“জালে কচ্ছপ আটকালে ছাড়াতে যে সময় লাগে, তা খরচ করতে চায় না জেলেরা। ট্রলিং করে যারা মাছ ধরে, তারা জাল বাঁচাতে কচ্ছপের আটকে থাকা অংশ কেটে সাগরে ছেড়ে দেয়।”
Published : 28 Feb 2024, 12:52 AM
ডিম দিতে জন্মস্থানেই ফিরে আসে অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা সামুদ্রিক কচ্ছপ। কিন্তু বাংলাদেশের কক্সবাজারের বালুকাবেলায় ফেরার পথে ছড়িয়ে থাকা মৃত্যুফাঁদে প্রাণ যাচ্ছে তাদের।
মানুষের কর্মকাণ্ডে সৈকত বৈরী হয়েছে আগেই, সাগরও এখন আর নিরাপদ নয়। তাই দেড় দশক আগের তুলনায় কক্সবাজার সৈকতে কমেছে মা কাছিমের আনাগোনা। কমেছে ডিমের পরিমাণও।
বাংলাদেশের ‘বিপদ সংকুল’ সৈকতে এখন আর দলবেঁধে আসে না অলিভ রিডলি। তাই বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ‘আরিবাদা’ও আর দেখা যায় না।
চলতি বছরের দুই মাস পুরো হওয়ার আগেই ৯৫টি মৃত অলিভ রিডলি কচ্ছপ মিলেছে সৈকতে। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের।
প্রাথমিক তদন্তে তারা দেখতে পেয়েছেন, জালে আটকা পড়ায় এবং ফ্লিপার (কচ্ছপের সাঁতার কাটার অঙ্গ) ও গলাসহ বিভিন্ন অঙ্গ কেটে যাওয়ায় এসব কচ্ছপ মারা পড়ছে।
সাগরে অতিরিক্ত ট্রলিং (লম্বা আকারের টানা জাল টেনে মাছ ধরা), উপকূলের কাছাকাছি ফিশিং ট্রলারের আধিক্য, গলায় ও ফ্লিপারে জাল আটকে যাওয়া, জালে আটকা পড়া কচ্ছপ ছেড়ে না দিয়ে ফ্লিপার কেটে দেওয়া, সৈকতে অপরিকল্পিত পর্যটন, অতিরিক্ত আলো ও শব্দদূষণসহ– এরকম সব কারণ বিদ্যমান থাকলে কক্সবাজার সৈকতে ডিম পাড়তে আসা অলিভ রিডলির সংখ্যা দিন দিন আরও কমবে।
মৃত্যু উপকূলে
অলিভ রিডলি জাতের সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার মৌসুম নভেম্বর থেকে মার্চের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। এ সময়ে পূর্ণিমা বা অমাবস্যার সময় সৈকতে আসে মা কাছিম।
এই ভরা মৌসুমে জানুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে সৈকতে ৯৫টি মৃত অলিভ রিডলি কচ্ছপ পেয়েছেন বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) সদস্যরা।
গত রোববার সকাল থেকে দরিয়ানগর প্যারাসেইলিং পয়েন্টে দুটি, রয়্যাল টিউলিপ বিচে দুটি, বাইল্যাখালী বিচে একটি, মাদারবুনিয়ায় একটি, বড়ডেইলপাড়ায় দুটি এবং হাজমপাড়া টেকনাফ বিচে দুটিসহ মোট ১০টি মৃত অলিভ রিডলি কচ্ছপ মেলে।
এর আগে শুক্রবার একদিনেই ২৪টি মৃত কচ্ছপ পাওয়া যায়। গত ১১দিনে পাওয়া গেছে মোট ৫২টি মৃত কচ্ছপ।
কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ সড়কের উখিয়া উপজেলার সোনার পাড়া থেকে টেকনাফ সৈকত, টেকনাফের হাজমপাড়া ও বাহারছড়া, ইনানি সৈকত এবং মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া উপকূলে মৃত কচ্ছপগুলো ভেসে আসে।
বিওআরআই এর জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে মা কচ্ছপ বেশি মাত্রায় ডিম পাড়ে। যেসব মৃত কচ্ছপ পাওয়া গেছে, সবই অলিভ রিডলি প্রজাতির। সবগুলোর পেটে ডিম ছিল।
