাহাড়ে হয় বড় পাতা শণ এবং হারুঠেহা বন। হারুঠেহা বন এখন বিলুপ্ত। ঘর ছাইতে আগে ব্যবহৃত হত। দশমূলের জঙ্গল রাংটিয়া। দেশের খুব কম বনেই দশটি ভেষজ উদ্ভিদের দেখা মেলে, যার মূল বা শেকড় লোকায়ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। শঙ্খ মূল, বিন্দু মূল, বেনামূল, তেওড়ি মূল, ঈশ্বরমূল, শতমূল, বিন্যা মূল। স্থানীয় হাজং, কোচ ও মান্দিরা এসব ভেষজ ব্যবহার করেন।
কাষ্ঠল লতা কিংবা বন আলু
রাংটিয়া বন ও গাজিনি পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু গাছ ধানচড়া, তারপর শাল ও মাকড়া। বহু লতানো গাছ ছিল আগে রাংটিয়ায়। এমনকি কাষ্ঠল লায়ানা ছিল প্রচুর। জাগড়া গাছের লতা কাটলে লাল কষ বের হয়, লোহার তীর গরম করে সেই কষে চুবিয়ে শিকারের জন্য বিষাক্ত তীর তৈরি হতো আগে। রসে কান্টা, জাখাই তিতা ও মারু কোড়ার মতো লতানো গাছগুলিও রাংটিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। বর্ষাকালে মুরুংগাই নামের বুনো মাশরুম সংগ্রহ করত কোচ নারীরা। এছাড়াও জঙ্গল থেকে মুইয়া বা কচি বাঁশ কোড়ল, বাংকা জাবা, গরেক জাবা, ওয়াকথু, পাসুম, খাংকা, বন খাঘকের মতো বুনো সবজিগুলো সংগ্রহ করা যেত। চৈত্র-বৈশাখের প্রথম বৃষ্টির পর কোচ নারী-শিশুরা জঙ্গলে বুনো আলু তুলতে বের হয়। কোচ ভাষায় খান মাওয়া, ছুরা, খান পানচু, খান দুখুম, খান ছেরেং, দয়াল খান নামের বুনো আলু আছে। ওয়াক (শুকর), মা:ছি (হরিণ), হেজা (খরগোশ), বথি (সজারু), হরতালি (হরিকেল), গুগুই (ঘুঘু), মইয়ুর তাও (ময়ূর), বন:তাও (বনমুরগি), ওলামাখরাই (লজ্জাবতী বানর), মংমা/বাবু (হাতি) ইত্যাদি বন্যপ্রাণীর বিচরণস্থল নিদারুণভাবে বিনষ্ট হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত প্রজাতিবৈচিত্র্য কমেছে।
রাংটিয়া বনের হারানো ‘ঘুপ’ ও ‘খোঁড়ল’
হাজং ভাষায় গাছের খোঁড়ল বা ঢোঁড়কে খুরং বা খং বলে। মাকড়া, বট গাছে খুরং বেশি হয়। খুরংয়ে কাঠকুড়ালি পাখি, সাপ ও তক্ষক বাসা বানায়। কখনো মৌচাকও দেখা যায়। রাংটিয়া পাহাড়ে ‘চেপ্পুং বাড়ি ঘুপ’ নামে এক স্যাঁতস্যাতে জায়গা ছিল। সেখানে চেপ্পুং পান লতাটি বেশি দেখা যেত। এর ছালের রস মাথায় শ্যাম্পুর মতো ব্যবহার করতো কোচরা। প্রাচীন শাল, বট ও মাকড়া, বহেরা গাছ ছাড়া গিলা হয় না। কুচ গোটা পাওয়া যায় না। দুই টিলার খাঁজে ভেজা ছায়াযুক্ত স্থানে বিন্দুমূল গাছ বেশি দেখা যায়। স্বর্পগন্ধা ও হস্তীকর্ণপলাশ খুব কম দেখা যায়। বিষমোড়া আর বিষতেঁতুল বিলুপ্ত। রাংটিয়া বনের ঘুপগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পাহাড়ি ঝোরা বা ছড়াগুলোর প্রবাহ দখল ও বন্ধ হওয়াতে। রাংটিয়া গ্রামের কালাঝুরি ঝোরা ও নকশি গ্রামের মালাক ঝোরা ক্ষতিগ্রস্থ। মঙ্গল ঝোরা ও শিলঝোড়াও আগের মতো প্রবাহিত নয়। বহু পাহাড়ি মাছ, কচ্ছপ, সাপ ও জলজ প্রাণী এখন আর এই বনে খুঁজে পাওয়া যায় না।
