পুতিনের ব্যাপারে ট্রাম্প সত্য কথাই বলেছেন যে, এ যুদ্ধ পুতিন শুরু করেননি, আর সেইসঙ্গে মিথ্যাও বলেছেন যে, এ যুদ্ধের হোতা জেলেনস্কি। ট্রাম্প যে সত্য কোনোদিনই বলবেন না, তা হচ্ছে, এই যুদ্ধ আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের উস্কানির ফল।
Published : 11 Mar 2025, 04:33 PM
যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু হয় তার আর শত্রু দরকার হয় না— কথাটা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও তার দেশ ইউক্রেইন। এবার ২৪ ফেব্রুয়ারি কিয়েভে আয়োজিত রুশ-ইউক্রেইন যুদ্ধের ৩ বৎসর পূর্তিতে আয়োজিত সভায় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি পাঠায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে জেলেনস্কি কেবল বিশ্বাসঘাতকতারই শিকার হলেন না— তারচেয়েও বেশি। প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তার কাছ থেকে ইউক্রেইনের ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজসম্পদের ওপর অধিকার দাবি করেছেন। তারা তাকে এই যুদ্ধ শুরু করার জন্যও দায়ী করছেন। অভিযুক্ত করছেন যে, তিনি একজন একনায়ক যে কৌশলে নির্বাচন ঠেকিয়ে রেখেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করার জন্য মূল্যবান খনিজ সম্পদ নিয়ে চুক্তি করতে জেলেনস্কি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে ওয়াশিংটনে যান। সেখানে পারস্পরিক বাকবিতণ্ডা কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে পরিণত হয় ও সভাটি ভেস্তে যায়। ট্রাম্প ও তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স সকল কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে রীতিমত ধমকে দিলেন জেলেনস্কিকে। জেডি ভ্যান্সের উগ্রতা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জেলেনস্কি মার্কিন সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানালেও ভ্যান্স তার কাছ থেকে ট্রাম্পের জন্য ক্রমাগত কৃতজ্ঞতা দাবি করতে থাকেন।
২০২২-এর ফ্রেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইন আক্রমণের পর ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিন দিনের মধ্যে রাজধানী কিইভ দখলের। তার ওই আশা পূরণ হয়নি। বরং এক পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা ৩ বছর ধরে যুদ্ধ করছে। অবশ্য ইতিমধ্যে দেশটি ২০ শতাংশ ভূখণ্ড হারিয়েছে রাশিয়ার কাছে। নিহত হয়েছে ইউক্রেইনের ৪৬ হাজার সৈন্য এবং আরও অসংখ্য বেসামরিক মানুষ আহত ও নিহত হয়েছেন। এতকিছুর পরও দেশটি মাথা নত করেনি।
তবে এ কথাও ঠিক যে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেইনের কখনো জেতার সম্ভাবনা ছিল না, আর এখন তো একেবারেই নেই। দেশটি আত্মরক্ষার এই যুদ্ধ করেছে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতায়। তাছাড়া প্রতিদিনই দেশটি বেশি বেশি করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ঠিক এরকম একটা পরিস্থিতিতে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেইনের ওপর থেকে সমস্ত সমর্থন প্রত্যাহার করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির এই হঠাৎ বিপরীতমুখী পরিবর্তন সামরিকভাবে পরাক্রমশালী একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটি দেশকে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
পুতিন তো ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু যিনি তাকে ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিলেন। অতএব পুতিনের ব্যাপারে ট্রাম্প সত্য কথাই বলেছেন যে, এ যুদ্ধ পুতিন শুরু করেননি, আর সেইসঙ্গে মিথ্যাও বলেছেন যে, এ যুদ্ধের হোতা জেলেনস্কি। ট্রাম্প যে সত্য কোনোদিনই বলবেন না, তা হচ্ছে, এই যুদ্ধ আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের উস্কানির ফল।
এ ব্যাপারে পিয়ার্স মরগ্যানের আনসেন্সরডসহ বহু অনুষ্ঠানে বিশ্বখ্যাত মানবতাবাদী মার্কিন অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকসের দেওয়া একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য, যেখানে তিনি বলেন: ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির একত্রীকরণের কালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, ন্যাটো পূর্বদিকে এক ইঞ্চিও সম্প্রসারিত হবে না। এরপরই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতারণা। ১৯৯৪ সালেই বিল ক্লিনটন ঘোষণা করেন যে, ন্যাটোর সম্প্রসারণে কেউ বাধা দিতে পারবে না। পরিকল্পনা করা হয়, একেবারে রাশিয়ার নাকের ডগা পর্যন্ত এই যুদ্ধ জোট সম্প্রসারণের। ১৯৯৯ সালেই হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রকে ন্যাটোর সদস্য ঘোষণা করা হয়। এরপর সাবেক সোভিয়েতের অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহকেও একে একে ন্যাটোর সদস্য করার উদ্যোগ শুরু হয়। এভাবে ইউক্রেইনের সামনে ন্যাটো সদস্য হওয়ার মূলা ঝুলানো হয়। যা পুতিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।