“বেশিরভাগের শরীরে ছিল জাল প্যাঁচানো, ফ্লিপারে জালের রশি আটকে ছিল, অনেকগুলোর ফ্লিপার ছিল কাটা, গলায় ছিল কাটা দাগ ও ক্ষতচিহ্ন। মারা যাওয়ার ৭-১০ দিন পর এগুলো উপকূলে ভেসে আসে। তখন বেশিরভাগের শরীর ফুলে যায় ও পচে যায়। সেগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।”
এসব কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কচ্ছপের ফরেনসিক করার মত ল্যাব দেশে নেই। তবে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে তাদের মনে হয়েছে, ফেলে দেওয়া জালের অংশ (ঘোস্ট নেট) এবং ফিশিং নেটে ফ্লিপার আটকানোর কারণে এসব কচ্ছপের মৃত্যু হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন বলছেন, জালে কচ্ছপ আটকালে জাল ও সময় বাঁচাতে জেলেরা কচ্ছপের ফ্লিপার কেটে দেয়, সে কারণে কচ্ছপগুলো মারা যাচ্ছে।
“মৃত কাছিমের মধ্যে ৮০ শতাংশের শরীরে ছিল জাল প্যাঁচানো। শুধু কচ্ছপ নয় সৈকতে বড় বড় জেলিফিশও মিলছে। জেলিফিশ হচ্ছে কচ্ছপের খাদ্য। ফিশিং এলাকায় কচ্ছপ ও জেলিফিশের আধিক্য ছিল সম্ভবত।
“জালে কচ্ছপ আটকালে ছাড়াতে যে সময় লাগে, তা খরচ করতে চায় না জেলেরা। ট্রলিং করে যারা মাছ ধরে, তারা জাল বাঁচাতে কচ্ছপের আটকে থাকা অংশ কেটে সাগরে ছেড়ে দেয়।”
বিওআরআই এর জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, অলিভ রিডলির ফ্লিপারের যে আকার, তাতে উপকূলের একদম কাছে যেসব ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়, তাতে কচ্ছপের আটকানোর কথা না।
“সম্ভবত বড় ফাঁসের জাল যারা ব্যবহার করে, অর্থাৎ যেসব বড় ট্রলার টার্গেট ফিশিং করে, সেগুলো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এদের নির্ধারিত সাগর সীমায় মাছ ধরার কথা থাকলেও তারা নিচের দিকে মাছ ধরতে চলে আসে।”
রশি ও ধারালো কিছুতে শরীরে সৃষ্ট ক্ষত এবং ফ্লিপার কাটা থাকায় সাঁতার কাটতে না পেরে বেশিরভাগ আহত কচ্ছপ সাগরেই মারা যায় বলে তরিকুল ইসলামের ভাষ্য।
কচ্ছপের পাশাপাশি গত কয়েকদিনে ডলফিন, পরপইয়েস, রাজ কাঁকড়া ও জেলিফিশও ভেসে আসছে সৈকতে। এর কারণ জানতে কয়েক দিনের মধ্যে সাগরে গিয়ে অনুসন্ধান করবে বিওআরআই এর একটি দল।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গভীর সাগরে মাছ ধরার মত আধুনিক ট্রলার আমাদের দেশে নেই। ফলে বেশিরভাগ ট্রলার তাদের সীমার নিচে উপকূলের কাছে এসে ফিশিং করে। কাছাকাছি এলাকায় থাকা একাধিক ট্রলিংয়ে জালে উপকূলমুখী কচ্ছপের ঝাঁক পড়েছিল হয়ত।”
হায় ‘আরিবাদা’
সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রজাতি অলিভ রিডলি। বৈজ্ঞানিক নাম Lepidochelys olivacea । সাগরে এরা প্রায় ৫০ বছর বাঁচে। দুই থেকে আড়াই ফুট দৈর্ঘ্যের এসব কচ্ছপের ওজন হয় ৫০ কেজি পর্যন্ত।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারবেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এর লাল তালিকায় সংকটাপন্ন (vulnerable) হিসেবে চিহ্নিত এই প্রজাতি।
উষ্ণ মহাসাগরীয় অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে অলিভ রিডলির বাস।