পাতার অফিস থেকে পাথর বাণিজ্য
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী বিপিন বিহারী কোচের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল উত্তর গান্ধীগাঁওয়ে, ২০১২ সালের দিকে। তার মা নক্কেশ্বরী কোচ ও বাবা নিমাই কোচের জন্মও রাংটিয়া শালবন এলাকায়। নিমাই কোচের বাবা মার্কন্ড ভুইয়া এবং তার বাবা চিনাল ভুইয়া এই এলাকার প্রাচীন জোতদার ছিলেন। সীমান্তবর্তী এই শালবনগুলো কোচ, হাজং ও মান্দিদের আদি বসতি ছিল। এখনো বহু স্থান নাম তাদের ভাষায় রয়ে গেছে। একইসাথে এলাকাটি ঐতিহাসিক পাগলপন্থী বিদ্রোহের অন্যতম ক্ষেত্র। বহু বিপ্লবী এবং তাদের উত্তরসূরিরা এই অঞ্চলে আছেন। তাদের অনেকেই বহুবিচিত্র দার্শনিক জীবন অনুশীলন করেন। রাংটিয়া রেঞ্জের ভেতরে পড়েছে বড় রাংটিয়া, ছোট রাংটিয়া, নয়া রাংটিয়া, নকশি, গান্ধিগাঁও, ছোট গাজিনি, বড় গাজিনি, সন্ধ্যাকুড়া, শালচূড়া গ্রাম। এখানে হাতির স্মৃতি নিয়ে হাতিপাগার, হাতিবান্ধার মতো বহু গ্রাম এখনো আছে। তবে এই এলাকায় জনমিতির এক নিদারুণ পরিবর্তন ঘটেছে। আদিবাসী অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি আজ বহিরাগত বাঙালিদেরই দখলে। এমনকি প্রাকৃতিক বনের চাইতে এখানে বাণিজ্যিক পর্যটন এবং আগ্রাসী গাছের বাগানের আধিক্য। এখানে একটি জায়গার নাম ‘পাতার অফিস’। আগে এই বন থেকে কুম্ভিরা পাতা বা বিড়ি পাতা বিক্রি হতো। মান্দি ও কোচেরা বলে গাম্বিল বিজাক। এখন আর গাছ নেই, চাহিদা নেই, জোগান নেই, কিন্তু পাতার অফিস নামটি কেবল আছে। এছাড়াও এই বন থেকে আমলকি, বেহরা, হরিতকী, গিলা, খাড়াজুড়া, বলমাত্রা, আগাচি সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয়েছে। নিওলিবারেল বাজারের দাপটে রাংটিয়াও একসময় চীনামাটি আর পাথরের খনি হয়ে ওঠে। ঝোরা, পাহাড়, বন তছনছ করে পাথর বাণিজ্য শুরু হয়। পাহাড় কেটে পাথর তুলতে গিয়ে ২০১০ সালে গান্ধীগাঁওয়ের বদী মিয়া পাথর চাপায় মারা যান। পাথর বাণিজ্যের কারণে বহু আদিবাসী পরিবার উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হয়।
টাঙ্গাইল শাড়ির পোড়াবিনি খই