সবচেয়ে বড় মার্কিন ভণ্ডামি হলো ইউক্রেইনের সামনে কেবল এই মূলাটাই ঝুলিয়ে রাখা— তাকে প্রকৃতপক্ষে ন্যাটোভুক্ত না করা। ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো ক্ষমতাই তার ছিল না, অথচ ন্যাটো জোটভুক্ত হয়ে ওই ক্ষমতা লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল, যদিও দেশটির জনগণের বেশিরভাগই ন্যাটো জোটভুক্ত হতে আগ্রহী নয়। বাইডেন প্রশাসন তাই গাজায় গণহত্যার মত করে ইউক্রেইন যুদ্ধকেও জিইয়ে রাখে।
একে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে পরিণত করার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে রাশিয়ার শক্তিক্ষয় করতে এবং নিজের বৈশ্বিক আধিপত্যের বিস্তার ঘটাতে। একই সঙ্গে ইউরোপকেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তাদেরকে কত বেশি ন্যাটো জোটের ওপর নির্ভর করতে হবে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য। ট্রাম্প একদিক থেকে মন্দের ভালো এই অর্থে যে, তিনি অত ধানাইপানাইয়ের মধ্যে নেই। নগদ ব্যবসা নিয়ে তার মাথাব্যথা, জোটফোটে কিছু আসে যায় না। অন্যদের যেখানে অনেক রাখঢাক, ট্রাম্প সেখানে লজ্জাহীনভাবে নগ্ন— একদিক থেকে ভালোই।
শুধু পশ্চিম নয়, যুদ্ধময় পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেইনের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও উল্লেখযোগ্যভাবে দায়ী। ইউক্রেইনীয় নৃবিজ্ঞানী ভলোদিমির আর্তিয়ুখ এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলেছেন (এ ইউক্রেইনিয়ান সোশ্যালিস্ট এক্সপ্লেইনস হোয়াই দ্য রাশান ইনভেশন শুডন’ট হ্যাভ বিন এ সারপ্রাইজ, জ্যাকোবিন সাময়িকী, ৯ মার্চ ২০২২), “সত্য যে ২০১৩-এ ময়দান অভ্যুত্থানের আগে ইউক্রেইনের সমাজ বহুবিভক্ত ছিল। রুশ বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন কারও সঙ্গেই মিশে যাবার জন্য তাদের কোনো একচেটিয়া আকাঙ্ক্ষা ছিল না, আর ন্যাটোর পক্ষে ছিল আরও কম। ময়দান অভ্যুত্থানের কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ, ভূরাজনৈতিক নয়। এটা উৎপন্ন হয়েছিল এক চরম দুর্নীতিবাজ ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু ঘটনাক্রমে ইউক্রেইনীয় সমাজের এইসব দ্বন্দ্ব এক সংকীর্ণ ধনিকগোষ্ঠী নিজ নির্বাচনী স্বার্থে ব্যবহার করে। ময়দান অভুত্থান দ্রুত ছিনতাই হয়ে গণঅসন্তোষ ইউরোপপন্থী ন্যাটোপন্থী সংকীর্ণ নালায় প্রবাহিত হয়।...
“তা সত্ত্বেও একটা নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ মত ছিল যে, এসব প্রশ্ন বাহ্যিক। তাদের কাছে এগুলো উদ্বেগের মূল বিষয় ছিল না, কিন্তু মূল সমস্যাগুলো বলবার মতো কোনো যথার্থ উপায় তাদের হাতে ছিল না। এই সংখ্যাগরিষ্ঠরাই ২০১৯-এ জেলেনস্কিকে নির্বাচিত করে। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যুদ্ধ বন্ধের এবং জাতিগত ও ভাষিক পরিচয় নিয়ে ঘাঁটঘাঁটি না করার। এসব বিভাজনমূলক বিষয়গুলোর পরিবর্তে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুবুদ্ধির ওপর নির্ভর করেন।”
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জেলেনস্কি দিক পরিবর্তন করেন বা করতে বাধ্য হন। প্রথমদিকে তিনি ডান ও বাম, রুশপ ও ইউরোপপন্থী ইত্যাদির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন। একসময় টুপ করে পশ্চিমপন্থীদের কোলে পড়ে যান।” আর্তিয়ুখের ভাষায়, “আর এসময়ই সব ধসে পড়ে”।
যুদ্ধবাজ পশ্চিমাদের ফাঁদে পড়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। জেফ্রি স্যাকস তার সাম্প্রতিক এক লেখায় (নেগোশিয়েটিং এ লাস্টিং পিস ইন ইউক্রেইন, কমন ড্রিমস, ৬ মার্চ ২০২৫) বলেছেন, “ইউক্রেইনে কীভাবে স্থায়ী শান্তি স্থাপিত হতে পারে এ ব্যাপারে দ্বিমতের কিছু নেই। ২০২২ সালের এপ্রিলে তুরস্ক সরকারের মধ্যস্থতায় ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেইন একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের দ্বারপ্রান্তে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য মিলে ইউক্রেইনকে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে সরিয়ে আনে। যার ফল হাজার হাজার ইউক্রেইনবাসীর মৃত্যু ও পঙ্গুত্ববরণ। সেই ইস্তাম্বুল চুক্তির কাঠামো এখনকারও শান্তিচুক্তির ভিত্তি হতে পারে।”
সেসময় আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের উস্কানিতে জেলেনস্কি শান্তিচুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেন। যুক্তরাষ্ট্র তার চোখের সামনে যুদ্ধে বিজয় ও বীরত্বের স্বপ্ন ঝুলিয়ে দেয়। বহু প্রাণ ও সম্পদের বিনিময়ে ইউক্রেইনকে তারা আরও বেশি করে নির্ভরশীল ও অসহায় করে তোলে। জেফ্রি স্যাকসের মতে, ওই চুক্তিটি এখনও ইউরোপে যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপন করতে পারে। যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, আলোচনার মাধ্যমে পশ্চিমা যুদ্ধবাজদের ফাঁদ থেকে ইউক্রেইনের মুক্তিই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলের কাম্য।