জন্মের পর থেকে সারাজীবন উন্মুক্ত সাগরেই এরা থাকে। কিন্তু ডিম পাড়ার সময় হলে দল বেঁধে হাজারে হাজারে অলিভ রিডলি মা কচ্ছপ ছুটে যায় জন্ম উপকূলের দিকে। একেই বলা হয় ‘arribada’। স্প্যানিশ ভাষার শব্দ ‘আরিবাদা’র অর্থ আগমন।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অলিভ রিডলির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রজনন মৌসুমে দল বেঁধে বালুকাময় সৈকতে জড়ো হওয়া এবং বাসা করে ডিম পাড়া।
“তাদের দল বেঁধে ডিম পাড়ার এই ঘটনাকে ‘আরিবাদা’ বলে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আমাদের পার্শ্ববর্তী ওড়িশার সৈকতে অলিভ রিডলির আরিবাদা দেখা গেলেও, আমাদের দেশে তা দেখা যায় না।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, ওড়িশার গহিরমাথায় ২০২৩ সালে ৫ লাখ ৩৭১৯টি মা কাছিম ডিম ছাড়ে। বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার অংশের ঠিক উল্টো পাশে ওড়িশা রাজ্যের গহিরমাথা মেরিন স্যাংচুয়ারিতে এই তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে। আর ওড়িশার রুশিকুলিয়া বিচে গত বছর ডিম পাড়ে ৬ লাখ ৩৭ হাজার কচ্ছপ।
গহিরমাথা অভয়ারণ্যের মূলত নাসি-১ ও নাসি-২ নামের দুটি দ্বীপে অলিভ রিডলি কচ্ছপ ডিম পাড়ে। ওড়িশা সরকার ১৯৯৭ সালে গহিরমাথার ধামরা নদীর মুখ থেকে হুকিতলা পর্যন্ত ১৪৩৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সামুদ্রিক অভয়ারণ্য ঘোষণা করে।
এই কচ্ছপের সৈকতে আসার সময় সাগরের নির্দিষ্ট এলাকায় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় সেখানে।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল বলেন, সৈকতের বালিয়াড়ির বাসা থেকে ডিম ফুটে বের হবার পর দল বেঁধে সাগরে ফিরে যায় অলিভ রিডলির বাচ্চারা। প্রায় ১৯ বছর সাগরে বিচরণ শেষে যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, স্ত্রী কাছিমরা ডিম পড়ার জন্য তখন জন্মভূমিতে ফিরে যায়।
“পুরুষ কাছিমরা জন্মের পর মুক্তভাবে সাগরে বিচরণ করে এবং কখনো আর সৈকতে ফিরে আসে না। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ বছর পর স্ত্রী ওলিভ রিডলি কীভাবে মাতৃভূমি খুঁজে বের করে, তা আজো এক বিস্ময়।”
মনে করা হয়, মূলত নানা প্রতিকূলতা থেকে ডিম রক্ষার জন্যই দল বেঁধে জন্মস্থানে ফিরে বাসা করে ডিম ছাড়ে মা কচ্ছপ।
সাঈদ মাহমুদ বেলাল বলেন, “মানুষের বিভিন্ন অপরিকল্পিত কার্যক্রমে ডিম পাড়ার পরিবেশ ও উপযুক্ত স্থান নষ্ট হওয়ায় আমাদের সৈকত দিনে দিনে অলিভ রিডলির জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
“এতদিন সৈকতের বালিয়াড়ি ছিল অনিরাপদ। এখন সাগরের মুক্ত পরিবেশও তাদের জন্য মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন অলিভ রিডলি আমাদের উপকূলে আর পাওয়া যাবে না, যা হবে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিনও বাংলাদেশে এ কচ্ছপের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