কোচ ভাষায় জুমআবাদকে বলে হাবা। পৌষের শেষ থেকে জুমের জায়গা প্রস্তুতি শুরু হতো। খরচক মাই, ওয়াকতুক মাই, পোড়াবিনি মাই, পালক মাই, খদরক মাই, তুলসিমালা, চাম্পলি মাই, গারো বিনি ধানগুলো বোনা হতো। কোচদের কাপড় বানাতে চাম্পলি মাই বা ময়নাগিরি ধানের ভাতের মাড় (মাই মান্দু) ব্যবহৃত হয়। এমনকি রাংটিয়া থেকে টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয় পোড়াবিনি ধানের খই যেত টাঙ্গাইলের পাথরাইল গ্রামে। টাঙ্গাইল শাড়িকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই স্বীকৃতিতে এই রাংটিয়া অঞ্চলের পোড়াবিনি ধানের গুরুত্ব অনেক। এমনকি এই অঞ্চলের সুগন্ধি তুলসিমালা ধানও জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৫০ সালে রাষ্ট্র জোর করে জুমআবাদ নিষিদ্ধ করে। তারপরের পনের বছরের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয় সার-বিষ-সেচ নির্ভর সবুজবিপ্লব। প্রবর্তিত এবং এখনো বহাল থাকা কৃষিউৎপাদন এই শালবন বাস্তুতন্ত্রের সাথে বেমানান। সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড কিন্তু ঘটেছে চলতি ফাল্গুন মাসে। ১৯৫০ সালের আগের রাংটিয়া কল্পনা করলে, এই সময়ে এই অঞ্চলে স্তূপ স্তূপ আগুনের কুণ্ড দেখা যেত। ঝোপঝাড় শুকনো ডালপালা একত্র করে ফাল্গুনের শেষে ‘ওয়ার লাখাই ছাউনি’ করে আগুন দেয়া হতো তখন। কিন্তু সে আগুন ছিল এক ঐতিহাসিক চাষাবাদের অংশ। মুনাফা আর দখলের জন্য আগুন দিয়ে সব অঙ্গার করা হতো না। রাংটিয়ায় কোচ, হাজং, মান্দি ও বাঙালি বহু প্রবীণ নারী-পুরুষের সাথে আলাপ করেছি। মাঘ থেকে জ্যৈষ্ঠ এই অঞ্চলে কোনো বড় অগ্নিকাণ্ড তারা কখনোই হতে দেখেননি। সব হারিয়ে এখন চালা জায়গায় কিছু মিশ্র ফসলের আবাদ এখনো আদিবাসী গ্রামে টিকে আছে। পোড়াবিনি, তুলসিমালা, গারোবিনি, চাম্পলি মাইয়ের মতো কিছু ধান এখনো জুমজীবনের স্মৃতি নিয়ে টিকে আছে।
মাসু বাথান ও হরিকেল পাখির কুঞ্জবন
রাংটিয়া শালবনে বহু পবিত্র বৃক্ষ, পবিত্র ধর্মস্থল ও কুঞ্জবন আছে। যদিও তার বেশিরভাগই বেদখল হয়ে গেছে। যেগেুলো টিকে আছে, সেগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ। নকশি গ্রামের নওকুচি মৌজায় মেঘালয় সীমান্তের কাছে প্রায় ২ একর জায়গাজুড়ে পবিত্র কুঞ্জ বন মাসুবাথান। হাগুং (চালা) এলাকায় এই প্রাচীন থান। বিশাল প্রাচীন বট, অশ্বত্থ, আম, বেল, খেজুর, পানিমান্দার, কাঁঠালসহ বহু পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের এক জটিল সমাবেশ হয়েছে এই স্থলটি। স্থানীয় কোচ-হাজংরা এই জায়গাটিকে রাখালস্থানও বলে থাকেন। এখানে খাংখাঙা ও রাখালদেও পূজা হয়।
