শিকারির চোখ হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছে

কয়েক বছর আগেও হাঙ্গর বা রে মাছ জালে পড়লেই শুধু ধরতেন জেলেরা। এখন সময় বদলেছে; বাণিজ্যিক মূল্য বাড়ায় এগুলো ধরার জন্যই সাগরে ছুটছেন শিকারিরা।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Oct 2021, 07:36 PM
Updated : 8 Oct 2021, 07:36 PM

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছর দুয়েক ধরেই শিকারের প্রবণতা বেড়েছে। এর কারণ, হাঙ্গর ও রে মাছের পাখনা, ফুলকা প্লেট ও চামড়ার উচ্চমূল্যের আন্তর্জাতিক বাজার তৈরি হয়েছে। হাঙ্গর রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে ২০তম।

বিপন্ন নানান ধরনের হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ ধরার সাম্প্রতিক এমন প্রবণতার মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার বিপদাপন্ন এসব সামুদ্রিক প্রাণীর সুরক্ষায় উদ্যোগী হয়েছে।

এর অংশ হিসেবে গত ২২ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল সংশোধন করে বিপন্ন হাঙ্গর ও রে মাছের অনেক প্রজাতি অন্তর্ভুক্ত করে প্রকাশ করা হয়েছে হালনাগাদ তালিকার প্রজ্ঞাপন।

তালিকায় তফসিল-১ এ হাঙ্গর ও রে মাছের আটটি গণ এবং ২৩টি প্রজাতি; তফসিল-২ এ একটি গণ ও ২৯টি প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এ উদ্যোগকে বিপন্ন এসব সামুদ্রিক প্রাণীর সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বন অধিদপ্তরের প্রস্তুত করা এ হালনাগাদ তালিকায় বাংলাদেশে পাওয়া হাঙ্গর ও রে মাছ সম্পর্কিত নতুন তথ্য সংযোজন করা হয়েছে।

“বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী এবং এদের গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল রক্ষায় সরকারের আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও সাংবিধানিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এ তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন প্রজাতিগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ ও ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সচেতন করতে পারলে বিলুপ্তির ঝুঁকি কমবে।

সেই সঙ্গে অবৈধ শিকার বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হলে বিপন্ন সামুদ্রিক প্রাণী রক্ষা পাবে এবং ভারসাম্যমূলক প্রতিবেশ বজায় থাকবে।

বন সংরক্ষক রেজাউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মৎস্য অধিদপ্তরসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) কারিগরি সহযোগিতা এ তালিকা করা হয়েছে।“

এছাড়া শার্ক কনজারভেশন ও ফান্ড পিউ চ্যারিটেবল ট্রাস্টস গ্লোবাল শার্ক কনজারভেশন প্রজেক্টের সার্বিক সহায়তায় ডব্লিউসিএস অধিদপ্তরকে সংশোধনীটি প্রণয়নে সাহায্য করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশে রে মাছ খাবার প্রবণতাও বাড়ছে। ছবি: ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস)

হাঙ্গর ও রে মাছ শিকারের প্রবণতা

বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এএসএম জহির উদ্দিন আকন জানান, বিপুল সংখ্যক বন্যপ্রাণী রয়েছে বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চলে। বিশাল এ জগত প্রচুর মাছ ও খনিজ সম্পদের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, এ পর্যন্ত প্রাওয়া তথ্যে দেখা যায় বঙ্গোপসাগরে ১১৬ প্রজাতির হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ বা স্টিং রে রয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই হুমকির সম্মুখীন।

“এ প্রজাতিগুলো মাছ হিসেবে খাওয়া হয় বা শুঁটকি করা হয়- বিষয়টা অনেক ক্ষেত্রেই এরকম নয়। অনেকক্ষেত্রে যেটা হচ্ছে, হাঙ্গর, রে মাছের পাখনা, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করা হয়।

“আজ থেকে ১০ বছর আগেও হাঙ্গর, রে মাছ মাছ ধরার জন্য, শিকার করার জন্য সমুদ্রে কেউ যেত না। তখন মাছ ধরতে গিয়ে একটা, দুটো, পাঁচটা জেলেদের জালে আটকা পড়ছে, তখন নিয়ে আসত।

“কিন্তু ইদানিং দুয়েক বছর ধরে এ প্রাণীগুলোকে হত্যা করার জন্য, ধরার জন্য বিশেষভাবে চেষ্টা নেওয়া হচ্ছে। এগুলো বন্ধে পদক্ষেপ দরকার।”

এ কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের আইনে আগে হাঙ্গর ও রে মাছের ২৩টি প্রজাতিকে সুরক্ষা দেওয়র জন্য তফসিলভুক্ত করা হয়েছিল। এবার সেই তফসিল হালনাগাদ করা হয়েছে নতুন তথ্যের ভিত্তিতে।

বাংলাদেশ ১৯৮১ সালে কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেনজারড স্পেসিস অব ওয়াইল্ড ফিউনা অ্যান্ড ফ্লোরা (সিআইটিইএস) এবং ২০০৫ সালে কনভেনশন অন দ্য কনজারভেশন অব মাইগ্রেটরি স্পেসিস অব ওয়াইল্ড এনিমেল (সিএমএস) এ স্বাক্ষর করে।