তিনি বলেন, “ডিম পাড়তে শব্দহীন ও অন্ধকার সৈকত প্রয়োজন। আমাদের মহেশখালী ও মাতারবাড়ি উপকূলে বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে। আর সৈকতের এই অংশে তাদের জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
“এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না পারলে তারা হয়ত আর ফিরবে না। তারা জীবনচক্রে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হবে।”
ডিম রক্ষায় কী হচ্ছে
২০২৩ সালের মার্চ মাসে বিওআরআই এর গবেষক দল প্রথমবারের মত অলিভ রিডলি কচ্ছপের ৯১টি ডিম সংগ্রহ করে। তারমধ্যে ৮৩টি ডিম ফুটে বাচ্চা হয়।
বিওআরআই ছাড়াও দুটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেচার কনজারভেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (নেকম) ও কোডেক সৈকতে এসব কাছিমের পাড়া ডিম রক্ষা ও নিরাপদে বাচ্চা ফোটানোর কাজ করছে।
চলতি বছর এ পর্যন্ত ১০৩টি কচ্ছপের মোট ১১ হাজার ৮৯৫টি ডিম পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে বেসরকারি সংস্থা কোডেক ৫৭টি কাছিমের ৬ হাজার ৫৬৮টি, নেকম ৪১টি কাছিমের দেওয়া ৪ হাজার ৭৭৭টি এবং সরকারি সংস্থা বিওআরআই পাঁচটি কচ্ছপ থেকে ৫৫০টি ডিম সংগ্রহ করেছে।
বিওআরআই এর জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, “প্রতিটি কচ্ছপ ১০০-১২০টি করে ডিম দেয়। মৃত কচ্ছপের সংখ্যা হিসেবে প্রায় ১০ হাজার ডিম আমরা এবার হারিয়েছি।”
সোমবার ভোরে উখিয়ার সোনারপাড়া সৈকতের রেজুখাল মোহনার বালিয়াড়িতে একটি অলিভ রিডলি মা কাছিম ১০১টি ডিম পেড়ে সুস্থ অবস্থায় সমুদ্রে ফিরে যায়।
একই দিনে শামলাপুর দুটি কাছিম থেকে ২৪০টি, মাথাভাঙ্গায় একটি কাছিম থেকে ১১৫টি, উত্তর শীলখালীতে একটি কাছিম থেকে ১১০টিসহ মোট পাঁচটি কাছিম থেকে ৫৬৬ টি ডিম সংরক্ষণ করা হয়।
মঙ্গলবার উত্তর শীলখালী, ছেপটখালী, মাদারবুনিয়া, হাবিব ছরা থেকে বেসরকারি সংস্থা কোডেক- নেচার অ্যান্ড লাইফ প্রজেক্টের কর্মীরা ১৪টি মা কাছিম থেকে ১৫৯৭টি এবং সোনারপাড়া বিচ থেকে বিওআরআই কর্মীরা তিনটি কাছিম থেকে ২৯৩টি ডিম পেয়েছেন। এসব ডিম সংস্থাগুলো তাদের নিজস্ব হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করেছে।
তরিকুল ইসলাম বলেন, “মূলত ইন-সিটু (যেখানে ডিম দেওয়া হয়, সেখানে রেখেই সংরক্ষণ) এবং এক্স- সিটু (কাছাকাছি এলাকায় একই রকম পরিবেশে রেখে বা হ্যাচারি করে সংরক্ষণ) এই দুই পদ্ধতিতে বাচ্চা ফোটানো হয়।”
সেন্টমার্টিন থেকে সোনাদিয়া দ্বীপ পর্যন্ত প্রায় ৭১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ডিম পাড়ে মা কাছিম। এরমধ্যে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, প্যাঁচারদ্বীপ, হিমছড়ি, উখিয়া সোনারপাড়া, ইনানি সৈকত ও সোনাদিয়া দ্বীপে বেশি ডিম পাড়ে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেকম এর ইকো লাইফ প্রকল্পের জেলা ব্যবস্থাপক বিজ্ঞানী আব্দুল কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত আমাদের সাতটি হ্যাচারিতে ৫ হাজার ডিম আছে এবার। ৬০-৭০ দিন পরেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর এদের মুখ সৈকতের উল্টো দিকে করে দিলেও তারা ফিরে সমুদ্রেই চলে যায়।