১৩৯৫ বাংলায় চর্চারাম কোচ, হরিকুমার বর্ম্মণ, নগেন্দ্র্র কোচ, লধেশ্বর কোচ এখানে ইট দিয়ে একটি বেদীস্থল তৈরি করে দেন। নকশি গ্রামে আলাপ হয়েছিল প্রায় শতবর্ষী শ্রীলাল কোচের সাথে। তিনি তার মা বন্তশূরী ও বাবা ছানা কোচের কাছ থেকে মাসু বাথানের গল্প শুনেছেন। ছানা কোচের বাবা রহম কোচ, তার বাবা ঢন কোচেরা এখানেই জন্মেছেন এবং শৈশব থেকেই মাসু বাথান দেখেছেন। রাংটিয়ার মৈদুগাং কুঞ্জবন ছিল প্রায় ৭ একর। বনবিভাগ একটিমাত্র প্রাচীন বটগাছ রেখে শালবন কেটে একাশিয়া লাগিয়েছিল। এখন কেবল বটগাছটির তলে পূজা-কৃত্য হয়। এছাড়াও রেসেনভিটা পবিত্র কুঞ্জবনটি এখন পাথরখনি। আগে কোচদের গ্রামের ভেতর ছিল। এখন এর দক্ষিণে কারাগং নামক স্থানে একটি বটগাছের নিচে পূজা হয়। নকশিতে প্রায় ৫ একরের কালীস্থান আছে। বহু বটগাছ আছে এখানে। এখানে হরিকেল, টিয়া, বুলবুলি ও শালিক ও ঘুঘু পাখিদের নিরাপদ বিচরণস্থল। অনেক হাড়গিলা পাখি ছিল একসময়। নওকুচি গ্রামের প্রবীণ কবিরাজ ফসেন্দ্র স্নাল গল্প করেছেন, ‘...হাড়গিলা পাখি আনাম সাপ গিলে খেত আর পুটকি দিয়া বাইর হইত’।
বিরল জাতের কচু নিয়ে আমাদের ছোট্ট অভিজ্ঞতা
কচু বিশেষজ্ঞ হোসনে আরা বেগম আর আমি একটা সময় দেশের বহু বন-জঙ্গলে বুনো দুষ্প্রাপ্য কচুর খোঁজে ঘুরে বেরিয়েছি। রাংটিয়া রেঞ্জের গজনি বিটে আমরা বেশ কিছু বিরল কচুর প্রজাতি পাই। ২০০৪ সালের জুন মাসে সেসব নমুনা সংগ্রহ করি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর নিশ্চিত হই সেসব কচুর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রেকর্ড দেশে তখনো হয়নি। ‘টাইফোনিয়াম ব্লুমিই’ ও ‘টাইফোনিয়াম কচলিয়ার’ কচু দুটিসহ মোট তিনটি নতুন কচুর রেকর্ড নিয়ে বাংলাদেশ জার্নাল অব বোটানির ২০০৫ সালের ৩৪(২) সংখ্যায় ‘নিউ রেকর্ডস অব থ্রি অ্যারয়েডস ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি যৌথ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় আমাদের। সাম্প্রতিক আগুনে এরকম কতো কচু গাছ যে পুড়েছে কে জানে? কারণ বনবিভাগ, বন অধিদপ্তর কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তর এসব ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আন্তরিক নয়। প্রাকৃতিক বনের অগ্নিকাণ্ডের কোনো ঘটনাতেই তারা দায়িত্বশীল আচরণ করেনি। কর্তৃত্ববাদী রেজিমের পর রেজিম অদলবদল হলেও বনের প্রতি দরদ ও দায়িত্ব এখনো সক্রিয় হলো না। কেবল অভ্যুত্থানকালীন সময় কিছুটা হাইবারনেশন, আবার এরপর পরিস্থিতি বুঝে গিরগিটি হয়ে ওঠা। দেশের বাস্তুতন্ত্র, প্রাণবৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী, অরণ্য কোনোকিছুর প্রতিই কেন কর্তৃপক্ষ দরদী হবে না? দায়বদ্ধ হবে না? তাহলে দায় ও দরদের নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কীভাবে সম্ভব? একটি শালবন ৭ দিন ধরে কেন আগুনে পুড়বে?