জহির উদ্দিন বলেন, হাঙ্গর ও রে মাছসহ বিপন্ন প্রাণীর বৈধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অবৈধ বাণিজ্য প্রতিরোধ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন সংশোধিত তালিকাটি বন অধিদপ্তর এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে হুমকির সম্মুখীন কিছু সামুদ্রিক প্রাণির সুরক্ষা দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

একইসঙ্গে বিপন্ন নয়- এমন প্রজাতিগুলোর টেকসই আহরণের লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামো বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের লাভবান করবে।

বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা অন্যতম সামুদ্রিক প্রাণী গিটারফিশ। ছবি: ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস)

চিনতে হবে, প্রচারও দরকার

মৎস্য অধিদপ্তরের সামুদ্রিক মৎস্য জরিপ ব্যবস্থাপনা ইউনিটের পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, বঙ্গোপসাগরে প্রাওয়া হাঙ্গর ও রে মাছের বিলুপ্তির ঝুঁকি কমানোর জন্য তফসিলে এ সংশোধনী একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ। এখন এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কোন প্রজাতির হাঙ্গর ও শাপলাপাতা মাছ ধরা পড়ছে তা চিহ্নিত করা জরুরি।

“সেই সঙ্গে দক্ষ লোকবল তৈরি করতে হবে, সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং উপকূলে জনসচেতনা তৈরিতে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।

“যদি মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী এবং ভোক্তারা বুঝতে পারে যে বিপন্ন হাঙ্গর ও রে মাছ রক্ষার মাধ্যমে তারা তাদের জীবন-জীবিকা ও খাদ্যসুরক্ষা নিশ্চিত হবে, তাহলে বাংলাদেশে হাঙ্গর ও রে মাছের অত্যধিক আহরণকে ভবিষ্যতে টেকসই সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।”

সুরক্ষার জন্যে তালিকা সংশোধন হলেও প্রজাতিগুলোর ‘ট্যাক্সনমি’ সম্পর্কে ভোক্তা, মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের চেনানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন শরীফ উদ্দিন।

তার মতে, “আসল কথা হচ্ছে- কোনটা ধরা নিষেধ, কোনটা নিষেধ নয়- এ বিষয়টি জানতে হবে, কারণ অনেকগুলো দেখতে প্রায় একই রকম। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। আইনি প্রয়োগের জন্যই এ জাতগুলো চেনানো দরকার, সেজন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

“হাঙ্গর সাগরে থাকে; শাপলাপাতা সাগর থেকে অনেক সময় নদীতেও চলে আসে। রে মাছের অনেক প্রজাতি নদীতে আসে, কিন্তু হাঙ্গর আসে না।”

>> বর্গ-কার্চারিনিফর্মিজ (হাঙ্গর) Carcharhiniformes (Sharks)

>> বর্গ-টর্পেডিনিফর্মিজ (রে মাছ) (Torpediniformes) (Ray fishes) ডাসিয়াটিডি (Dasyatidae) পরিবারভুক্তরা শাপলাপাতা মাছ

>> ১১৬ প্রজাতির হাঙ্গর ও রে মাছের অর্ধেকেরও বেশি প্রজাতি বর্তমানে হুমকির মুখে

 

প্রতিবেশে ভারসাম্য

ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মো. জাহাঙ্গীর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সামুদ্রিক প্রতিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং মানবজাতির জন্য একটি সুস্থ সাগর নিশ্চিত করতে হাঙ্গর ও রে মাছও গুরুত্বপূর্ণ।

কোন ধরনের হাঙ্গর ধরা যাবে, আর কোনগুলো ধরা যাবে না, তা চেনাতে দরকার প্রশিক্ষণ। ছবি: ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস)

হাঙ্গর ও রে মাছের পাখনা, ফুলকা প্লেট ও চামড়ার উচ্চমূল্যের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এজন্য অবৈধভাবে শিকার ও রপ্তানি হয়। এর ফলে বিপন্ন প্রজাতিগুলো ভবিষ্যতে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।”

তার মতে, সরকারের এ হালনাগাদ তালিকা হাঙ্গর ও রে মাছের আটটি গণ ও ২৩টি প্রজাতিকে সুরক্ষা দিতে সহায়ক হবে।

পাশাপাশি বন অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে একটি গণ ও ২৯টি প্রজাতির হাঙ্গর ও রে মাছের ‘টেকসই’ আহরণ, ব্যবহার ও বৈধভাবে বাণিজ্য করার অধিকার দেবে। তবে এগুলোর আহরণ সামুদ্রিক পরিবেশে প্রজাতিগুলোর টিকে থাকার জন্য যাতে হুমকির কারণ না হয়, সেটা বিবেচনায় থাকতে হবে।

ডব্লিউসিএস-এর আবাসিক প্রতিনিধি জানান, এসব সংরক্ষিত হাঙ্গর ও রে মাছের মত সামুদ্রিক প্রাণী ধরা, ক্রয়-বিক্রয় করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ অপরাধে সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।