“২০০৭ সালে আমি যখন কাজ শুরু করি তখন শুধু সোনাদিয়া দ্বীপেই ৮-১০ হাজার ডিম পাওয়া যেত। আমাদের সৈকতে এত বেশি বাধা যে এখানে আরিবাদা হয় না। কাছিমের সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমছিল। গত ৩-৪ বছরে আবার একটু বেড়েছে। কিন্তু যেভাবে কচ্ছপ মারা পড়ছে তা ভয়াবহ।”
রাতের অন্ধকার সৈকতে দেড় থেকে দুই ফুট গর্ত খুড়ে ডিম দেয় মা কচ্ছপ। পরে তা আবার বালি দিয়ে ঢেকে দেয়। এই পুরো কাজে তারা ফ্লিপারকে হাতের মত ব্যবহার করে।
ডিম দেওয়ার পর এই তিন সংস্থার প্রতিনিধিরা এসব এলাকা পরিদর্শন করে। যদি সৈকতের কোনো অংশে কচ্ছপের বাসা প্রাণি যেমন- মানুষ, শেয়াল, কুকুরের বা অন্য বন্যপ্রাণির কারণে অনিরাপদ মনে হয়, তখন কাছাকাছি দূরত্বে একই রকম গর্ত করে ডিম সরিয়ে নেওয়া হয়। একেই বলা হয় হ্যাচারি। হ্যাচারিতে নিরাপদে ডিম ফোটা পর্যন্ত পাহারা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের সৈকতে জন্মানো কাছিম জন্মের পর বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া অংশ পর্যন্ত বিচরণ করে বলে জানান আব্দুল কাইয়ুম।
তরিকুল ইসলাম জানান, ডিম দিতে এসব কচ্ছপ ১৫-১৯ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দেয়। সৈকতে শতভাগ বালি আছে এমন স্থানই বেছে নেয় তারা ডিম পাড়ার জন্য। কাদা বা ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে ডিম পাড়ে না অলিভ রিডলি।
মৃত্যু ঠেকানোর উপায় কি
গত কয়দিন সৈকত থেকে সৈকতে ছুটে মৃত কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনা জানিয়ে তরিকুল ইসলাম বলেন, “কয়েক দিনের পর্যবেক্ষণে একটি বিষয় নিশ্চিত, এই কাছিমগুলো ডিম পাড়তে দলবেঁধে কক্সবাজারের বিভিন্ন সৈকতে আসার পথে বাধাগ্রস্ত হয়ে মারা পড়েছে। সম্ভবত তারা ট্রলিংয়ে পড়ে গিয়েছিল।
“মানবসৃষ্ট কারণেই কচ্ছপ মারা যাচ্ছে। যখন এরা সৈকতের দিকে আসে, তখন পানির উপরিভাগে থাকে। দূর থেকেও এদের দল দেখা যায়। জেলেরা যদি ওই অংশ এড়িয়ে মাছ ধরে বা জালে আটকালে ছেড়ে দেয়, তাহলে প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব।”
কচ্ছপসহ সব সামুদ্রিক প্রাণি বাঁচাতে ‘জাতীয়ভাবে সচেতনতা’ ও ‘সরকারি নির্দেশনা’ চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোসলেম উদ্দিন।
তিনি বলেন, “কচ্ছপ না থাকলে যে মাছও থাকবে না, এই ধারণা যারা মাছ শিকারে যান, তাদের নেই। আর সৈকতে কোথায় আমরা কী প্রকল্প করছি এবং সেগুলো হলে প্রাণিজগতের ওপর কী প্রভাব পড়বে সেটা প্রকল্প গ্রহণের আগে ভাবা উচিত। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা আসা উচিত সাগরে ও সৈকতে কী করা যাবে, আর কী করা যাবে না। এরমধ্যে প্রান্তিক পর্যায়ে জেলেদের সচেতন করার বিষয়টিও থাকবে।”
মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে নেকম কর্মকর্তা আব্দুল কাইয়ুম বলেন, “আমাদের উপকূলের কাছাকাছি জায়গায় বেশি ট্রলিং হয়। কক্সবাজার অঞ্চলের ট্রলারের পাশাপাশি ভোলা, সাতক্ষীরা, খুলনা থেকেও ট্রলার এখানে চলে আসে। বেশি সংখ্যায় ট্রলার ও অতিরিক্ত মাছ ধরা একটি কারণ।