জুলাই অভ্যুত্থানের দায় ও দরদ
রাংটিয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও বনবিভাগ নিজেদের দায় ও দায়িত্ব এড়িয়ে বরাবরের মতোই নিজেদের ‘ফুলের মতো নিষ্পাপ ও পবিত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া। অথচ বনবিভাগকে জনগণের খাজনার টাকায় বন ও বন্যপ্রাণের দেখভাল ও সুরক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। রাংটিয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আবারো বিগত রেজিমের মুখস্ত বাইনারি বিভাজন আর মিথ্যাচার টানা হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আওয়াজকে অস্বীকার করে ‘জনগণকেই’ অগ্নিকাণ্ডের হোতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার মিথ্যাচার চলছে। রাংটিয়ার আগুন নিয়ে বনবিভাগের বক্তব্য,“শুকনো মৌসুমে শালপাতা শুষ্ক অবস্থায় বনের ভেতর পড়ে স্তূপ হয়ে থাকে। স্থানীয় বাসিন্দা ও গজনি অবকাশ এলাকায় ট্যুরিস্টদের আনাগোনা বেশি। এছাড়া বনে গরুর রাখালের বিচরণ থাকায় তারা যে বিড়ি সিগারেট খান, সেই আগুন থেকেই জঙ্গলে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে মনে করা হয়।” কোনো প্রমাণ ও তদন্ত ছাড়া, কোনো কর্তৃপক্ষ এভাবে দিনের পর দিন জনগণের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারে না। বনবিভাগ কিভাবে মধুপুর বনে পীরেন স্নাল ও শিশিলিয়া স্নালকে গুলি করেছিল আমরা ভুলিনি। মেনকীফান্দা থেকে অজিত রিছিলকে গ্রেফতার করেছিল আমরা ভুলিনি। কত সহস্র মিথ্যা বনমামলা আর প্রধান বনসংরক্ষকের ঘরভর্তি বোঝাই টাকা পাওয়া গিয়েছিল আমরা কিছুই ভুলিনি। এ ধরণের বাইনারি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রাণ-প্রকৃতির অন্তরায়। বনকর্মকর্তার এই ভূমিকাকে নিরপক্ষে তদন্ত এবং আইন ও বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
আবার একইসাথে সংবাদমাধ্যম বলছে, স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন অসাধু ব্যবসায়ী ও বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শালবন ধ্বংস করে বনের জায়গা দখল নিতেই পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হচ্ছে। কারা আগুন লাগিয়েছে বোঝাতে গণমাধ্যম ‘দুর্বৃত্ত’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য বিবৃত করে এই অগ্নিকাণ্ডের খবর প্রকাশ করে প্রথম আলো লিখেছে, “আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে একটি স্বার্থান্বেষী মহল গারো পাহাড়ে শালবন ও বনবিভাগের জমি দখলের তৎপরতা শুরু করেছে। এলক্ষ্যে দুর্বৃত্তরা বনের গাছ কাটার সুবিধার্থে আগুন লাগিয়ে দেয়। আর এ সুযোগে অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লাখ লাখ টাকার গাছ কাটার পাশাপাশি বনের খালি জায়গা দখল করে বসতি স্থাপন করে।” বনবিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এই অভিযোগের এখনো কোনো বিরোধিতা করেনি।
রাংটিয়া শালবন নিয়ে মুনাফা, বাণিজ্য কিংবা দখলের কোনো রাজনীতি না হোক। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি এবং জীবনজীবিকা বিকাশে এই বনের পরিবেশগত অবদান অপরিসীম। কোনোভাবেই এই বনের ন্যূনতম ক্ষয়ক্ষতি আমরা মানব না। কোনো বিভাজন উস্কে না দিয়ে, মানুষের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও বৈষম্য জিইয়ে না রেখে সকল পক্ষকে সঙ্গী করেই রাংটিয়া শালবন আগলে দাঁড়ানো জরুরি। বহুত্ববাদ আর অর্ন্তভূক্তির এই বার্তাই জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দিয়েছে। রাংটিয়া শালবনের ন্যায়বিচার সুরক্ষিত করার ভেতর দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের আওয়াজ সমুন্নত রাখতে আমরা দায়বদ্ধ।
ছবি: পাভেল পার্থ