“এছাড়া সৈকতের একদম কাছে কারেন্ট জাল ও ভাসা জাল বিছানো থাকে। যেখানে সেখানে পর্যটন রিসোর্ট। বিচ বাইক চলছে। রাতেও অতিরিক্ত আলো। উচ্চ শব্দ দূষণ। এসব দেখার কেউ নেই। সৈকত ব্যবহারের কোনো নীতিমালা নেই। সৈকতের কোন অংশ প্রাণীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে, তাও নির্ধারিত নেই।”
মাছ ধরার কাজে জড়িত এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে এর সমাধান খুঁজতে চান বিওআরআই এর মহাপরিচালক ড. তৌহিদা রশিদ।
তিনি বলেন, “আমরা সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়েছি। তাদের সচেতন করা গেলে এবং কিছু বিষয় মেনে চললে এই ধরনের বড় ক্ষতি থেকে রেহাই মিলবে। ২-৩ তারিখে (মার্চ) আমরা বসব। কাউকে দোষারোপ নয়, তাদের সমস্যাগুলোও শুনতে চাই। বিশেষজ্ঞরাও থাকবেন।”
বাংলাদেশ মৎস উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার মনে করেন, ট্রলিংয়ের সময় জাল থেকে কাছিম বের হয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা উচিত, যাতে কাঙ্ক্ষিত মাছ জালে আটকা পড়লেও কাছিম সহজেই জাল থেকে বের হয়ে যেতে পারে।
“এছাড়া জালে আটকা পড়লে কীভাবে কাছিমকে অক্ষত অবস্থায় সাগরে অবমুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে মৎস্য শিকারীদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ রক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের যথাযথ উদ্যোগ নেবার এখনই সময়। অন্যথায় সবার অজান্তেই সমুদ্রের প্রাণ প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে।”
সামুদ্রিক কাছিমকে জালে আটকা পড়া থেকে রক্ষা করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ট্রলিং নেটে ‘টার্টল এক্সক্লুডার ডিভাইস’ (TEDs) ব্যবহার হয় বলে জানান সাঈদ মাহমুদ বেলাল।
তিনি বলেন, মাছধরার জালে এই টিইডি ব্যবহার করা হলে জালের ভেতর যদি কোনো কারণে কাছিম ঢুকে পড়ে, তবে তা জালে আটকা না পড়ে সহজেই জাল থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
“এক গবেষণায় দেখা গেছে টিইডি ব্যবহারে সামুদ্রিক কাছিমের মৃত্যুর হার ৯৭ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।”
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সমুদ্রের প্রাণিকূলের সুরক্ষার সাথে সরকারের অনেকগুলো সরকারি দপ্তর ও মন্ত্রণালয় জড়িত। সব বিভাগের সমন্বয় প্রয়োজন এবং অবশ্যই অতিরিক্ত মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে।
স্থানীয়রা বলছেন, ২০১০ সালের দিকে সৈকতে যখন মানুষের কার্যক্রম কম ছিল, তখনও ৩০-৪০টি করে কাছিম দল বেঁধে সৈকতে আসত। আর ডিম ফোটার পর হাজারখানেক ছোট কচ্ছপ ফিরে যেত সাগরে।
কচ্ছপ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে দিন দিন আরো কমতে পারে কচ্ছপের আগমন। আর পরিবেশ অনুকূল করা গেলে, আরিবাদার মত হাজার মা কচ্ছপের আগমন আর লাখ লাখ কচ্ছপ ছানার সমুদ্রে ফিরে যাবার দৃশ্য রচিত হতে পারে কক্সবাজার সৈকতেও।